পাহাড় ধসের চার কারণ
বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের পাহাড়গুলো টারশিয়ারি যুগের। হিমালয়ের সমসাময়িক এই পর্বতগুলো ভাজ শ্রেণির। তবে হিমালয়ের সাথে মূল পার্থক্য হল এখানকার ভূমির। হিমালয়ে যেমন বেশিরভাগ পাথুরে পাহাড় উল্টো এখানে বেশিরভাগ বেলে মাটি গঠিত।
বান্দরবানের রুমা, থানচির ভেতরে দিকে পাথরের পাহাড় এবং খাত আছে। কেউ সাঙ্গু বা রেমাক্রি খালের ছোট নুড়িগুলো খেয়াল করলে একটা জিনিস দেখতে পাবেন পানির প্রবাহ, তাপ এবং চাপে এই নুড়িগুলো ক্ষয় হয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। আর এটি চলমান প্রক্রিয়া এবং এটি প্রাকৃতিক। প্রকৃতি সময়ের সাথে কখনো ভেঙে এবং গঠিত হয়ে তার ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেই প্রাকৃতিক নিয়মের ভয়াবহ ব্যত্যয় ঘটেছে।
প্রথমত, আশির দশকের শুরুতে পার্বত্য এলাকায় ব্যাপকহারে অন্য এলাকা থেকে এনে বাঙালিদের বসতি স্থাপন করা হয়। যেহেতু পুরো এলাকাটি পাহাড়ি, তাই সেগুলো কেটেই বসতি নির্মাণ করা হয়েছে। বান্দরবান থেকে ৭৯ কিলোমিটার দূরে থানচিতে এতো পরিমাণ বাঙালি দেখে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন কি হারে অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছিল। আর প্রত্যন্ত রুমাও রীতিমতো লোকারণ্য। ওখানকার প্রতিটি বসতিই পাহাড় কেটে নির্মাণ করা।
দ্বিতীয়ত, গত ১৫ বছরে পার্বত্য এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হয়েছে। বগা লেক, থানচি, আলীকদম, সাজেক, বাঘাইছড়ির মত দুর্গম এলাকাতেও পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এই কষ্টসাধ্য কাজটি করেছে সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগ। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে দেশের পাহাড়ের ভূমি বিন্যাস, মাটি নিয়ে দীর্ঘ গবেষণায় ঘাটতি ছিল। কারণ বেশিরভাগ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে পাহাড় কেটে। আমি যখনই ওদিকে যাই তখনই দেখি সেনা সদস্যরা সড়ক মেরামত করছেন। কারণ, সামান্য বৃষ্টিতেই সড়কের পাশের পাহাড় ধসে পড়ে। সড়কে এপাশের খাদে সড়ক ধসে পড়ে।
দুই বছর আগে দেখলাম সড়ক ধস ঠেকাতে পিচের রাস্তার বদলে কংক্রিটের ঢালাই দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সেগুলোও দীর্ঘমেয়াদি হয়নি ওই নরম বেলে মাটি ও অতিবৃষ্টির কারণে। কোন পাহাড়ের চূড়া বা ঢাল যদি কোন একবার কাটা হয় তাহলে ওই পাহাড় বাঁচানো সম্ভব নয়। কাটা চূড়া বেয়ে বৃষ্টির পানি নেমে পাহাড়ের ভেতরটা ধীরে ধীরে নরম হয়ে পড়ে। এটা যে এক দিনে বা এক মৌসুমে হয়, তা না। বেশ কয়েক বছরে পাহাড়টির মাটিতে ক্ষয় হতে থাকে। বৃষ্টি হলেই সেগুলো ধসে পড়তে শুরু করে। আর প্রতিবছরই পার্বত্য এলকায় ভূমি ধসে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর খবর আমরা পাই।
তৃতীয়ত, পার্বত্য এলাকায় পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি। পানি প্রবাহও প্রকৃতি নিজের মত করে সাজিয়ে নেয়। কিন্তু সেতু, বাঁধ, সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টির উদাহরণ পার্বত্য এলাকায় অসংখ্য। কাপ্তাই লেক সবচে বড় উদাহরণ। ষাটের দশকে দেয়া বাঁধের ফলে রাঙ্গামাটির বিস্তীর্ণ এলাকা পানি নিচে তলিয়ে গেছে, যা ওই এলাকার ভূমি বিন্যাস, মাটির উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছে।
গত কয়েক বছরে সাঙ্গু, কর্ণফুলিসহ ওই এলাকার খালগুলোতে ছোট বড় অসংখ্য সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। যদিও আমি বিশেষজ্ঞ নই কিন্তু মনে হচ্ছে সমতলের কায়দায় অসংখ্য পিলার নিয়ে যেভাবে রুমা, থানচি সেতুসহ অন্যান্য সেতু নির্মাণ করা হয়েছে তা খরস্রোতা নদীগুলোর জন্য উপযোগী নয়। যার ফলে বর্ষার সময় নদীর স্রোত বাধাপ্রাপ্ত হয়। একারণে সেখানেও নদী ভাঙন হয়।
চতুর্থত, ব্যাপকহারে গাছ কাটার ফলে পার্বত্য এলাকা অদ্ভুত ন্যাড়া চেহারা নিয়েছে। আপনি আমার লেখা পড়ে হয়ত বিশ্বাস করবেন না যে পার্বত্য তিন জেলার দুটি সংরক্ষিত বন বাদে বাকি কয়েক হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় কয়টি ২০ বছরের পুরানো গাছ আছে। যা আছে তা আঙ্গুলের কড়ায় গুনতে পারবেন।
সাকা হাফংয়ের ঢালে নেপিউয়ের জঙ্গলে বেশ কিছু পুরানো বড় গাছ আছে। সেগুলো কয়দিন থাকবে বলা মুশকিল। কারণ, পাহাড়ে গাছ আর বাঁশের রমরমা ব্যবসা গড়ে উঠেছে। সেটার ভাগ কে পায় না?
তবে পাহাড়গুলো সবুজ দেখায় প্রচুর বৃষ্টির কারণে লতা গুল্ম আর ছোট প্রজাতির গাছ জন্মায় বলে। কিন্তু এসবের শেকড় মাটির খুব গভীরে যায় না। বড় গাছের শেকড় যেমন গভীরে গিয়ে মাটিকে আকড়ে থাকে। বড় গাছ কেটে ফেলার কারনে মাটির শক্তি কমে যাচ্ছে। ভূমি ধসের এটাও বড় কারণ।
প্রকৃতির অসীম ক্ষমতা। তাই প্রকৃতিকে ক্ষেপালে তারও নিশ্চয়ই রাগ আছে। সময়মতো সে দেখাবেই।
এখনো সময় আছে। প্রকৃতির উপর অত্যাচার বন্ধ করুন।
লেখক: সাংবাদিক, যমুনা টেলিভিশন
মন্তব্য করুন