ঢাকার ট্রাফিক পুলিশের কষ্ট কি আমাদের স্পর্শ করে?
ঢাকা শহর হল স্বার্থপরের শহর। কে কার আগে যাবে, কে কার আগে রাস্তা পার হবে, কে কার আগে বাসে উঠবে এ নিয়েই চলে আমাদের নিত্যদিনের প্রতিযোগিতা। রাস্তার প্রতিযোগিতা বাসার লিফটেও প্রভাব ফেলেছে। কে আগে আসল, কে পরে আসল বালাই নেই, উঠতে পারলেই হল।
পবিত্র রোজার মাস চলছে। ২১ রোজা শেষ। দুপুর হলেই লাখ লাখ মানুষ রাস্তায়। ঘরে ফেরার তাড়া। রিকশা, প্রাইভেট কার, পাবলিক বাস মিলে রাস্তায় বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। ফুটপাত না পেয়ে রাস্তায় মানুষের ঢল। পুরান ঢাকা হলে ঠকঠক করে চলে ঘোড়ার গাড়িও। গরমে ঘামতে ঘামতে প্রতিদিন ঢাকায় চলাফেরা। এর মধ্যে যদি বৃষ্টি হয় তাহলেতো কষ্ট অন্যমাত্রা ধারণ করে। ঠাণ্ডা বাতাসে সামান্য আরাম বোধ হলেও অন্যান্য কষ্ট এই হঠাৎ পাওয়া আরামকেও হারাম করে দেয়। বাসের ভেতরে কাদা, বাইরে কাদা, ময়লা পানি, ডাস্টবিনের বাড়ন্ত পরিধি, খানাখন্দক, যানজট সব মিলে কষ্টের যেন শেষ নেই ঢাকার জীবনে। এর মধ্যে কিছু মানুষ তুলনামূলক আরামে চলাফেরা করে। শুধুমাত্র যানজটটুকু অন্য মানুষের সঙ্গে শেয়ার করতে বাধ্য হন ইনারা। যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি আছে তাদের কথা বলছি। যানজটে আটকা থাকলেও বাইরের ধুলাবালি, হট্টগোল, ময়লার গন্ধ, অন্য মানুষের ঘাম তাদের স্পর্শ করেনা। মাঝে মাঝে ভিক্ষুকরা ভিক্ষার আশায় এসব গাড়ির জানালায় নক করে আরোহীর মনোযোগ আকর্ষণ করে কখনো সফল হয়, কখনো ব্যর্থ। সেদিন দেখলাম একজন বদনকিতাবে লিখেছে, গাড়ির ভেতরে বসা এক ভদ্রলোক ভিক্ষা না দেয়ায়, এক ভিক্ষক বলছেন-‘ভিক্ষা দিতে পারেনা, আবার প্রাইভেট কার মারায়!!’।
এমনই ঢাকা শহর আমাদের। যিনি গাড়ি চালান, তিনি জানেন না, পথচারী কোনদিক দিয়ে রাস্তায় এসে পড়বে। আবার পথচারীও নিশ্চিত না যে গাড়ি শুধু একদিক দিয়েই আসবে! প্রায় দুই কোটি মানুষের শহর ঢাকা। এমন অরাজকতাপূর্ণ শহর বিশ্বে বেশি একটা আছে বলে আমার মনে হয়না। এরপরেও এই শহর চলছে। এখনো পরিত্যাক্ত হয়নি। এখনো আমরা অফিস করে ঘরে ফিরি। সবগুলো রাস্তায় সচল থাকে। ১০ মিনিটের রাস্তা হয়ত এক ঘণ্টা লাগে, কিন্তু জীবন এখানে থেমে নেই। এই অরাজকতার শহরকে যারা সচল রেখেছেন তাদের অগ্রভাগে থাকবেন আমাদের ট্রাফিক পুলিশ।
রোজার মাসে একটু ভাবুন এই ট্রাফিক পুলিশের কষ্ট কেমন হয়। সকাল থেকে গভীর রাত অবধি অবিরাম এই পুলিশ আমাদের সেবা দেয়। যারা জীবনে উন্নত বিশ্বে যাননি, তারা কল্পনাও করতে পারবেন না, আমাদের পুলিশ কী অসাধ্য সাধন করেন প্রতিদিন। ঢাকার জনসংখ্যা কত বড়, কারো কোনো ধারণা আছে? ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যার সমান। একটা অস্ট্রেলিয়া তিনটা ভারতের সমান। ঢাকায় থাকে প্রায় দুই কোটি মানুষ। আর অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা তিন কোটি আর আড়াই কোটির মাঝামাঝি। আমাদের ট্রাফিক সিস্টেম এখনো পুরোপুরি ম্যানুয়াল। ট্রাফিক পুলিশ যেভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি এক পাশের গাড়ি আটকিয়ে আরেক পাশ সচল রাখেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। তার উপর আছে আমাদের সিগন্যাল ভেঙ্গে আগে চলে যাওয়ার চিরাচরিত কুঅভ্যাস। ট্রাফিক পুলিশ যদি প্রকৃতির ডাকে বা জরুরি প্রয়োজনে একটু রাস্তা থেকে সরে যায় তাহলেই আমাদের আসল চেহারা বের হয়ে পড়ে। প্রাইভেট কার বলুন আর পাবলিক বাস, সব গাড়ির চালকদের একই চেহারা তখন দেখা যায়। মুহূর্তেই জ্যাম লাগিয়ে বসে থাকি আমরা। সবাই আগে যেতে চাই। এমনটা পৃথিবীর আর কোনো শহরে দেখা যায়না।
