মুক্ত শেখ হাসিনা অনেকখানি টেনেছেন বাংলাদেশকে

প্রকাশ | ১১ জুন ২০১৭, ২৩:০০

শেখ আদনান ফাহাদ

অনেক দিন রাষ্ট্রে তৃতীয় শক্তির কথা তেমন শোনা যায়না। শোনা না গেলেই ভালো। কারণ কথিত এই তৃতীয় শক্তি কোনো বৈধ রাজনৈতিক শক্তি নয়। অগণতান্ত্রিক এই শক্তির কারসাজিতে দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১/১১ বলে খ্যাত ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের দীর্ঘ ১১ মাস কারাভোগ করেছিলেন। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ভোররাতে ধানমণ্ডির সুধাসদন থেকে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় সেনাসমর্থিত তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী। ২০০৮ সালের ১১ জুন কারাভোগের পর সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত বিশেষ কারাগার থেকে তিনি মুক্তি লাভ করেন।
 
কারাগারে থাকাকালে শেখ হাসিনা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় চিকিৎসার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তাঁর মুক্তির জোর দাবি ওঠে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিকামী জনতার অদম্য আন্দোলনের ফলে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। এর পরের ইতিহাস সকলের জানা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণআন্দোলনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় প্রায় দুই বছর বয়সী সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার। নামে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলেও আসলে ছিল তৎকালীন সামরিক বাহিনীর মদদপুষ্ট বিশেষ এক শক্তি। ১১ জুন শেখ হাসিনা শুধু একা মুক্ত হয়েছিলেন তা নয়, তিনি যেন পুরো বাংলাদেশেরই মুক্তির দূত হয়ে ফিরে এসেছিলেন কারাগার থেকে মুক্ত পরিবেশে।  

২০০৬ সালে বিএনপি আমলের রাষ্ট্রপতি এবং বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ  জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের গ্রহণযোগ্য ভোটার তালিকা এবং পরিবেশ স্থাপনে ব্যর্থ হলে ২০০৭ সালের শুরুতে ইয়াজউদ্দিনকে হটিয়ে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয় বিশ্বব্যাংকে চাকরি করা অর্থনীতিবিদ ফখরুদ্দিন আহমদকে। অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির মাঝে ২০০৭ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারীতে সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

নির্বাচন এবং নির্বাচনকালীন সরকার সংক্রান্ত ঐক্যমতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি-জামাতের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ চরমে উঠলে সেনাবাহিনী দৃশ্যপটে হাজির হয়। দেশের মানুষ, এমনকি আওয়ামী লীগও প্রথমদিকে সেনা-সমর্থিত সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে স্বাগত জানায়। কিন্তু মোহ কেটে যায় অল্পদিনের ভেতরে। দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের নামে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা শুরু হয়। বাদ যায়নি বিএনপির অনেক নেতাও। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, যুদ্ধাপরাধী জামাতের তেমন কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি সে সময়। আসলে সে সময়কার সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল এজেন্ডা ছিল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে দুর্বল করে দেশে রাজনৈতিক শক্তিকে বিনাশ করা। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথমে শেখ হাসিনাকে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই এবং এর আড়াই মাস পরে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া উভয়কে রাজনীতির ময়দান থেকে চিরতরে হটিয়ে দেয়ার নীল নকশা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘মাইনাস-২ ফর্মুলা’ নামে লিপিবদ্ধ থাকবে। তবে অগণতান্ত্রিক শক্তির মূল টার্গেট যে শেখ হাসিনা ছিল, সেটা তৎকালীন শক্তির বিভিন্ন কার্যকলাপে প্রতিভাত হয়েছে।    

শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগ তথা দেশের রাজনীতি থেকে দূরে ঠেলে দিতে একাধিক পরিকল্পনা করেছিল   অগণতান্ত্রিক শক্তি। প্রথম পরিকল্পনা ছিল, শেখ হাসিনা যদি বিদেশ যান, তাহলে তাঁকে আর দেশে ফিরতে দেয়া হবেনা। ছেলে-মেয়েকে দীর্ঘদিন দেখেন না, তাই শেখ হাসিনা পরিকল্পনা করলেন যে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর কানাডা যাবেন। শেখ হাসিনা বিদেশ গেলেন পরিবারের সদস্যের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে পুরো শক্তি নিয়ে হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার পরিকল্পনায় ব্যস্ত হয়ে উঠে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এমনও হয়েছে যে, শেখ হাসিনা দেশে ফেরার জন্য বিমানে উঠেছেন, কিন্তু তাকে বিমান থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। দেশে আসলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে দেশে-বিদেশে আতংক ছড়ানো হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা এতটুকু ভয় পাননি। ৫ মে, ২০০৭ সালে স্বদেশে ফিরে আসেন তিনি।

