হাতপাখায় ভাগ্য বদল সাতশ পরিবারের
হাতপাখা, এটি শুধু ঘাম আর গরম থেকে আত্মরক্ষার উপকরণই নয়; চিরায়ত গ্রাম বাংলার কুটির শিল্পের অন্যতম অংশও বটে। হাতপাখা তৈরি ও বিক্রি করে এদেশের গ্রাম অঞ্চলের এক শ্রেণির নিম্নআয়ের মানুষ এখনো জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে। এমনই এক অঞ্চল গফরগাঁও উপজেলার বলদী গ্রাম।
উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে হযরত শাহ্ মিসকিন (রহ.) এর পুণ্যভূমি সংলগ্ন মাঝারি আকারের এ গ্রামে এখনো শুরু হয়নি নগরসভ্যতার ধাপাধাপি, নেই অনর্গল কালিবমি করা যানবাহনের ভেপু। ফুল-ফলে রস তীর্থও নয় এ গ্রাম। তবে ছিমছাম নৈসর্গিক পরিবেশ নিঃসন্দেহে দৃষ্টিনন্দন। গ্রামের উত্তর ও পূর্ব অংশের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শীলা নদী ও পশ্চিম উত্তর অংশে বৃহৎ ছত্রাইল বিলের জলরাশির কলকল শব্দধারা হতদরিদ্র মানুষের মনকুঞ্জে দেয় দোলা।
গুটিকয়েক পরিবার ছাড়া এ গ্রামের প্রায় সবাই ছিল হতদরিদ্র, দিনমজুর, মৎস্য শিকারী, প্রান্তিক ও বর্গা চাষি। বাংলার চিরায়ত কার্তিক চৈত্রের অভাবের ভয়াবহতার চিত্র ছিল এদের নিত্যদিনের সঙ্গী। আবার কেউ কেউ নদীর খাল বিলের ছোট মাছ শিকার করে সংসার চালাত। স্বভাবতই গ্রামের অধিকাংশ লোক এক সময় ছিল হতদরিদ্র, দিনমজুর।
আর্থসামাজিক অবস্থায় পিছিয়ে থাকা বদলী গ্রামের পুরো ছবি এখন হাতপাখার বদৌলতে বদলে গেছে। যে গ্রামের শিশুদের অদৃষ্টে ছিল মজুরি, তারা এখন লেখাপড়া করে। বুঝতে শেখার আগেই পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে হাতপাখার তৈরির কাজে লেগে যায়। সুঁইয়ের প্রতিটি ফোঁড়ে গড়ে তুলে আগামীর এক একটি স্বপ্ন। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার অভাবগ্রস্ত এ মানুষগুলোর ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে এখন সোনালী স্বপ্নে বিভোর তাদের যাপিত জীবন।
এর প্রধান কারণ তাদের হাতে ধরা দিয়েছে আয়ের এক উৎসমূল। কাজটি তেমন কঠিন নয়। নিছক হাতপাখা তৈরি করে তা বিক্রি দেয়া।
বলদী গ্রামে এসে দেখা গেল পূর্বের হতদরিদ্র বর্তমান সময়ে স্বাবলম্বী কয়েকজন পাখা নির্মাণকারী ও বিক্রেতার সাথে। তারা একে একে বর্ণনা করে তাদের সুদিন আসার সংক্ষিপ্ত কাহিনি।
জামেনা খাতুন জামু নামে টান বলদীর মধ্যবয়সী এক নারী স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে নিজ বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করতেন। স্বল্প দাম ও মানের কাপড় দিয়ে শিশুদের পোশাক ও নারীদের ব্লাউজ তৈরি করে বিক্রি করতেন পাড়ার লোকজনের কাছে। যা আয় হতো তা দিয়েই চলত তার সংসার।
এটা একযুগ আগের কথা। ভাবনা চিন্তা প্রসারিত হয়ে শুরু করলেন কাপড়ের নকশা করে বাঁশ দিয়ে হাতপাখা তৈরির কাজ। আপন পরিকল্পনায় জামেনা খাতুনের আয়ের পথ সুগম হলো। প্রথমে গ্রামের মহিলা ভিক্ষুকদের হাত দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় পর্যানুক্রমে তার বিপণন শুরু করলেন গ্রাম থেকে গ্রামে। জামেলা খাতুনের ক্রমবর্ধনশীল এ শিল্পের প্রসার দেখে এলাকার উৎসাহী নারী পুরুষরা অনেকেই তার কাছ থেকে হাতে কলমে শিক্ষা নিয়ে শুরু করেন পাখা তৈরির কাজ।
কাজটি লাভজনক বিধায় অল্প দিনের মধ্যে এর বিস্তার ঘটে পুরো বলদী গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী মুখী, দীঘা ও লাউতৈল গ্রামে। আর এখন বলদী গ্রামের মেয়েরা যে গ্রামে বধু হয়ে যাচ্ছেন সেসব এলাকাতেও ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে এ শিল্পের প্রসার। বলদী গ্রামের প্রায় ৬০০ পরিবারের মধ্যে সব পরিবারের এখন প্রধান জীবিকা এ পাখা শিল্প।
