কাতার-সৌদি দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ কোন পক্ষ নেবে?

ঢাকাটাইমস ডেস্ক
| আপডেট : ১৫ জুন ২০১৭, ১১:১৮ | প্রকাশিত : ১৫ জুন ২০১৭, ১১:১৪

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারের সঙ্গে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশরের বিচ্ছিন্ন সম্পর্ক এখনো জোড়া লাগেনি। কূটনৈতিকভাবে, বিশেষ করে জনশক্তি রপ্তানির কারণে এই সংকটে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের কূটনৈতিক সম্পর্ক বেশ দৃঢ়, অন্যদিকে কাতার ক্রমবর্ধমান জনশক্তির বাজার এবং জ্বালানী আমদানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এই অবস্থায় কাতার সংকটে কোন পক্ষ অবলম্বন করার জন্য কি বাংলাদেশের ওপর চাপ পড়বে? বাংলাদেশ কী অবস্থান নিতে পারে? এই নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে বছর দুয়েক আগে কাতারে গিয়েছিলেন সাইফুল ইসলাম সুজন। চাকুরীজীবী বাবার দুই ছেলের মধ্যে ছোট সুজন। চাকরিজীবী বাবা ঋণ করে কাতারে পাঠিয়েছেন ছেলেকে। সেই ঋণ এখনো শোধ হয়নি। এদিকে সম্প্রতি সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করায় শঙ্কা দানা বেঁধেছে তাদের মনে। যদিও এই সংকটের ফলে কাতারে বসবাসরত বাংলাদেশিদের কতটা সমস্যা হতে পারে তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। তবে উৎকণ্ঠা নিয়ে সারাক্ষণ খোঁজ-খবর রাখার চেষ্টা করছে পরিবারটি।

সুজনের বড় ভাই মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘দেশে ফিরে আসতে হলে সে কী করবে? দুই বছর ওখানে চলে গেছে। ঋণও এখনো শোধ হয়নি। একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে সময় কাটাতে হচ্ছে।’

কাতারের সঙ্গে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিশরের সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণাটা এসেছে অনেকটা আকস্মিক। আর এই উদ্যোগের পেছনে মূল ভূমিকা যে সৌদি আরবের সে ব্যাপারেও বিশ্লেষকরা নিশ্চিত।

সৌদির সঙ্গে কাতারের সম্পর্ক আগেও খারাপ হয়েছিল, কিন্তু এতটা কঠোর পদক্ষেপ অনেককেই হতবাক করে দিয়েছে। প্রাথমিক মধ্যস্থতার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে, ফলে সমস্যা দীর্ঘায়িত হবার আশঙ্কা বাড়ছে।

বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যের এই সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ বেশ সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই এগুচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন কথা বলছে না। কিন্তু সমস্যা যদি দীর্ঘায়িত হয়, তবে কি এমন নিশ্চুপ থাকা সম্ভব হবে? কূটনৈতিকভাবে চাপ যদি আসে, তবে সেটি সৌদি আরবের পক্ষ থেকেই আসার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু সৌদিরা কি এমন চাপ দিতে পারে?

সৌদি আরবে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোমেন চৌধুরী বলেন, ‘সৌদি আরবের পক্ষে অসম্ভব কিছুই না।’

তিনি জানান, ‘১৯৯১ সালে ইরাক যুদ্ধে সৌদি আরবে বিদেশি সৈন্যের উপস্থিতির ফলে সমালোচনা ঠেকাতে মুসলিম দেশগুলো থেকে সেনা এনেছিল সৌদি আরব। যার মধ্যে বাংলাদেশ থেকেও সেনারা গিয়েছিল। যদিও মূল ভূমিকায় ছিল পশ্চিমা সেনাবাহিনী। সেই যুদ্ধের সময় দ্বন্দ্বের জের ধরে ইয়েমেন এবং ফিলিস্তিনের মানুষদেরও ফেরত পাঠিয়েছিল সৌদি আরব। পশ্চিমা হস্তক্ষেপ এড়াতে জর্ডানের বাদশাহ এবং সাবেক ফিলিস্তিনী নেতা ইয়াসির আরাফাতের মধ্যস্থতার চেষ্টা পছন্দ না হওয়ায় তাদের প্রতিও কঠোর ভূমিকা নিয়েছিল সৌদি আরব। ফিলিস্তিনী নাগরিকদের ফিরিয়ে দিয়েছিল, ইয়েমেনের লাখ-লাখ লোককে চলে যেতে হয়েছিল। তারা যেটা চায় সেটাতে যদি কেউ বাধা দেয় বা তাদের মতের সাথে যদি না মেলে, তবে উল্টো ব্যবস্থা নিতে তারা কখনোই পিছপা হয় না।’

