বাবা, তোমার জন্য এই লেখা...

রায়হান নিশু
 | প্রকাশিত : ১৮ জুন ২০১৭, ১৫:০৮

অনেক দিন তো হলো, তোমায় দেখি না। আর কত দিন! আমি ফাঁকি দেব তোমাকে। আর তুমি ফাঁকি দেবে আমাকে। এমন তো কথা ছিল না। যাওয়ার সময় আমায় তো কিছু বলেও যাওনি। ২০১০ সালের শুরুর প্রথম সাতটি দিন। আমার জন্য নিজেকে অপরাধী ভাবা যথেষ্ট নয়কি? তোমার জন্য আমি কোন সময় রাখিনি। রিহার্সেলে যেতাম খুব সকালে, ফিরতাম অনেক রাতে। রাতে ওষুধ নিয়ে আসতাম ঠিকই, কিন্তু ভয় করত, খুব ভয়। তোমাকে যেয়ে পাব তো? বাইরে থেকে সবাই আমার হাসিটা আর অভিনয়টা খুব উপভোগ করত। ভেতরটা দেখবার কেউ চেষ্টা করেনি। দরকারও নেই।

৬ তারিখ সকালে তোমার সাথে কথা বলে যাই। এরপর নাটকের শো-এর আগে তোমার সাথে আমার কথা হলো দুপুর ২টার পরে। তুমি কি বললা? আমার কষ্ট হচ্ছে। নাটকটি শেষ করেই বাসায় চলে এসো। কেন তুমি আমাকে বলোনি, তুমি এখনি বাসায় চলে এসো। কেন সারাটা জীবন জোড় খাটাওনি আমাদের উপর? কেন সবসময় আমাদের স্বার্থটাই দেখেছো বড় করে? আমরা তো তোমার স্বার্থ দেখিনি বাবা।

তোমার সাথে কথা বলেই আমি মোবাইলটা বন্ধ করে দিলাম। আমি জানতাম। তোমার কিছু হয়ে গেলেও আমার কিছুই করার নেই। কারণ এম এ পরীক্ষার্থীদের ফাইনাল নাটকের (অভিনয়ের) পরীক্ষা। সবাই প্রস্তুত। সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থী, দর্শক উপস্থিত। আর আমি সেখানে অতিথি অভিনেতা।

মঞ্চ আমার জন্য প্রস্তুত। বাবা, আমি ভুল করেও বুঝতে পারিনি, তুমি যে তোমার জন্য নতুন আরেকটি পৃথিবী তৈরি করছ। যেখানে তুমি চলে যাবে। নাটক শুরু হলো, শেষও হলো। সবার মধ্যেই উচ্ছ্বাস। আমি কাউকে না জানিয়েই চলে এলাম। মাঝ পথে তোমার জন্য ওষুধ নিয়ে বাসায়। পথ যেন ফুরাচ্ছিল না। যখন বাসায় পৌঁছালাম, ওহ!!! শান্তি!!! বাবা তুমি আছ। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে জানি। তবুও তো তুমি আছ। খেতে পারছ না কিছু। রাত হয়ে গেলো অনেক। আমার কাঁধে তোমার মাথা।

তোমাকে আমি বললাম যে, নাটক শেষ। এখন তোমাকে আমি আমার সব সময় দিব। তুমি কি বললে, কেন যে এত কষ্ট পাচ্ছি আর তোমাদেরকেও কষ্ট দিচ্ছি? আমি জানি, তুমি ঘুমাতে পারোনি সারারাত। আমার কিন্তু চোখ লেগে এসেছিল। ভোর হলো। ডাক্তার নিয়ে এলাম। ডাক্তার বললেন, ফেস্টুলা নষ্ট হয়ে গেছে। ডায়ালাইসিস করা যাবে না। তোমার প্রিয় বন্ধু বাসায় আসলেন। এত কিছুর মধ্যেও তুমি বলছ চাচার জন্য চেয়ারটা টেনে দিতে। সব দিকে এত খেয়াল তোমার? নিজের জন্য কখনো তো এত খেয়াল করোনি।

