সব দোষ কি বৃষ্টির? আমাদের দায় নেই?
পাহাড়ে এমনিতেই কান্নার শেষ নেই। কিন্তু প্রকৃতি যা করল, তাতে মানুষ বোবা হয়ে গেছে। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে গোটা বাংলাদেশ। সাধারণ মানুষ মারা গেছেন, আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসার এবং জওয়ান। যে বৃষ্টি কারো জন্য কবিতা লেখার উপাদান নিয়ে আসে, সেই বৃষ্টি শত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। শুধু কি পাহাড়, নগরেও বৃষ্টি এসে কেড়ে নিয়েছে অনেক তাজা প্রাণ। এত বড় বিপর্যয়ের পরেও কি আমাদের হুশ হবে? সব দোষ কি প্রকৃতির? নাকি আমাদের লোভ, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা আর অদক্ষতার জন্য প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিচ্ছে?
ঢাকায় হয়ত মানুষ মারা যায়নি। কিন্তু নিম্নচাপের প্রভাবে ঢাকায় যে একদিন বৃষ্টি হল, তাতে ঢাকার রাস্তাঘাট ডুবে শেষ। এমনিতেই খানাখন্দকের শহর ঢাকা। জলাবদ্ধতা, নোংরা পানি, মশা, যানজট সব মিলে গত কয়েকদিন ধরে ঢাকা যেন নরকের রূপ নিয়েছিল। বৃষ্টি থাকলে হয় জলাবদ্ধতা, আর না থাকলে হয় ধুলাবালির সাগর। অন্যদিকে বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম নগরী যেন মানুষের জন্য মরনফাঁদে রূপ নেয়। বৃষ্টি হলে চট্টগ্রাম নগরীর বহু জায়গায় বুক সমান পানি জমে যায়। চট্টগ্রাম শহরের নিচে আছে সাগর, কর্ণফুলী নদী। এই শহরে এভাবে মানুষ পানি জমে মানুষ কষ্ট পাবে, সেটা মেনে নেয়া যায়না। তার উপর আছে অতিবৃষ্টিতে পাহাড় ধ্বসে গরীব মানুষের মৃত্যুর ঘটনা। কেন বারবার পাহাড়, বৃষ্টি আমাদের কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়ায়? মানুষের লোভ এখানে কতখানি দায়ী?
গত বছর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন,‘বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা নিরসন ও শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। আগামী বছরে দুই সমস্যার একটিও থাকবে না। ৩০ মে’র পর বর্ষা মৌসুমে গত বছরের মতো ঢাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হবে না’।
মন্ত্রী বলেছিলেন,‘ঢাকার অনেক খাল জবরদখল হয়েছিল। এ কারণে ঢাকার রাস্তার পানি স্বাভাবিকভাবে সরতে পারত না। ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতো। এ বছর আমরা জবরদখল হওয়া খালগুলোর অধিকাংশই দখলমুক্ত করেছি। বাকি খালগুলো এক বছরের মধ্যে দখলমুক্ত করা হবে। ফলে আগামী বছর আর জলাবদ্ধতা থাকবে না’।
ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পানির সংকট সম্পর্কে মন্ত্রী গত বছর আরও বলেছিলেন, ‘আমরা আন্ডার গ্রাউন্ড থেকে এত বেশি পানি ব্যবহার করে ফেলেছি যে, পানির লেভেল বিপদসীমার নিচে চলে গেছে। সারা দেশে একই অবস্থা। এর কারণ হচ্ছে আমরা ৭০ ভাগ পানি আন্ডার গ্রাউন্ড লেভেল থেকে সরবরাহ করি। আর ৩০ ভাগ পানি সারফেস ওয়াটার লেভেল থেকে সরবরাহ করি। ফলে পানির স্তর বিপদসীমার নিচে চলে গেছে। এই সিস্টেমকে রিভার্স করে দেয়া হবে। এখন থেকে ৭০ ভাগ পানি সারফেস ওয়াটার লেভেল থেকে সরবরাহ করা হবে। আর ৩০ ভাগ আন্ডার গ্রাউন্ড লেভেল থেকে সরবরাহ করা হবে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৮/১০ বছরের মধ্যে পানির স্তর আগের লেভেলে চলে আসবে। আর সুপেয় পানির সংকট থাকবে না’।