তিনি মনে করেন, “পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে নিজেদের দল ভারী করার জন্য সৌদি আরবের পক্ষে পুনরায় এধরণের পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব।”

তবে সেই পক্ষ অবলম্বন থেকে যতটা দূরে থাকা যায় সেটিই বাংলাদেশের জন্য ভালো বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এস এম আলী আশরাফ বলেন, ‘বাংলাদেশকে নিজেদের বাস্তবতা বিবেচনা করে নীতি গ্রহণ করতে হবে। এই দ্বন্দ্বে কোন অবস্থান না নেয়াটাই বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হবে। বাংলাদেশ বরং মধ্যস্থতার ভূমিকায় যেতে পারে।’

অধ্যাপক আশরাফ বলেন, ‘আমার মনে হয় না সৌদি আরব কোন পক্ষ নেয়ার জন্য বাংলাদেশকে চাপ দেবে। এই সংকটের কারণ অনেকটাই আবেগিক এবং সমস্যাও খুব বেশি দীর্ঘায়িত হবে না। এছাড়া কাতারের বিরুদ্ধে সৌদি আরব যেসব অভিযোগ তুলছে সেগুলোও ধোপে টিকবে না। একদিকে সন্ত্রাসবাদে সমর্থনের অভিযোগ দেয়া হচ্ছে কাতারের বিরুদ্ধে, আবার অন্যদিকে ইরানকে সমর্থনেরও অভিযোগ আসছে। এই দুই অভিযোগ পরস্পরবিরোধী- কারণ কাতারের বিরুদ্ধে যেসব সন্ত্রাসী দলকে সমর্থনের অভিযোগ করা হচ্ছে, তারাও ইরানের বিরুদ্ধেই লড়াই করছে। ফলে, এই যুক্তি পশ্চিমা দেশগুলো গ্রহণ করবে বলে মনে করা হচ্ছে না।’

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য দেশের সমর্থন সৌদি আরব পাবে কিনা সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমানের। তিনি বলেন, ‘যদি মুসলিম দেশগুলোর ওপর চাপ আসে, তবে বাংলাদেশ হয়তো সৌদি আরবের সঙ্গে যোগ দিতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশ সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের সদস্য। সেক্ষেত্রে সৌদি আরব যদি কোন সামরিক সিদ্ধান্ত নেয়, তবে বাংলাদেশের ওপরও একটি দায়িত্ব বর্তায়।’

যদিও বাংলাদেশ আগেই বলেছিল যে তারা কোন সামরিক সংঘাতে জড়াবে না, তবে কাতারের বিরুদ্ধে সৌদি আরব কোন সামরিক পদক্ষেপে গেলে বাংলাদেশের সৌদি পক্ষ অবলম্বন করার একটি সম্ভাবনা আছে বলে মনে করছেন অধ্যাপক রেহমান।

কাতার সংকট দীর্ঘায়িত হলে তা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের সঙ্গেও বাংলাদেশের সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে। যার মূল প্রভাবটি পড়বে জনশক্তি রপ্তানির ওপর। তিনি বলেন, যদি উত্তেজনা বাড়ে এবং পরিস্থিতি যুদ্ধের দিকে যায়, তাহলে জনশক্তি রপ্তানিতে একটি ভাটা পড়বে এবং রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যাবে। বাংলাদেশে রেমিটেন্স প্রবাহের প্রায় ২৯ শতাংশ সৌদি আরব থেকে আসে।