সম্প্রতি জলাবদ্ধতায় ট্রাফিক পুলিশের কষ্ট কেমন হয়েছে তা এ লেখার সঙ্গে যুক্ত ছবিটি দেখলেই যে কোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষের বোধগম্য হবে। চট্টগ্রামের বড়পুল মোড়ে কর্তব্যরত ট্রাফিক কনস্টেবল সিদ্দিকুর রহমান কোমর সমান পানিতে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন! এই ছবিটি ফেসবুকে শেয়ার করেছেন হাজার হাজার মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক-বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীদের ফেসবুক পেইজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারে ছবিটি শেয়ার করা হলে ছাত্র-ছাত্রীরা পুলিশের প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রদর্শন করেছে। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের ছাত্র শেখ লাবিব আহমেদ এই ট্রাফিক সদস্যের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পক্ষান্তরে, গত ২০ রোজার প্রতিটি ইফতারি সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে করেছে, সেটাও কিন্তু বিরল ছিল। ইফতারের আগে ঘরে ফেরা মানুষ যখন গাড়িতে বসে দৌড়ায়, তখন সে ভুলে যায় সে নিজেও রোজাদার। ইফতারের মেনু কি, আজান দিয়েছে কিনা, একটু পানি হবে কিনা- এসবের সে কিচ্ছু জানে না। তার বাসার কেউ ইফতার করতে তার জন্য অপেক্ষাও করে না। কারণ সে আসবে না। সে আসলে লক্ষ মানুষ আসবে না। সবাই রাস্তায় ইফতার করবে। তাই সে বিরল ছবির সাব্জেক্ট হয়ে রাস্তায় রয়ে যায়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই ট্রাফিক পুলিশের ইফতার করার দৃশ্য কেউ দেখেছেন? ৩০টি কষ্টের ইফতারি শেষে একটি ঈদ আসবে। অথচ সেই ঈদেও তার ছুটি হবে না। ছুটি না পাওয়া এই ট্রাফিক ঈদের জামাতে নামাজও পরতে পারবে না। কোন একটি ঈদ জামাতের পাশেই রাস্তার মোড়ে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাবে। হাত তুলে সে গাড়ি থামাচ্ছে, তার বগলের নীচে ছেড়া ইউনিফর্মের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একজন মানুষের দেহ। মানুষটির গায়ে ঈদের দিনেও সেই পুরান জামা?
ইফতার, ছুটি আর জামাত মিস করা এই পুলিশ কনস্টেবলের কথা আর কি বলব? কি বা চাইব? ইস্ত্রি করা একটি নতুন ইউনিফর্মই দিয়েন, যাতে কেউ দয়া করে এমন একটা ছবি তুলে ফেইসবুকে আপ দিলে অন্তত গ্রামে থাকা বড় মেয়েটা বলতে না পারে, "বাবা,আজ তুমি ঈদের দিনেও সেই ছেড়া ইউনিফর্মটাই পরেছ? একটা নতুন ইউনিফর্ম পরলে তোমাকে কত্ত ভাল লাগত, বাবা।" কত মানবিক একটা পেশা, অথচ মানুষ এদের ভাল ছবি না তুলে শুধু বাজে ছবি তুলে বাহবা নেয়। গোপন ক্যামেরার সর্বোচ্চ লেন্স শুধু খারাপকে ধারণ করার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে তা আমি মানি না, মানবও না’।
পুলিশের প্রতি আমাদের ভালোবাসা রইল। আশা করি রাষ্ট্র শহরের সিগন্যালিং সিস্টেম প্রযুক্তি নির্ভর করবে। বিশ্বের কোনো ট্রাফিক পুলিশ এত কষ্ট করেনা। শুধু পুলিশ দিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ হবেনা। আমাদের সকলকেই সভ্য হতে হবে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সবাই মিলে একদিন আমরা আধুনিক, সুন্দর ঢাকা গড়ে তুলব।
লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিক
মন্তব্য করুন