শেখ হাসিনা সাহস করে দেশে ফিরে আসায় বাড়া ভাতে ছাই পড়ে সেনাসমর্থিত সরকারের কুশীলবদের। দিশেহারা হয়ে এবার মামলার পথ বেছে নেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দুর্নীতির মিথ্যা সব অভিযোগ এনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নানা মামলা করা হয়। শেখ হাসিনাকে ‘দুর্নীতিবাজ’ প্রমাণ করার জন্য তখন দেশের কিছু সংবাদমাধ্যম অপসাংবাদিকতায় লিপ্ত হন। এই বড় বড় সাংবাদিকদের এখন আবার আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হয়েছেন। ইংরেজি পত্রিকার একজন সম্পাদক কয়েকদিন আগে একটি টকশোতে স্বীকার করেছেন যে, তার পত্রিকায় প্রকাশিত শেখ হাসিনার দুর্নীতি বিষয়ক লিড স্টোরি ছিল সাজানো। বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার যোগসাজশে তখন এই সাজানো রিপোর্ট বিশাল কাভারেজ দিয়ে ছাপানো হয়েছিল। দেশের মানুষের মনে শেখ হাসিনার নেতিবাচক ‘ভাবমূর্তি স্থাপন করা হয়ে গেছে ভেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে সেদিন ভোররাতে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। গ্রেপ্তার করার আগে দীর্ঘসময় সুধাসদন তছনছ করা হয়। তল্লাশির নামে মাঝরাতে শেখ হাসিনাকে ঘুম থেকে উঠতে বাধ্য করা হয়। সেই আতংকের, দুশ্চিন্তার রাতের গল্প আরেকদিন বলব। শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় আদালতে, সেখান থেকে সংসদ ভবনের একটি বাড়িতে বিশেষ কারাগারে বন্দী করা হয়। বিশেষ সেই কারাগারে অবহেলায়, অযত্নে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন শেখ হাসিনা। মুক্তির আন্দোলন তীব্র হলে, তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন সরকার।

জেল থেকে বের হয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় নামেন শেখ হাসিনা। হয়ত জেলে থাকতেই ভেবে রেখেছিলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করবেন তিনি। কারাগারের নির্জনতায় হয়ত ছক কষেছিলেন ডিজিটাল বাংলাদেশের। তখনই হয়ত ভেবেছিলেন, জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচার প্রক্রিয়া সমাপ্ত করবেন তিনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজের যে অগ্রগতি আমরা এখন দেখছি, তার পরিকল্পনা কি শেখ হাসিনা জেলে থাকতেই করেছিলেন? দেখা হলে কোনদিন জিজ্ঞেস করে জেনে নিব। কিন্তু এটা এখন দিবালোকের মত সত্য যে, নির্জন সে কারাবাসের দিনগুলোতে শেখ হাসিনা যে পরিকল্পনা সমূহ করেছিলেন, তাতেই বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সেই ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে মানুষের জন্য কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন বৃষ্টিস্নাত সেই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে। ১/১১ এই পুরো কর্মযজ্ঞে শেখ হাসিনার জীবনে এক সাময়িক অবসর হয়ে এসেছিল বোধহয়। কষ্ট করেছিলেন শেখ হাসিনা, কিন্তু কষ্টকালীন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার সুফল ভোগ করছে পুরো বাংলাদেশ। অনেক সমস্যা আছে দেশে সত্যি। কিন্তু ৪৫ বছরের জঞ্জাল ৮ বছরে দূর  করবেন কীভাবে? তারপরও গত আটবছরে নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি চোখে পড়ার মত। যারা দেখেও পরিবর্তন স্বীকার করেনা, তাদের কথা ভিন্ন। মুক্ত শেখ হাসিনা অনেক দূর নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশকে। কিন্তু সামনের দিনগুলোতে আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মত বিকল্প নেতৃত্ব কি তৈরি হচ্ছে? শেখ হাসিনা ইদানিং সুযোগ পেলেই অবসরের কথা বলেন। অবসরে একদিন যেতে হবেই। তখন এমন নেতৃত্ব কীভাবে পাবে বাংলাদেশ?

লেখকঃ শিক্ষক, সাংবাদিক