যে লেখায় বার্তা নেই, তা আবর্জনামাত্র: মৌলি আজাদ
মৌলি আজাদ। তরুণ কথাশিল্পী। তার বাবা প্রথাবিরোধী সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ। পেশাজীবনে মৌলি আজাদ বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্মকর্তা। সমসাময়ীক সাহিত্য এবং এ নিয়ে তার নিজস্ব ভাবনা নিয়ে ঢাকাটাইমসের সাথে আলাপ করেন তিনি। মৌলি আজাদের সাথে এ আলাপনে অংশ নেন ঢাকাটাইমসের প্রতিবেদক আসাদুজ্জামান।
তরুণ লেখক হিসেবে আপনি কী মনে করেন যে এই সমাজ পরিবর্তনে আপনি ভূমিকা রাখতে পারেন? পারলে সেটা কীভাবে ?
তরুণ প্রবীণ বলে নয়, লেখক হিসেবে সমাজ পরিবর্তনে বা সমাজে কোন অসঙ্গতি দেখলেই লেখকের কাজ হল তার লেখার মাধ্যমে সেই অসঙ্গতিকে তুলে ধরা । সেটা লেখক প্রবন্ধে লিখতে পারেন, লিখতে পারেন ব্যঙ্গবিদ্রপাত্মক গল্প কিংবা ছড়ায় । সেটা যে বৃহৎ কোন ইস্যু নিয়ে হতে হবে তাও নয়, সমাজের চোখে অনেক সময় চোখে পড়ে না এমন ইস্যুও লেখক কখনও কখনও তার লেখায় তুলে ধরেন। এমনভাবে যা সত্যিকারের মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়। অনেকসময় পাঠককে নানা বিষয়ে সচেতন করে।
আপনি দেখবেন যে, কোন একটা বই পড়ার পর আপনার পুরানো চিন্তার উপর বইটি এমনভাবে নাড়া দেয় যা আপনি আগে কখনও সেভাবে দেখেননি। তাই দেখবেন চারপাশের ঘটে যাওয়া নানান ঘটনায় সচেতন মানুষ সাধারণত লেখকের প্রতিক্রিয়ার দিকেই তাকিয়ে থাকে । লেখকের কাছ থেকে যথার্থ সাড়া না পেলে অনেক সময় তারা আহতও বোধ করেন ।
দেশের সামগ্রিক পেক্ষাপট, জঙ্গীবাদের উত্থান, এসব কি এখনকার লেখকরা গল্প, উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে তুলে আনছেন। নাকি মৌলবাদীদের ভয়ে লেখকরা মাথা নত করছে বলে আপনি মনে করছেন? আপনার নিজের লেখায় ও কি এসব জায়গা পাচ্ছে?
জঙ্গিবাদের উত্থান,মৌলবাদ,সাম্প্রদায়িকতা এসব বিষয়ে এখনকার অনেক লেখকই গল্প/উপন্যাস লিখছেন। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে অদিতি ফাল্গুনীর লেখা উপন্যাস ‘ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে’ উপন্যাসটির কথা । দু এক বছর আগে আমি এ লেখাটি পড়েছি। লেখক তার উপন্যাসে সাম্প্রতিক সময়ের নানান সত্য ঘটনাকে কাহিনির ভাঁজে ভাঁজে তুলে ধরেছেন। উপন্যাস নয় যেন, মনে হয়েছে সত্য ঘটনাগুলো অক্ষরে ভাসছে। উপন্যাসটি পড়ার সময় আমার শরীর ভয়ে কাটা দিচ্ছিল। তবে লেখকের সাহসিকতার জন্য তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি ।আর আমার ক্ষেত্রে বলব এসক ঘটনা আমাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে, কাঁদায়। কিন্তু আমি এ ধরনের লেখা লিখিনা কারণ আমার পরিবারে এ নিয়ে অর্থাৎ শুধুমাত্র একটি উপন্যাস লেখার জন্যই সৃষ্টি হয়েছিল দগদগে ঘা । বলতে পারেন আমাদের পরিবারে সেই ঘা এর যে ক্ষত, তা আজও শুকায়নি ।
আপনি সরকারের একজন কর্মকর্তা, আবার একজন লেখক, সচেতন নাগরিক। সরকারের সমালোচনা করতে কতটা পারঙ্গম?
সবসময় সমালোচনাই সকল বাধার মুক্তির পথ বলে আমি মনে করিনা। সরকারের ভাল কাজটাই বা আমরা কজনে তুলে ধরছি ,বলুন ? নাগরিক হিসেবে সবমিলিয়ে সরকারের কাজে সাহায্য করার যে দায়, সেটাতো আমাদেরই।তাইনা ?
এই সমাজ ও সামাজিক পেক্ষাপট একজন তরুণ সাহিত্যিককে কতটা প্রভাব বিস্তার করে? করলে সেটা কীভাবে?
