আব্বাই শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা
আমার আব্বার ছোট বেলায় আদুরে কন্যাদের মত আব্বু ডাক শুনে মন চাইত। মনে হত, আব্বু ডাকটাই মর্যাদার আর অনেক ভালবাসার। যারা তাদের আব্বাকে আব্বু বলে ডাকত, ভাবতাম, তাদের ভালবাসা অনেক গভীর। তারা তাদের আব্বুকে যেমন জানপ্রাণ দিয়ে ভালবাসে তাদের আব্বুও তাদেরকে জানপ্রাণ দিয়ে ভালবাসে। কিন্তু আমার আব্বা হয়ত আমাকে তেমন ভালো বাসে না এটা মনে করতাম। আর আব্বা শব্দটাকে আনস্মার্ট মনে হতো। তাই সবার সামনে আব্বা ডাকতে লজ্জা পেতাম।
আব্বাকে আব্বু বলে ডাকতে মন আনচান করতো। কিন্তু আব্বার সামনে গেলে তখন আর বলতে পারতাম না। ইতস্ত করতাম, আর ভয়ও পেতাম ভীষণ।
এই আব্বু শব্দটা বলার জন্য ঘরে একা একা কত যে প্র্যাকটিস করেছি তার হিসাব নাই। কিন্তু তবুও আর আব্বু বলতে পারি নাই।
কারণ আমার আব্বা অনেক রাগী আর জেদী। তার রাগ সম্পর্কে এলাকার অনেকেরই ধারণা আছে। তাই অনেকে আব্বাকে বদরাগী বলেই মনে করত।
আব্বা সম্পর্কে মানুষের এই বদরাগী মানসিকতা আমার মাথায়ও আস্তে আস্তে ঢুকে গেল। প্রায়ই আব্বা কিছুতে কিছু কম পড়লেই রেগে যেতেন। আমাকে, ভাইয়াকে এমনকি মাকেও বকতেন।
অনেক মার খেয়েছি আব্বার হাতে। আমার সার্কেলে থাকা মানুষগুলো তার ১০০ ভাগের এক ভাগও খায়নি হয়ত।
আমি তখন ক্লাশ থ্রিতে পড়ি। আব্বা আমাকে কিছু পড়া পড়তে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেলেন। বিকালে বাসায় এসে আমার পড়া ধরলেন।
কিন্তু আমি কিছু পড়া বলতে পারলাম কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম না। আব্বা তখন রেগে গিয়ে দুই কানে ধরে চেয়ারের উপর একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। তাও আমার অপারেশনের ডান পায়ের উপর।
আমি ভয়ে ভয়ে তাই করলাম। আর চুপি চুপি দেখছিলাম দরজা, জানালার ফাঁক দিয়ে কেউ আমাকে দেখে ফেলে কি না। তাহলে তো আমার মান সম্মান কিছুই থাকবে না। কিন্তু আব্বা আমাকে এমন জায়গায় দাঁড় করালেন যেখানে কেউ আমাকে চাইলেও দেখতে পারবে না। এরপর আমাকে শাসিয়ে চলে গেলেন বাইরে।
আব্বা যেভাবে বলেছেন আমি সেভাবেই কান ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। আব্বা পা নামাতে নিষেধ করেছেন তাই পাও নামাইনি। ১০ মিনিট পর মা এসে বললেন, তুই কি বোকা নাকি? এখন কেন কান ধরে দাঁড়িয়ে আছিস? তোর আব্বা তো নাই এখানে। এখন পা নামা আবার যখন তোর আব্বা আসবে তখন পা উঠিয়ে দাঁড়িয়ে থাকিস।
কিন্তু আমি নামালাম না। উল্টো কেঁদে কেঁদে অভিযোগ দিয়ে বললাম, আমি তো পড়া একটা ভুলে গেছি, সব তো পেরেছি। তার জন্য আমাকে কান ধরে দাঁড় করাবে কেন? আব্বা ভালো না।’
এভাবে করতে করতে ২০ মিনিট পার হয়ে গেল। আমার পা ব্যাথা হয়ে গেছে, দাঁড়াতে পারছিলাম না, পড়ে যাচ্ছিলাম চেয়ার থেকে। তারপর অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে শেষ পর্যন্ত আমার পা নামালেন।
কিছুক্ষণ পর আব্বা ঘরে আসলেন, আমি মাটিতে বসে খেলছিলাম। আব্বাকে দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। কিন্তু আব্বা আমাকে দেখেও কিছু বললেন না!
এমন অনেক দিন গিয়েছে যখন আব্বা আমাকে ভীষণ বকেছেন। এমনকি বিকেলে খেলাধুলা করার সময় আমি কিংবা আমার ভাইয়ারা বাইরে খেলতে গেলে আব্বা তখন অফিস থেকে বাসায় ফিরে আমাদেরকে ঘরে না পেলে মাঠ থেকে ডেকে এনে বকাঝকা করতেন।
আর তখন খেলার মাঝখান থেকে প্রায়ই আব্বার কারণে চলে যেতে হতো বলে খেলার সাথীরা আমাকে খেলায় নিতে চাইত না। খেলতে গেলেই বলতো "তোরে খেলায় নিমু না, তোর আব্বায় তোরে নিয়া যায়, যা ঘরে থাক।"
আশপাশের সমবয়সী মেয়েরা পুতুল খেলতো, জোলাভাতি (চড়ুইভাতি) খেলতো। আর আব্বা আমাকে সেখানে কখনোই খেলতে দিতেন না। নিষেধ করে দিয়েছেন এগুলো খেলতে।
তাই রাগ হতো আব্বার উপর। আব্বা আমাকে ভালবাসেন না। আব্বা ভালো না।
অভিযোগ করতাম, ওদের বাবা ওদের পুতুল খেলতে দেয় আমাকে কেন দেয় না?
