সেই সময় এই সময়-১

সবটুকুই সত্য

প্রকাশ | ১৭ জুন ২০১৭, ১৪:২৫ | আপডেট: ২১ জুন ২০১৭, ১৭:১১

আরিফুর রহমান দোলন

২০০০ সালের ডিসেম্বর মাস। আমি ‘প্রথম আলো’র একজন সংবাদকর্মী, স্টাফ রিপোর্টার। কলকাতা বিমানবন্দরে ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের সঙ্গে দেখা। আমাকে উনি চেনেন না। পরিচয় দিলাম। বললেন, তিনি বাংলা পড়তে পারেন না। তবে কিছুদিন ধরে ‘প্রথম আলো’র লক্ষ্মীপুর নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কিছু প্রতিবেদনের কথা ঘনিষ্ঠজনদের মুখে খুব শুনেছেন। এমনকি সম্পাদক মতিউর রহমানও নাকি তাঁকে বলেছেন, ওই ঘটনায় ‘প্রথম আলো’র সার্কুলেশন বেড়েছে। পত্রিকার সুনামও হয়েছে খুব। ধীর-স্থির লতিফুর রহমান বললেন, ‘ওয়েলডান ইয়াংম্যান। এভাবে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’ বললেন, তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার ভিসা নিতে নতুন দিল্লি যাবেন। কলকাতায় কিছু কাজও আছে। আমরা বিদায় নিলাম।

২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে ‘প্রথম আলো’র প্রথম পাতায় ‘ভয়াবহ আতঙ্কের শহর লক্ষ্মীপুর’ শিরোনামে লিড নিউজটি আমার ক্যারিয়ারেরই মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল বলা যায়। তৎকালীন পৌর মেয়র আবু তাহের ও তার বাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতন চরমে পৌঁছেছিল। সাবেক পিপি নুরুল ইসলাম অপহৃত হওয়ার পর জেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চেহারাটি প্রকাশ্যে উন্মোচিত হয় গণমাধ্যমে। এবং এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা ছিল ‘প্রথম আলো’র। ঢাকা থেকে আমি ও চট্টগ্রাম থেকে একরামুল হক বুলবুল গিয়েছিলাম লক্ষ্মীপুরে। গণমাধ্যমের জন্য লক্ষ্মীপুরের তখনকার পরিবেশ মোটেও সহায়ক ছিল না। সর্বত্রই আবু তাহেরের লোকজন। শহরে নতুন লোক এলে তাকে অনুসরণ করে তারা। মিডিয়াকর্মী হলে তো কথাই নেই। পুরোদস্তুর নজরদারিতে। তাহের ও তার বাহিনীর নেতিবাচক কর্মকা- নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কোনো খবর হওয়া চলবে না- রীতিমতো এই ফরমানও স্থানীয় সংবাদকর্মীদের দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে, বিশেষত ঢাকা থেকে আগতদের সাথে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে কেউই কথা বলতে চান না। খবর সংগ্রহ করা রীতিমতো দুরূহ এক ব্যাপার ওই সময়। কী করা যায়! মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে নানা রকম বুদ্ধি। সহকর্মী একরামুল হক বুলবুলকে বলি, আমি যা করব কোনো প্রশ্ন করবেন না। আমাকে অনুসরণ করবেন শুধু। বিনা বাক্য ব্যয়ে একরামুল হক বুলবুলও সেটি মেনে নিলেন।

ঠিক করলাম, তাহেরের আস্থা অর্জন করতে হবে। যদি শহরে ও শহরতলীতে অবাধে ঘোরাফেরা করতে হয় তাহলে আপাতত তাহেরের রোষানলে পড়া চলবে না। পৌর ভবনে দেখা করলাম তাহেরের সঙ্গে। তার সাংগঠনিক দক্ষতার প্রশংসা করলাম আমরা। জনপ্রিয়তা যে আকাশচুম্বী এটা নিজেই বললেন। আমরা জি জি করলাম। বিস্মিত হলাম যে কেন তাকে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। বললেন, ‘আপনারা পত্রিকার পাতায় তুলে ধরেন এসব। কেন্দ্রীয় নেতারা জানুক সব।’ বললাম লিখব, ছবি দেন। অফিস সহকারীকে হুকুম দিলেন ছবি দেওয়ার। মুহূর্তেই হাজির। আমাদের থাকার ব্যবস্থা করতে বললেন। রাজিও হলাম। শুধু শহর ঘুরে দেখার অনুমতি চাইলাম। কাজ হলো। তখনো তাহের বোঝেননি যে পরবর্তী সময়ে কী অপেক্ষা করছে।

প্রকৃত তথ্য জানা যাবে এমন কিছু ব্যক্তির নাম-ঠিকানা আগেই ছিল আমাদের কাছে। প্রবীণ একজন আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করলাম, যিনি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির একেবারে প্রথম কাতারের নেতা। নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেন এবং জানালেন কীভাবে লক্ষ্মীপুরের গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। কীভাবে প্রশাসনযন্ত্রও প্রকারান্তরে সহায়তা করছে তাহের বাহিনীকে। আরও কয়েকজন আইনজীবীর নাম-ঠিকানা দিয়ে বললেন, ‘সবার সাথে কথা বলেন। অনেক কিছু জানতে পারবেন।’ মধ্যবয়স্ক একজন আইনজীবী আমাদের নানা তথ্য দিলেন।

এভাবে তাহের বাহিনীর একের পর এক অপকর্মের তথ্য আমরা পেয়ে যাচ্ছি। ভেতরে ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনাও কাজ করছে। যেসব তথ্য পাচ্ছি তাতে সংবাদ লেখার উপাদান অনেক। কিন্তু প্রশাসনের বক্তব্য তো নিতে হবে। পুলিশ সুপার ইরফান আলী সব বিষয়েই নির্লিপ্ত এমন অভিযোগ বিভিন্ন পক্ষের। তাঁর কাছে গেলাম। ঠান্ডা মানুষ বলেই মনে হলো। কম কথা বলেন। জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর মুখ দিয়ে প্রয়োজনীয় কথা বের করা অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। চায়ের অর্ডার দিলেন। সাথে বিস্কুটও দিতে বললেন। নুরুল ইসলাম অপহরণ নিয়ে পুলিশ কী করছে? পুলিশ সুপারের উত্তর: পুলিশ তার কাজ করছে। সে তো নিশ্চয়ই। কিন্তু অপহৃতকে কি উদ্ধার করা গেল? আবারও এক কথার উত্তর: খুব শিগগিরই।

তবে আমাদের কাছে খবর, অপহরণের পরেই নুরুল ইসলামকে হত্যা করা হয়েছে। লাশও মেঘনায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ সুপারকে কোনো কিছু আর প্রশ্ন করিনি। শুধু বললাম, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আপনি কি সন্তুষ্ট?’ নিরুত্তর ইরফান আলী মৃদু হাসলেন। যা বোঝার আমরা বুঝে গেলাম। ইতোমধ্যে যেসব তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে এসেছে, তাতে অনায়াসেই ভালো খবর, বড় খবর দাঁড়িয়ে যায়।

কোথায় থাকব জানি না। কোথায় বসে লিখব তা-ও জানি না। আর যা-ই লিখি শহরে একটিমাত্র যে ফ্যাক্সের দোকান, সেখান থেকে ফ্যাক্স করে ঢাকা অফিসে খবর পাঠানো দুঃসাধ্য। সারাক্ষণ সেখানে পাহারায় থাকে তাহের বাহিনী। মোবাইল ফোনের সীমিত ব্যবহার তখন। আমাদের কারো কাছেই তা নেই। লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম ভয়ে আমাদের সাথে দেখা করেননি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। কী করব? কতক্ষণই বা আটকে রাখব পুলিশ সুপারকে। মাথায় বুদ্ধি এল। পুলিশ সুপার ইরফান আলী বিসিএস ’৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তা। একই ব্যাচের প্রভাবশালী পুলিশ সুপার মালিক খসরু পিপিএম-এর পরিচয় দিলাম। একই উপজেলায় ও কাছাকাছি বাড়ি হওয়ার সূত্রে আমরা যাকে চাচা বলে ডাকি। এই পরিচয় জানার পর লক্ষ্মীপুর পুলিশ সুপারের আন্তরিকতা বাড়ল। অনুমতি চাইলাম যে মালিক খসরুর সুবাদে আমি তাঁকে আঙ্কেল ডাকতে পারি কি না। আপত্তি করলেন না। বললাম, ‘আঙ্কেল, একটা ফেভার চাই। আপনার ফ্যাক্স ব্যবহার করা যাবে?’ কলিং বেল চাপলেন। দায়িত্বরত কনস্টেবল ও স্টেনোগ্রাফারকে বলে দিলেন, ‘ওনারা ফ্যাক্স করবেন। যত কপি খুশি। সব রকম সাহায্য যেন করে।’ পুলিশ সুপার সব ব্যবস্থা করে বাসায় গেলেন।

[দ্বিতীয় পর্বের জন্য চোখ রাখুন ঢাকাটাইমসে]

সেই সময় এই সময়-২

লেখক: সম্পাদক, ঢাকাটাইমস ও সাপ্তাহিক এই সময়