সাহিত্যিক সমাজের বাইরের কেউ নন। সমাজ, তার চারপাশ, মানুষ, পরিবেশ, পরিস্থিতি সবকিছুই তার উপর প্রভাব ফেলে। অন্যরা সে প্রভাবটা হয়ত প্রকাশ করার পথ পান না । কিন্তু লেখক তার লেখার মাধ্যমে তার উপর পরা নানা প্রভাব, আনন্দ, যন্ত্রনা প্রকাশ করতে পারেন।লেখক সমাজ নিয়েই কলম দিয়ে খেলেন।কখনও লেখার মাধ্যমে ভোতা সমাজকে বিনির্মাণ করেন, আবার কখনও পুরানো চিন্তাকে ভেঙ্গে পাঠককে নতুন ভাবে ভাবার সুযোগ করে দেন।লেখার মাধ্যমে নতুন যেকোন আইডিয়া সৃষ্টিই লেখকের অ্যাচিভমেন্ট। বইয়ের পাতায় পুরোনো চিন্তাভাবনা আজকের দিনের পাঠকের কাছে একথায় রিজেক্টেড।
শহরের জীবন যান্ত্রিকতায় মানুষ এখন এতটাই ব্যস্ত যে বই পড়ার সময় পাচ্ছে কম। ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন। এতে মানুষ সাহিত্যবিমুখ হচ্ছে কী?
ব্যস্ততার জন্য মানুষ বই পড়ার সময় পাচ্ছে না এর সাথে আমি একমত নই।যারা এ অজুহাত দেখান তারা আগেও বই পরতেন না। আর শহুরে মানুষ যদি বই না পড়ত তবে বইমেলায় এত বই বিক্রি হয় কি করে ?
যে বইযের পোকা সে নানার ব্যস্ততার মাঝেও দিনেও একপাতা হলেও পড়বে। তা সে বই বা পত্রিকায় প্রকাশিত কোন গল্পই হোক না কেন ।
স্মার্টফোন দিয়ে যে ই-জেনারেশন তৈরি হচ্ছে সেখানে এখন কাগজের বইয়ের চেয়ে ই-বুক, অ্যাপসে তরুণরা বই পড়তে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন। আপনি কি মনে করেন একটা সময় কাগজের বই প্রকাশ বন্ধ হয়ে যাবে? গল্প, উপন্যাস কিংবা কবিতা প্রকাশ হবে ই-পেপারে, অ্যাপসে?
এটি আমার ভাল লাগে । সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন প্রযুক্তি আসবে, এগুলো আমাদের গ্রহণ করতে হবে । প্রয়োজনে ইবুক যাতে আরও বেশি পাঠক সাবস্ক্রাইব করতে পারেন সে বিষয়ে নানান উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে ।
আমি জ্যোতিষী নই তাই আমি কাগজের বই প্রকাশ ভবিষ্যৎে হবে কি হবে না এ বিষয়ে এখনই কিছু বলতে পারছিনা তবে আমার মনে হয় মলাটের ভিতরে থাকা বইয়ের জায়গা অন্য কিছু দখল করে নেয়ার সময় এখনও ঢের বাকি ।
প্রযুক্তির সঙ্গে এখনকার সাহিত্যিকরা কতটা মানিয়ে নিতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন? কীভাবে?
ধীরে ধীরে মানিয়ে নিচ্ছেন । কারণ একজন সাহিত্যিক যিনি আধুনিক চিন্তা নিয়ে সমাজে চলতে চান তার পক্ষে কি প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে চলা সম্ভব? এ কছর বইমেলায় কয়েকজন লেখকের বই অ্যাপসে প্রকাশ হতে দেখেছি। আমি চাই ধীরে ধীরে এর প্রসার বাড়ুক ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক তরুণ সাহিত্যিকই তাদের সৃষ্টিকর্ম তুলে ধরছেন। প্রতিদিনই তাদের মনের কথা প্রকাশ করছেন। এতে করে তারা বড় বেশি উন্মু্ক্ত হচ্ছেন, প্রকাশিত হচ্ছেন। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত সাহিত্যিকই বলে থাকেন বড় সৃষ্টি কর্মের জন্য একটা আড়াল প্রয়োজন। স্যাতস্যাতে অন্ধকার ঘরের ভেঁজা মাটির গহ্বর থেকে যেমন মাশরুমের ভ্রণ বের হয় তেমনি নাকি একজন সাহিত্যিকের সৃষ্টি কর্ম অন্তরাল থেকে সৃষ্টি হয়। কিন্তু এখনকার ফেসবুক লাইভের যুগে সেটা কতখানি সম্ভব?