তাই এই আব্বার বিরুদ্ধে আমি অনেক কথা বলেছি আমার বন্ধু বান্ধবীদের কাছে।
আমার আব্বা আমাকে ভালবাসেন না। বদরাগী। আমাকে বকে মারে, অনেক কনজারভেটিভ। নারীদের মূল্যায়ন করে না, আমাকে পড়াতে চান না, কাজ করতে দিতে চান না ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু যেই বাবা সত্যিই এমন কিছু করতেন, যেটা সবার অসহ্য লাগতো, সেই বাবা যদি আমার ছোট বেলায় অফিস থেকে আসার সময় আঙ্গুর কিংবা আনার কিনে আনেন, বিস্কুট কিনে আনেন, আর রাত ১২ টায় যখন আমরা তিন ভাই বোন ঘুমিয়ে পড়তাম তখন আমাদেরকে টেনে তুলে কোলে নিয়ে জোড় করে সেগুলো খাওয়ান, তাহলে সেটাকে কি বলা যায়?
যদি সেই বাবা, বাইরে কারো সাথে খেলতে না দিয়ে নিজে ক্রিকেট ব্যাট হাতে আমার সাথে খেলেন, পুতুল খেলতে না দিয়ে যদি নিজে আমার সাথে দাবা খেলেন, ব্যাডমিন্টন, কেরাম, লুডু, সাত গুটি খেলেন, রাত জেগে ছড়া শোনান, ভুতের গল্প শুনিয়ে 'তোর পেছনে ভূত' বলে ভয় দেখান আবার হাসতে হাসতে কোলে তুলে নেন, কখনো সাঁতার শেখান, বড়শি কিংবা ঠেলা জাল দিয়ে মাছ ধরা শেখান, কাগজ দিয়ে ফুল, ফল, নৌকা বানানো শেখান, গাছে চড়া শেখান, তখন তাকে কি বলবো?
যখন কোন অন্যায় করি বা না করি, রাগের মাথায় আমাকে ঘর থেকে বের করে দেন, আবার পরক্ষণেই আদর করে বলেন, ‘মা, আর বকব না, আয় ঘরে আয়, তুই আমার কইলজার টুকরা’, তখন সেই মানুষটাকে কী বলবো? খারাপ মানুষ? বদ রাগী?
যখন রাগে আব্বা ঘর থেকে বের করে দেন, তখন প্রতিবেশী কেউ তো এক গ্লাস পনি খেতে ডাকেনি?
যখন শত অন্যায় করার পরও বাবা বুকে টেনে নিয়ে বলেন, ‘মাপ করে দে লক্ষ্মী মা, আর তোকে বকব না, কই শ্বশুর বাড়ির লোকজন তো এ কথা বলে না?’।
বরং সামান্য কোন ভুলও ক্ষমা না করে স্বামী বলে তিন তালাক, শ্বশুর-শাশুড়ি বলে এ অলক্ষ্মী, একে রাখা সম্ভব না? আর বন্ধু বান্ধব কিংবা প্রেমিক বলে, তুই-ই ভালো না!
হ্যাঁ, হতে পারে আমার আব্বা রাগী, কিন্তু মুখে খাবারটা তিনিই তুলে দিয়েছেন। বাইরে বের করে দিলেও বুকে তিনিই তুলে নিয়েছেন। মেরে কুটি কুটি করলেও তিনিই আবার ওষুধ খাইয়েছেন। পড়া না পারার কারণে কান ধরে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখলেও এক কোণায় রেখেছেন, যাকে যাতে কেউ দেখে না ফেলে আর আমি লজ্জায় না পড়ি। শাস্তি দিয়ে সামনে বসে না থেকে বাইরে বের হয়ে গেছেন যাতে পা নীচে নামিয়ে আরাম করতে পারি।
নিজে সময় দিয়ে সব শিখিয়েছেন, যাতে আমি তার অভাব বুঝতে না পারি, পুতুল খেলতে না দিয়ে নিজে আমার সাথে খেলেছেন দাবা, ব্যাডমিন্টন কিংবা কেরাম, যাতে একটা গন্ডিতে না থেকে বিশ্বকে চিনতে পারি, প্রতিযোগী বিশ্বে টিকে থাকতে পারি।
তার শাসন যেটাকে একসময় নির্যাতন মনে করতাম, আজ এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছি যে, এখন মানতে বাধ্য হচ্ছি যে, আব্বার সেসব বাঁধা নিষেধ, শাসনই ছিল আমার সামনে এগুনোর পথে তার আশীর্বাদ। সেগুলোই ছিল আমার প্রতি তার সর্বোচ্চ ভালবাসা। যা আমাকে সঠিক পথ দেখাতে সাহায্য করেছে।
আমাদের সমস্যা আসলে আমরা মানুষের ইতিবাচক দিকগুলোর নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করি। অথচ সেই দিকগুলো নিয়ে চিন্তা করলে আমরা কত ভালো থাকতে পারি। তাই যখন বুঝলাম, তখন থেকে আমার কাছে আব্বাই আমার শ্রেষ্ঠ ভালবাসা। আব্বু কিংবা আব্বা ডাকে নয়, ভালবাসা তার অন্তরে।
দীর্ঘায়ু কামনা করে বাবা দিবসে তাই আমার আব্বার প্রতি রইল অনেক অনেক শ্রদ্ধা আর ভালবাসা।
লেখক: সাংবাদিক
মন্তব্য করুন