কথা হয় পাখা তৈরির শ্রমজীবী ও পাখা ব্যবসায়ী কাঞ্চন, সামাদ, আকবর, নজরুল রোকেয়া, ফজিলা, মালেকা, নূরজাহান, মর্জিনা, তাজ উদ্দিন, আকবর, নজরুল, আমির আলীসহ বেশ কয়েকজনের সাথে। ঢাকাটাইমসকে তারা জানালেন, এ পাখাগুলো তৈরি করতে প্রথম দরকার গার্মেন্টসের জুট কাপড়, বাঁশ ও সুতা। উৎপাদন পদ্ধতি হচ্ছে কিছু লোক গার্মেন্টস থেকে জুট কাপড় ও গ্রাম থেকে বাঁশ কিনে প্রক্রিয়াজাত করে প্রস্তুতকারকদের কাছে সরবরাহ করেন। পাখা প্রস্তুতকারক নারী ও শিশু শ্রমিকদের মাধ্যমে নির্দিষ্ট শ্রমের বিনিময়ে কাজটি সম্পন্ন করতে হয়। একজন পাখা শ্রমিক দৈনিক গড়ে ১৫-১৭টি পাখা তৈরি করতে পারেন। এখানে তৈরি হয় তিন ধরনের পাখা। উন্নত পাখার মূল জমিনে নানা রংয়ের সুতা দিয়ে নকশী আঁকা থাকে। নকশীর পাশে মিহি সুতায় গাঁথা থাকে গ্রামীণ শ্লোক, ছড়া ও ভালোবাসার ছন্দ।
দৃষ্টিনন্দন এ পাখাগুলোর উৎপাদন খরচ ২০/২৫ টাকা। মাঝারি ধরনের পাখায় নকশী বা কারুকাজ থাকে কম এবং এর উৎপাদন খরচ ১৪/১৬ টাকা। নকশী বা ঝালড়বিহীন সাধারণ পাখাগুলো চলে বেশি। মাত্র ছয় টাকা এর উৎপাদন খরচ।
পাখা তৈরির পর শ হিসেবে এই পেশায় নিয়োজিত পাইকার ও বিক্রেতারা কিনে নেন। প্রতি শ'তে লাভ হয় চারশ টাকার ওপর। বিক্রেতা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এসব পাখা বিক্রি দেন দেশের বিভিন্ন হাটবাজার, শহর বন্দর, বৈশাখী মেলা, পীর ফকিরের মাজার শরিফে ও বাৎসরিক ওরশ মাহফিলে।
এ গাঁয়ের পাখা বিক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম আবুল হাসেম, হেলাল আকবর আলী, আইয়ুব আলী, ফয়েজ, মোকলেছ, আক্তার, শহর আলী, রমিজা বেওয়া, শুক্কুরী প্রমুখ। বলদী ও আশপাশের গ্রামে পাখা শিল্প গড়ে উঠার কারণে গ্রামের হতদরিদ্র ও স্বামী পরিত্যাক্তা মহিলাদের মধ্যে স্বাবলম্বী হয়ে সুখ স্বাচ্ছন্দে দিন কাটাচ্ছেন এখন কংকন, মনোয়ারা, হাজেরা, লাইলী ও মর্জিনাসহ অনেকেই। দিন বদলের পালায় এখন আর পরমুখাপেক্ষি হয়ে চলতে হয় না তাজু, শহর আলী, রইছ, শিরু, কামাল, কাসেম আলী, বাবলুসহ অনেক দরিদ্র মানুষদের। এখন তাদের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন হয়েছে। কিছুদিন আগেও তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে ছিল সামান্য কুঁড়ে ঘর। হাত পাখার বদৌলতে এক দশকে সেখানে উঠেছে পাকাঘর।
পাখা শিল্পে জড়িতদের আক্ষেপ সম্ভাবনাময় এই কুটির শিল্পে এতদিনেও সরকারি কোনো ঋণদান সংস্থা থেকে ঋণ সহায়তা পায়নি। অল্প কিছুদিন হলো গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফাউন্ডেশন ও পদক্ষেপ স্বল্প পরিসরে বদলী গাঁয়ের পাখা প্রস্তুতকারকদের কিছু ঋণ দেয়া নেয়ার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাও আবার চড়া সুদে।
অপরদিকে সালটিয়া ইউনিয়নের রৌহা নামাপাড়া গ্রাম এখন তাল পাখার গ্রাম হিসেবে গত কয়েক বছর ধরে সারা দেশে পরিচিতি লাভ করেছে। এ দুটি গ্রামের দুই শতাধিক পরিবারের পেশা এখন হাতপাখা তৈরি এবং বিক্রি করা। হাত পাখাকেই ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে তাদের জীবন-জীবিকা। এ শিল্পের মাধ্যমে তাদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। পর্যাপ্ত সহায়তা পেলে বলদী, মুখী, লাউতৈল ও রৌহাসহ পাখা পল্লীর এ জনপদের মানুষগুলো এই শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে ভাগ্যের আরও পরিবর্তন করতে পারবে।
(ঢাকাটাইমস/১১জুন/প্রতিনিধি/জেবি)
মন্তব্য করুন