এখন ভুলি না কিন্তু নেই সেই বৃদ্ধা
প্রতিদিন বাস থেকে নামি হাতিরঝিলের শেষ ব্রিজটার ঢালে। তারপর ব্যাগ থেকে ছাতাটা বের করি। রাস্তা পার হয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটি। ফুটপাতের পাশে একহাঁটু উঁচু ঘাসের কার্পেট। একদিন পাশাপাশি হাঁটা একজন পথচারীর কাছে জানতে চাইলাম, এই গাছগুলোর নাম কী? তিনি জবাব দিলেন, বট-টট হবে হয়তো।
আমিও তাই ভেবেছিলাম। বটের মতোই তো দেখতে। তবে ভিন্ন জাতের। ছোট ছোট। পাতাগুলো অবিকল বটের মতো। ফুটপাতের শেষদিকটায় একটা বটগাছ। তার ছায়ায় একজন বৃদ্ধা বসে থাকেন হাঁটু ভেঙে। দেখতে বাংলা বর্ণের ‘দ’। পাশে শোয়ানো বাঁশের লাঠি। ধরতে ধরতে তেলতেল হয়ে গেছে। সামনে অ্যালুমিনিয়ামের এবড়ো-থেবড়ো বাটি। দু-একটা ফুটো আছে তাতে। তার মধ্যে খুচরো পয়সা, পুরোনো হয়ে যাওয়া দুই, পাঁচ টাকার নোট। আর হাঁটুর সঙ্গে লাগানো কাপড়ের ব্যাগ। প্রতিদিন দেখি বৃদ্ধার চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। তিনি চিবুক উঁচু করে শূন্যে তাকিয়ে আছেন। কয়েক দিন খেয়াল করার পর বুঝলাম তিনি দেখতে পান না। কেমন বোকা আমি! একবার খেয়াল করিনি বৃদ্ধার চোখের মণিটা ঘোলা। দুধের মতো সাদা হয়ে আছে।
দশটায় অফিস ধরার তাড়া। অ্যাটেনডেন্স মেশিনে দশটার মধ্যে বুড়ো আঙুল ছোঁয়াতে হবে। দ্রুত হাঁটতে হয়। প্রতিদিনই দেখি বৃদ্ধা মানুষটিকে। ভাবি দু-চার টাকা দেয়া দরকার বৃদ্ধার থালায়। দেয়া হয় না। খুব ব্যস্ত কিনা আমি! ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে যখন বৃদ্ধাকে পার হয়ে যাই তখন মনে মনে ঠিক করে ফেলি কাল আর ভুল হবে না। কাল বাস থেকে নামার আগেই পকেট থেকে খুচরো টাকা হাতে নিয়ে রাখব। তারপর কাল আসে। কিন্তু আমি আবার ভুল করি। আর প্রতিদিনই ভাবি কাল আর ভুল হবে না।
মাস খানেক আগে একদিনের ঘটনা। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে আয়নার মুখ দেখতে গিয়ে কেন যেন বৃদ্ধার কথা মনে পড়ল। আমি ওয়ালেট থেকে একটা দশ টাকার নোট আলাদা করে শার্টের বুকপকেটে নিয়ে রাখলাম। যেন আর ভুল না হয়। প্রতিদিন বই পড়তে পড়তে আসি গুলশান থেকে হাতিরঝিলের পথটা। ওই দিন বইও সঙ্গে আনলাম না, যদি ভুলে যাই। পুরোটা পথ মনে করতে করতে এলাম। ব্রিজের ঢাল থেকে যখন রাস্তা পার হচ্ছিলাম তখনো মনে ছিল। ছাতাটাও সঙ্গে আনিনি। যদি ছাতা মেলতে গিয়ে ভুলে যাই। ফুটপাতের বটগাছের ছায়ায় বসে থাকা যুগলদের দিকেও একটিবার তাকালাম না। যদি ভুলে যাই! বুকপকেট থেকে নোটটা হাতে নিলাম। যেন ভুলে না যাই। প্রতিদিনই ঘাসের ওপর দু-চারজন ভাবঘুরেকে মড়ার মতো পড়ে থাকতে দেখি। কাছাকাছি গেলেও মনে হয় যেন মরে গেছে। একবার বন্ধু সুপন বলেছিল, ‘এরা মরে না, দোস্ত। কৈ মাছের প্রাণ। এরা শরীরের সঙ্গে সিসিইউ, আইসিইউ নিয়ে জন্মেছে।’
ওর কথা ভুলও নয়। এই যে, ফুটপাতে সংসারপাতা মানুষগুলো, এরা বছরের বারোটা মাস একই রকম দেখতে। কোনোদিন দেখিনি কারো একটু সর্দিগর্মি হয়েছে। এদের কোলের শিশুগুলোও। শিশু হাসপাতালে এতবার গেলাম, এদের কোনো বাচ্চাকে ভর্তি দেখিনি! এরা সব সময় ফুটপাতে মাটির চুলোতে রান্না বসানো মায়ের পাশে বসে খেলা করে। কালি-মাটিতে মাখামাখি হয়ে বসে থাকে। হামাগুড়ি দেয়। কখনো শুনিনি একবারের জন্য, ‘অ্যাঁ’ করে কেঁদে উঠতে।
ওই দিন ফুটপাতের শেষ দিকটায় চলে এলাম। ঠিক যেখানে রিকশাগুলো একটার পেছনে একটা দাঁড়িয়ে থাকে। চলেই গিয়েছিলাম। আবার পেছনে এলাম। কোথায়? ফুটপাতে অ্যালুমিনিয়ামের কোনো বাটি তো চোখে পড়ছে না! সেদিন আমি ভুলে যাইনি। দশ টাকার নোটটাও হাতে ছিল। পা গুনে গুনে আমি আবার পেছনে গেলাম। আবার ফিরে এলাম। নেই। ফুটপাতে কেউ বসে নেই। সেই বৃদ্ধাকে আর দেখছি না। ভাবলাম কাল বোধ হয় পাব। পরদিন আবার দশ টাকার নোটটা বুকপকেটেই ছিল। দুদিনের বেশি একটা শার্ট পরার মতো থাকে না। অথচ শার্টটাও বদলাইনি। যদি ভুলে বুক পকেটেই থেকে যায় টাকাটা। নাহ, পরদিনও সেই বৃদ্ধার দেখা পেলাম না। আর সব ঠিক ছিল। ছোট ছোট বটগাছের ছায়া ছিল। বৃদ্ধা ছিলেন না। ভাবলাম আগামীকাল ঠিকই তিনি আসবেন। তখন তার হাতে দশ টাকার নোটটা গুঁজে দেব। চোখে দেখতে না পারলেও টাকা ঠিকই চিনতে পারেন। তারপর একইভাবে প্রতিটি আগামীকালই আসে। আমি বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বুকপকেট থেকে দশ টাকার নোটটা বের করে আবার রেখে দিই। হাতিরঝিলে বাস থেকে নামার আগে বুকপকেটে হাত রাখি। যেন ভুলে না যাই। ১০ জুন ২০১৭, ঢাকা।
(ঢাকাটাইমস/১০জুন/মোআ)
মন্তব্য করুন