মন্ত্রী মহোদয়ের আশ্বাস বাণী আমাদেরকে আশান্বিত করেছিল কিন্তু একবছরে যে এই আশ্বাস পূরণ করা সম্ভব না, সেটি সুস্থ মস্তিষ্কের সকল মানুষই বুঝেন। আওয়ামী লীগ সরকার সারা দেশে গত আট বছরে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। ঢাকার মেয়রদ্বয় অনেক আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করছেন। অবিশ্বাস্য কিছু কাজ করে দেখিয়েছেন। এমন সব জায়গার ফুটপাত তারা ক্লিয়ার করে দেখিয়েছেন, যা এখনো বিশ্বাস হয়না। যেমন নিউমার্কেট এরিয়া। এই ভরা ঈদের মৌসুমেও ফুটপাত পরিষ্কার। কিন্তু ফুটপাত পরিষ্কার হলে কী হবে, জলাবদ্ধতা নিরসনের কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেনা কেউ। তবে এটা মানতে হবে, দুই বছরে দুই মেয়রের পক্ষে নানা প্রশাসনিক আর রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এর চেয়ে বেশী কিছু সম্ভব ছিল বলে আমি মনে করিনা। কিন্তু প্রশ্ন হল, মেয়রদ্বয় যেভাবে কাজ করছেন, তেমনটা কি চালিয়ে নিতে পারবেন? আর মেয়রদের ক্ষমতাই বা কতটুকু? প্রায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা আছে নগর ব্যবস্থাপনায়। আছে রাজউক, ওয়াসার মত প্রতিষ্ঠান। এরা মেয়র অফিসকে খুব বেশী একটা পাত্তা দেয়না। এরপরেও মেয়রদ্বয় তাদের আন্তরিকতা প্রমাণ করে চলেছেন। সামনের দিনগুলোতে এরা দুইজন আরও বেশী আন্তরিক হয়ে কাজ করবেন। অন্যদের মত তারাও টাকা কামাই করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবেন না বলে আমাদের বিশ্বাস। মানুষের ভালোবাসার দাম অনেক বেশী টাকার চেয়ে।
বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের মূল সমস্যা হল জলাবদ্ধতা আর পাহাড় ধ্বস। প্রতি বাজেটে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু জলাবদ্ধতা কমেনা, বরং প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। তাহলে এত টাকা যায় কোথায়? বৃষ্টি এসে নিশ্চয় টাকার বস্তাগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি। তাহলে জনগণের করের টাকা যায় কোথায়? সবাই জানে সমস্যা কোথায়, কিন্তু রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছেনা। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের খালগুলো দখল হয়ে আছে, নদীগুলো সরু হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রামের পুকুরগুলো ভরাট করে ফেলা হয়েছে। পুকুর, খাল ভরাট করে মানুষ সেখানে ভবন, বাড়ি বানাচ্ছে মানুষ। পাহাড় কাটা হচ্ছে নিয়মিত ভাবে। পাহাড় কাটে কারা? নিশ্চয় সমাজের রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা কাটে। প্রশাসন হয়ত মাঝে মাঝে লোকদেখানো ব্যবস্থা নেয়, কিন্তু প্রকৃত অপরাধীদেরকে ধরে শাস্তি দেয়া হয়না। কাটা সেই পাহাড়ের নিচে আবার জায়গা ভাড়া দেয় কারা? গরীব মানুষগুলো নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সেখানে বারবার আশ্রয় নেয় কেন? তাদের জন্য বিকল্প কিছু করা যায়না? এভাবে আমাদের স্বজন প্রতিবছর পাহাড় ধ্বসে মারা যাবে, সেটি মেনে নেয়া যায়না।
সমস্যা মনে হয় আমাদের মনে ও মগজে। আমাদের নিশ্চয় সততার ঘাটতি আছে, নিশ্চয় আমাদের কমিটমেন্ট এর অভাব আছে। দক্ষতার অভাব আছে বলবনা। কিন্তু দক্ষ মানুষগুলোকে আমরা হয়ত ব্যবহার করছিনা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব রাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ এবং জনপ্রশাসনের। আরও বড় কোনো বিপর্যয় আসার আগে আমাদের শতভাগ আন্তরিক হয়ে কাজ শুরু করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক
মন্তব্য করুন