ফেইসবুককে অমি একটি সোস্যাল সাইট হিসেবে দেখি । আগে আমরা বন্ধুদের সাথে দেখা হলে, ফোনে কথা হলে মনের ভিতরে জমে থাকা হাজারও কথা বলতাম। কিন্তু এখন অনেক কিছু পাল্টে গেছে। কালেভদ্রে আমাদের বন্ধুদের সাথে দেখা হয়। ইদানিং আমরা বন্ধু, অত্মীয়দের বাসায়ও নানান কারণে ঘনঘন যাই না, যেতেও পারি না। মনে করে দেখুন, হয়ত অনেক পরিচিতর সাথে আমাদের পাঁচ বছরের উপর দেখা হয় না। ফোন করে যে বন্ধুর গলার স্বরটা শুনব তারও খুব একটা তাগিদ ইদানিং আমরা পাই না। কিস্তু অনেকদিনের না দেখা মানুষরা কিন্তু দূরে থেকেও দুরে নেই । কারণ ফেইসবুক।ফেইসবুক আমাদের এইভাবেই কাছে রেখেছে এবং কে কেমন আছি বা আজকের দিনেই কোন ঘটনা নিয়ে আমাদের মানসিক অবস্থা প্রকাশের একটা জায়গা যেন ফেইসবুক।আমার কাছে এ মাধ্যমটা অনন্য মনে হয়, কিন্তু ফেইসবুকের লেখার সথে একজন সত্যিকারের লেখকের লেখাকে মেলানো যায় না বোধহয়। ফেইসবুকের দেয়ালে যারা লেখক নন তারাও অনেক সময় অনেক বিষযে ভালো লেখেন।কিন্তু ফেইসবুকের ওয়ালে লিখলেই যে কেউ অসামান্য সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবেন সে ব্যাপারে আমার দ্বিধা আছে বৈকি!
প্রত্যেক লেখক, সাহিত্যিক নিজস্ব ঘরানায়, নিজস্ব স্টাইলে সাহিত্যকর্ম রচনা করেন। আপনার বাবাও একটি ঘরানাকে প্রধান্য দিয়েছেন। সবাই যেটাকে বলছেন প্রধাবিরোধী। আপনি নিজেকে কোন ঘরানায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান?
আমি লিখছি। আরও অনেক লেখার ইচ্ছা আছে। কিন্তু আমার মনে হয় এখনই কোন ঘরানার মত করে লেখার আমার সময় হয়নি ।
অভিযোগ রয়েছে এখনকার সাহিত্য মানুষকে কোনো বার্তা দিতে পারে না। সাদত হাসান মান্টোর বইতে আমরা দেখেছি প্রতিটি গল্পে একটি বার্তা থাকতো। যেমন ছিল ঈশপের গল্পে। গল্প, উপন্যাস কি নিছক বিনোদনের জন্য নাকি সেখানে কোনো বার্তাও থাকবে বলে আপনি মনে করেন? আপনার লেখায় কোনো বার্তা থাকে কী?
এ বক্তব্যের সাথে আমি একমত নই।যারা বলেন তারা বোধহয় না পড়েই এ ধরনের বুলি আওড়ান । গল্প, উপন্যাস কখনই নিছক বিনোদনের জন্য লেখা হয় না। লেখায় বার্তা থাকবেই। যেসব লেখায় বার্তা থাকে না সেসব লেখা আবর্জনামাত্র। নিজের লেখা সর্ম্পকে নিজে কিছু বলাটা নিজেকে কুৎসিত ভাবে প্রকাশ করার মতই আমার কাছে মনে হয়।আমার লেখায় বার্তা আছে কি নেই তা পাঠকের কাছে জানতে চাইলেই বোধহয় ভালো হয় ।
আপনি ছোট গল্প ও উপন্যাস লিখে থাকেন। কখনও কবিতা লিখেছেন কী? কবিতা লেখার চেষ্টা করেন?
আমি এ দুসাধ্য কাজটি কখনও করিনি । কখনও করব বলেও মনের ভিতর ইচ্ছা প্রকাশ করিনি ।
উপন্যাস না গল্প, কোন মাধ্যমকে আপনি শেষ্ঠ মনে করেন?
দুটো দু’রকম। তবে ভাল ছোট গল্প আমার মনে গেঁথে থাকে।
উইলিয়াম সমারসেট মম বলেছেন, ‘একজন কবি যখন যাবেন, তখন একজন গদ্যকার পথ ছেড়ে দিয়ে একপাশে দাঁড়াবেন’। কবি কি এতই সম্মানিত? আপনার কি মত?
সকল আধুনিক লেখকের প্রতিই আমার গভীর শ্রদ্ধা ।
প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায়, এখনকার সাহিত্যিকরা শুধু প্রচার চায়। প্রচারণার জন্য তারা এতটাই মগ্ন যে, সাহিত্য পাঠ কিংবা সাহিত্য অন্বেষণে সময় দিতে পারে না। কি বলবেন? আপনি নিজে কোন দলে? প্রচারবিমুখ নাকি আপনিও প্রচারণা চান?
এ অভিযোগের সাথে আমি একমত নই । প্রচার শুধু লেখকেরা নয় যাদের প্রচার পাবার সুযোগ আছে তারা সবাই চায় । তবে দোষ কেন লেখকের ?
(ঢাকাটাইমস/১১জুন/এজেড/কেএস)
মন্তব্য করুন