বাংলাদেশের প্রায় ২৫ লাখ মানুষ কাজ করছেন সৌদি আরবে। আর কাতারে রয়েছেন প্রায় চার লাখ বাংলাদেশি। তবে গত কয়েক বছরে কাতারে জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছে খুব দ্রুত হারে এবং ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলকে ঘিরে আরো অনেক বেশি জনশক্তি রপ্তানির সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। অধ্যাপক আশরাফ বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও মূল বিবেচনার বিষয় থাকবে জনশক্তি এবং জ্বালানি। শ্রমশক্তি, অর্থনৈতিক সহযোগীতা এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানির প্রবাহ ঠিক রাখাটাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান নিয়ামক হবে বলে তিনি মনে করছেন।

অধ্যাপক আশরাফ বলেন, ‘সমস্যাটি দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের উচিত হবে একটি বিচক্ষণ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা। সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সদস্য হিসেবে জোটের সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করা এর একটি উপায় হতে পারে।’

কাতার এবং আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর সংকটের বিষয়ে কোন বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকছে বাংলাদেশ। এবিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হলে, তিনি শুধুমাত্র জানান যে, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ অবহিত রয়েছে।

মোমেন চৌধুরী বলেন, কূটনৈতিক বিবেচনা থেকে বাংলাদেশ যতটা সম্ভব এই সংকট থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখবে। আমরা তাদের দ্বন্দ্ব নিরসনে যদি সাহায্য করতে পারি আমরা যাব, কিন্তু তাদের সেই আগুনে তেল ঢালবো না।

তবে চাপে পড়লে বাংলাদেশের অবস্থান কোন দিকে যাবে সেটিও স্পষ্ট বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, ‘আমাদের লোকজন সেখানে যায় এবং সেখান থেকে আমরা যে রেমিটেন্স পাই সেটাই আমাদের প্রয়োজন। কাতারের তুলনায় সৌদি আরব আমাদের অনেক বড় বাজার। দুইদিকে চিন্তা করলে আপনি কোনদিকে যাবেন সেটাতো বোঝাই যাচ্ছে।’

তারেক শামসুর রহমান বলেন, ‘কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের কাছে সৌদি আরবের গুরুত্ব বেশি থাকলেও, ভবিষ্যৎ জনশক্তি এবং জ্বালানির উৎস হিসেবে কাতারও আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কাতারের সঙ্গে ২০১৩ সালে এলএনজি (তরলীকৃত গ্যাস) আমদানির বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। এখন যদি বাংলাদেশ এই দ্বন্দ্বে সৌদি আরবের সাথে যুক্ত হয়, তবে সেই গ্যাস পাওয়া নিয়ে জটিলতা তৈরি হবে। ফলে ভবিষ্যতে জ্বালানি চাহিদার ওপর একটি চাপ তৈরি হতে পারে।’

সংশ্লিষ্ট দেশগুলো যাই বলুক না কেন, কাতারের সাম্প্রতিক সংকট বিশ্লেষকদের কাছে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। আর এই দ্বন্দ্ব যে আরো তীব্র হয়ে উঠতে পারে, সেই সম্ভাবনাও রয়েছে। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা একমত যে, নিজেদের স্বার্থে এই সংঘাত থেকে যতটা দুরে থাকা সম্ভব, তাই হয়তো থাকতে চাইবে বাংলাদেশ। তবে কতটা পারবে সেটিই এখন দেখার বিষয়।

(ঢাকাটাইমস/১৫জুন/জেএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ

দুবাই বিমানবন্দরে জলাবদ্ধতায় চরম বিশৃঙ্খলা, যাত্রীদের দুর্বিষহ অবস্থা

ইসরায়েলি হামলায় গাজা একটি ‘মানবিক নরকে’ পরিণত হয়েছে: গুতেরেস

ইরানের ওপর ফের যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞা

যে কারণে ৩০ এপ্রিলের আগে ইরানে হামলা চালাবে না ইসরায়েল

ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ২৮ কর্মীকে বরখাস্ত করলো গুগল

আমিরাতে বৃষ্টিপাত অব্যাহত, দুবাই বিমানবন্দরে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা

ভারতে প্রথম দফায় লোকসভা নির্বাচন শুরু শুক্রবার

ইরানের হাতে রাশিয়ার এসইউ-৩৫ যুদ্ধবিমান ও এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা!

নেসলের বেবিফুডে অতিরিক্ত চিনি  

ইসরায়েল আত্মরক্ষার জন্য সবকিছু করবে: নেতানিয়াহু 

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :