ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে বৈরী সম্পর্কের শুরুর দিনগুলো
২০১১ সালে উপমহাদেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচটাই ছিলো ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে। টসে জিতে ব্যাট করতে নামে ভারত। ইনিংসের প্রথম বলেই শেবাগ চার মেরে রানের খাতা খুলেন। শেবাগের ১৭৫ রানের সুবাদে ভারত ৪ উইকেটে ৩৭০ রানের পাহাড় গড়ে তুলে। অনায়াসে ম্যাচটি জিতে নেয় ভারত ৮৭ রানে বাংলাদেশকে হারিয়ে। টেন্ডুলকার তার আত্মজীবনী ‘Ôplaying it my way’ তে জানাচ্ছেন Ôthe 2007 defeat had been avenged and we were off to the start we had hoped for.
মানে-‘২০০৭ এর পরাজয়ের প্রতিশোধটা নেয়া হলো আর আমরাও আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী শুরু করতে পারলাম।’
টেন্ডুলকারের শততম সেঞ্চুরির দিনটি কিন্তু বাংলাদেশের
ভারতীয় ক্রিকেট ঈশ্বর শচীন টেন্ডুলকার তার কাক্সিক্ষত শততম সেঞ্চুরিটি করেছিলেন আমাদের মিরপুর স্টেডিয়ামে। ১৬ মার্চ ২০১২। বাংলাদেশে বসেছে এশিয়া কাপের আসর। আগে ব্যাট করে ভারত করে ২৮৯ রান। বিফলে যায় শচীনের শততম সেঞ্চুরি। ম্যাচ জিতে বাংলাদেশ এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠে। কয়েকদিন পর ভারতীয় ধনকুবের মুকেশ আম্বানী শচীনের জন্য পার্টির আয়োজন করে। বলিউডের সব মহাতারকা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়। উপস্থাপনায় ছিলেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। শচীনের জন্য গান গাইলেন কিংবদন্তী লতা মাঙ্গেশকর। লতা মাঙ্গেশকারকে মা বলে ডাকেন টেন্ডুলকার। শচীন বন্দনায় মেতে উঠেন সবাই। ম্যাচের ফল নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেনি।
উত্তেজনায় থরথর ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল
কিন্তুু ভারত তো আর প্রকাশ্যে বলতে চাইবে না বাংলাদেশের সাথে খেলা আসলেই উত্তেজনাময়। ভারতের সব মিডিয়া আর ক্রিকেটবোদ্ধারা খেলা মাঠে গড়ানোর আগেই ভারতকে বিজয়ী ঘোষণা করে। বাংলাদেশ কিছুই করতে পারবে না, ভারত সেমিফাইনালে উঠার সহজ রাস্তা পেয়ে গেল-এসব বলতে লাগল। ভারত অবশ্যই বাংলাদেশ অপেক্ষা শক্তিশালী দল। কিন্তু বাংলাদেশ যে যথেষ্ট সমীহ জাগানো দল, ভারতের মিডিয়া সেটা জানলেও বাংলাদেশকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে।
এই কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচটি বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেটে নতুন অধ্যায় যোগ করে। তবে, সেটা মাঠের খেলার কারণে নয়, মাঠের খেলার বাইরের কারণে। মাঠের খেলার কারণ মানে? হয় ভারত জিতবে, নতুবা বাংলাদেশ। এটাই তো মাঠের খেলার ফলাফল। তবে মাঠের খেলার বাইরের কারণটা কি?
ভারত হচ্ছে ক্রিকেটের বাণিজ্যিক ফেবারিট। ক্রিকেট বিশ্বের অধিকাংশ রাজস্ব যোগান দেয় এই ভারত। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারত গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ায় ভীষণ ক্ষতি হয় আইসিসির। বাংলাদেশের সমর্থকরা হয়তো মানতে পারেনি-এটা গণতান্ত্রিক খেলা ফুটবল নয়, এটা অভিজাতদের মিলনতীর্থ ক্রিকেট। যে অভিজাতরা কখনই সবাইকে নিয়ে চলতে চায় না। ফুটবলে আমেরিকা কোনো ত্রুটি করলে তাকে সাথে সাথে বহিষ্কারের ক্ষমতা রাখে ফিফা। আর ক্রিকেটে ভারতের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া কোনো সিদ্ধান্তই নেয়া যায় না।
বাংলাদেশের সমর্থকদের ক্ষোভের প্রধান কারণ হচ্ছে-ভারত তো নিজের পারফরম্যান্স দিয়েই বাংলাদেশকে হারাতে পারতো। এভাবে নির্লজ্জ বাজে আম্পায়ারিং কেনো দেখতো হলো ক্রিকেট বিশ্বকে।
প্রায় এক লক্ষ দর্শক ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন মেলবোর্ন স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হলো ভারত-বাংলাদেশ। আগে ব্যাট করতে নামলো ভারত। ৭৯ রানে ২ উইকেট পড়ে যায়। ভারতের রান রেট একপর্যায়ে ওভারপিছু পাঁচ। শুষ্ক গলায় সৌরভ গাঙ্গুলী কমেন্ট্রি বক্সে বলে বলতে লাগলেন-২৫০ রানই যথেষ্ট বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জিততে হলে। তিন তিনটি বাজে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দেয়। সুরেশ রায়না যখন ১০ রানে ব্যাট করছিলেন, মাশরাফি নিখুঁতভাবে স্ট্যাম্প লক্ষ্য করে বল লাগল রায়নার পায়ে। আম্পায়ার আউট দিলেন না। সেই রায়না পরে করলেন ৬৫ রান।
দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি আরো বিতর্কিত। ৪০তম ওভারে রুবেলের বলে কটআউট হলে ডেঞ্জারাস রোহিত শর্মা। কী আশ্চর্য! আম্পায়ার নো বল ডাকলেন। রোহিত তখন ৯০ রানে ব্যাট করছিলেন। পরে ১৩৭ করে আউট হলেন। ভারতের রান দাঁড়ালো ৩০২।
বাংলাদেশ ব্যাট করার সময় মোহাম্মদউল্লাহকে আউট দেয়া হলো, যদিও তিনি আউট ছিলেন না। এটা ঠিক, বাংলাদেশ ইনিংসে কেউ ব্যাট হাতে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু আম্পায়ারদের মনে হয়েছিল তারা খেলা পরিচালনা করতে আসেনি, এসেছে ভারতকে যেকোনো মূল্যে জিতাতে। এরকম জয় অর্জনকে কালিমালিপ্ত করে।
ভারত যখন সেমিতে গেলো-পুরো বাংলাদেশে ভারতের আর একজনও সমর্থক রইলো না। অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে ভারত বিদায় নেওয়ায় উল্লাসধ্বনি শোনা যায় বাংলাদেশের সব প্রান্তে।
বাংলাদেশের বদলা:- বচ্চে অব বচ্চে নেহি রোহে
বিশ্বকাপের পরপরই ভারত বাংলাদেশে এক টেস্ট ও তিনটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে আসে। বৃষ্টির কারণে টেস্ট ড্র হয়। প্রথম দুই ম্যাচে হেরে বসে ভারত। বিস্ময়বালক মুস্তাফিজের আবির্ভাব হয়। রান নিতে গিয়ে ধোনির মতো একজন সিনিয়র খেলোয়ার যেভাবে মুস্তাফিজকে কনুই দিয়ে ধাক্কা মারেন, তা ছিলো খুবই নিন্দনীয়। ভারত শেষ ম্যাচ জিতলে ২-১ সিরিজ জিতে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ প্রমাণ করল বাংলাদেশ আর ক্রিকেটের বাচ্চা নয়, সে এখন তারুণ্যদীপ্ত টগবগে যুবক।
অপসাংবাদিকতা
দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক লিখে দিলো-বাংলাদেশকে গোনায়ই ধরছে না শেবাগ। কথাটা কি ঠিক? শেবাগ ভারতকে সেমিফাইনাল ও ফাইনাল খেলার জন্য অগ্রিম ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। এখন হাবিবুল বাশার যদি কলাম লিখে বাংলাদেশকে বলেন- ‘বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নিয়ে বাংলাদেশে আসবে,তাহলে কি অন্যদলকে না গোনা হয়ে গেল?’ বাংলাদেশের সবাই তো বলছেন, বাংলাদেশ ফাইনালে উঠুক, কাপ নিয়ে আসুক। তাতে কি অন্যদলকে অপমাণ করা হলো?
শেবাগের কথায় বাংলাদেশের নামগন্ধও নাই, তাহলে কীভাবে তিনি বাংলাদেশকে অপমাণ করলেন। এদিকে শেবাগের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করেছে ফেসবুকীয় জেহাদী গোষ্ঠী।
পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খানের নামে শতভাগ ভুয়া একটা খবর ভাইরাল হয়েছে। তিনি নাকি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সেমিফাইনালে উঠে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির মানসন্মান নষ্ট করেছে।’ লক্ষ্য করুণ, আগে পরে আর কোনো কথা নাই। গুজবসৃষ্টিকারীরা ইচ্ছেমতো কথা বানিয়ে ইমরান খানের নামে ছেড়ে দিয়েছে। অথচ ইমরান খান বাংলাদেশ তো দূরের কথা, নিজ দল পাকিস্তানকে নিয়ে পর্যন্ত কোনো কথা বলেননি। একশ্রেণির মিডিয়া আর সাংবাদিকেরা এসব বাজে খবর নিয়ে মাতাল বানায় মানুষকে।
দেখা যাচ্ছে- বাংলাদেশ ক্রিকেটে যতই উন্নতি করছে, এক শ্রেণির মিডিয়া ততই উগ্র দেশপ্রেমিক হয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশ মিডিয়া, ভারতীয় মিডিয়ার মতো আবেগ নিয়ে সুড়সুড়ি দেয়া শিখে যাচ্ছে বাংলাদেশি মিডিয়াও।
তাই তো বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীন সময়গুলোতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দেখা যায়, ঠান্ডা মাথার মানুষের কতো অভাব পৃথিবীতে। ভারতের লোকজন বাংলাদেশের মানুষকে ইচ্ছামতো গালি দেয়, আবার বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম, জাতপাত তুলে ভারতের লোকজনকে মনের মাধুরি মিশিয়ে গালি দিয়ে ঝাল মেটায়। এ গালিগালাজের খেলা শেষ হবে কবে কে জানে, সবে তো শুরু।
লেখক: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
মন্তব্য করুন