চাচাকে সাথে নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শে ঔষধ নিয়ে আসছিলাম। মোবাইলে আপুর চিৎকার তাড়াতাড়ি বাসায় আসার জন্য। বাবা কেমন করছে। বারবার মোবাইলের রিং টোন বেজে উঠছে। বাসায় গিয়ে...............। নাইবা লিখলাম এই অংশটুকু।

আমি জানি, এই অংশটুকু লিখলে তুমিও কষ্ট পাবে। অ্যাম্বুলেন্স এলো। হাসপাতালের বেডে তোমাকে রেখে কিছু টেস্ট করবার জন্য তাড়াহুড়া করে ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ফিরে আসার সময় আপুর স্বভাবসুলভ চোখের পানিসহ নাই রে আব্বা, চলে গেছে। ডাক্তার বলে দিয়েছে, নাই। শেষ।

স্ট্রেচারে তোমাকে নিয়ে এলাম হাসপাতালের শেষ সীমানায়। যেকোন একটি গাড়ি ভাড়া করতে হবে। চোখ থেকে অঝোরে পানি পড়ছিল। আর স্ট্রেচারে চাদরে ঢাকা তোমার সারা শরীরের অবয়ব দেখছিলাম। হাসপাতাল থেকে বাসা পর্যন্ত রিকশাভাড়া ১০ টাকা। এক মাইক্রোবাসের চালক এসে বললেন, আমি নিয়ে যাচ্ছি। ২০০০ টাকা দিলেই হবে। আমি অবাক। এত কেন? আমি তো বাবা সেদিনও তোমাকে রিকশা করে নিয়ে গেলাম। হাঁটা পথ। ভাড়া এত বেশি কেন।

আমি তখন ভুলেই গিয়েছিলাম, বাবা তুমি অন্য পৃথিবীতে চলে গেছো। তুমি আর ৮/১০ জনের মত জীবিত নও। তোমাকে আমরা এখন বোঝা মনে করছি। আমরা এতই বেশি নিষ্ঠুর যে কত তাড়াতাড়ি তোমাকে কবরে রেখে আসা যায় সেই আয়োজনেই ব্যস্ত। আমি জানি না কেন তোমাকে বাসায় নিয়ে আসার পর আমি আম্মার চোখের দিকে তাকাতে পারিনি। সব আয়োজন শেষ।

এবার তোমাকে তোমার ঘরে রেখে আসার পালা। শীতের রাত। অনেক হয়ে গেছে। তোমাকে রাখলাম কবরে। একবার দেখে নিয়ে মাটি দিতে শুরু করলাম। বিশ্বাস কর বাবা, একটি বারও যদি মনে হতো যে আর কখনো তোমাকে দেখতে পাব না। আমি আরও ভাল করে মন জুড়িয়ে দেখতাম। মাটি দেয়ার পর মনে হলো, এই যা, এ আমি কি করলাম!!! আর তো দেখতে পাব না তোমাকে। কেন আরও ভাল করে দেখলাম না? একটি অধ্যায় শেষ হলো।

তোমাকে সময় অনেক কম দিয়েছি বাবা। তোমার ইচ্ছে অনুযায়ী আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করো। সবার যোগ্যতাতো এক না। তবে তোমার একটা স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি। ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলাম। বাবা দিবস বলে না, যখনই কোন কাজে হোঁচট খাই, শুধু তোমাকেই সামনে দেখি।

তোমার সাথে সব ছবিগুলো আমার অনেক ছোট বেলার। অগোছালো। তুমি এখন থাকলে তোমার সাথে সুন্দর সুন্দর ছবিগুলো অন্তত তুলতে পারতাম। সেলফিও হয়ে যেতে পারত বাবা। তবে আমার যেখানে তুমি আছো, সেখান থেকে ছবি হয়তো আপলোড করতে পারব না জানি। কিন্তু সারা জীবনে নষ্ট হবে না।

আরও একটি ঈদ তোমায় ছাড়া। ঈদের মাঠে একা একা সঙ্গীহীন পথ চলা। শুধু তুমি নেই। জীবনে চলার পথে, বাবা, তোমাকে অনেক দরকার। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, ফিরে এসো বাবা, আমি বাসায় আছি। তোমার দড়জায় কড়া নাড়ার শব্দও যে আমার মুখস্ত। আমি সেই শব্দের প্রতিক্ষায় থাকি...!!!

লেখক: উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী

ই-মেইল: [email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :