যুদ্ধজয়ী বাবার গল্প

প্রকাশ | ১৮ জুন ২০১৭, ১৭:৫১

মনদীপ ঘরাই

খুব ছোট আমি তখন। বয়স তিন কিংবা চার হবে। অফিস থেকে বাবা ফিরলে চুপটি করে তার জুতোটা নিজে পরতাম। নিজের পায়ের কাছে দানবাকৃতির সে জুতো সামলানোই বড় কষ্ট ছিল। তারপরেও পরতাম। এ ছিল এক অসাধারণ আবেগের অভ্যাস।

আরেকটু যখন বড় হলাম, শুনতাম নির্বাচন, নির্বাচন। বাসার নষ্ট ফ্রিজ এর ভেজিটেবল বক্সকে ব্যালট বানিয়ে বাবার মত নির্বাচনের ডিউটি করতাম। আর ভোটার হতো আমাদের বাসার নিকটবর্তী বস্তির আমার বয়সী খেলার সাথীরা। এর উদ্যোক্তাও বাবা। বলতেন, ওদের সাথে খেলে জীবন কি সেটা শিখতে হবে।
কিছুদিন পর খেলার বিষয় গেল পাল্টে। খেলাটা এবার অফিস অফিস খেলা। বাবার মতো অফিসার সাজতাম। কেউ হত সিএ, কেউ পিয়ন। তবে সবসময় আমি অফিসার ছিলাম না। পিয়নও হতে হতো, সিএর দায়িত্বও পালন করেছি।

এসব বলছি কেন তা বিস্তারিত বলব একটু পরে। এবার যাকে উৎসর্গ করে এই লেখা, তার কথা বলি। বাবা। আমার বাবা। বীর মুক্তিযোদ্ধা রণজিত কুমার ঘরাই। খুব জানতে ইচ্ছে করে পরোলকগত পিতামহীর কাছে, কি বুঝে এত যথার্থ নাম রেখেছিলন ছেলের! “রণজিত” (যুদ্ধকে জয় করেছে যে)। সাহসী যোদ্ধা রণজিত ১৯৭১ সালে সম্মুখযুদ্ধ করেছিলেন ৯ নং সেক্টরে। সুন্দরবন এলাকায়।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ১১ ভাইবোনের পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে ঝাঁপিয়ে পড়েন জীবনযুদ্ধে। বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ থানায় দিনরাত খেটে গড়ে তোলেন ছোট্ট খাবার হোটেল ‘বঙ্গবন্ধু চা বাসর’। সকাল থেকে রাত খাটুনি, তার পাশাপাশি পড়াশোনা। 
ডিগ্রি পাস করতেও সংগ্রাম। সে বছর পুরো উপজেলায় পাস করেছিলেন মাত্র দুজন। তার একজন আমার বাবা। তারপর অনেকটা নাটকীয়ভাবেই পুলিশ সার্ভিসে। দারোগার চাকরিটা করতে করতেই বিসিএস পরীক্ষার আবেদন করলেন। ফলাফল- বিসিএস প্রশাসনে অন্তর্ভুক্তি। ১৯৭৩ সালের ব্যাচে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান। এরপর রণজিত ঘরাই ছিলেন প্রশাসন ক্যাডারে সাহসিকতার আইকন। কোমরে লাইন্সেস করা রিভলবার আর বুকে অসীম সাহস। এ নিয়েই লড়ে গেছেন সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তার অধিক্ষেত্রে পরীক্ষার হলকে নকলমুক্ত করেছিলেন সে আমলেই। তার মধ্যে অন্যতম ছিল যশোরের অভয়নগর উপজেলা। জায়গার নামটা মনে রাখবেন। পরে কিছু সংযোগ আছে বৈ কি! ভোলার মনপুরা উপজেলার প্রথম টিএনও ছিলেন বাবা। দুর্যোগ মোকাবেলায় রেখেছিলেন অসামান্য অবদান। সে টান থেকেই হয়ত মনপুরা দ্বীপের নামে আমার নাম রেখেছিলেন মনদীপ। জানি দীপ এ ব ফলাটা নেই। সেজন্যই হয়ত মনের আলো ছড়াবার একটা সুযোগও পেয়েছি নাম থেকে।
এরপর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করে সরকারের উপ-সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরে যাওয়ার পরও নিজের জীবনযাত্রাটা বেছে নিয়েছেন নিজের মত করেই। আমার মা’র নামে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জের ছোট্ট গ্রাম বলভদ্রপুরে গড়ে তুলেছেন “বাসন্তী মৎস ও কৃষি খামার”। নিজের হাতে সাজিয়ে তুলেছেন পুরো জায়গাটাকে। ছোট ৯ ভাইবোনকে মানুষ করেছেন। দুই সন্তানকে গড়ে তুলেছেন বিসিএস ক্যাডার হিসেবে।
ছেলেবেলায় বাবার জুতো পায়ে দেয়া ছোট্ট আমি সময়ের আবর্তনে যোগদান করেছি সেই প্রশাসন ক্যডারেই, ২০১৩ সালে। বাবার অফিস করা দেখে অফিস অফিস খেলা রূপ নিয়েছে বাস্তবে।

তবে, জীবন চমকে দেয়। দিতেই থাকে। কিছুক্ষণ আগে একটা জায়গার নাম বলেছিলাম, মনে আছে? যশোরের অভয়নগর। ১৯৮৮-৮৯ সালে বাবা এই উপজেলায় ছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে। দাপটের সাথে লড়ে গেছেন অন্যায় ও পরীক্ষার নকলের বিরুদ্ধে।
ঠিক ২৮ বছর। সময়ের কাটা এনে দাঁড় করালো অন্যরকম পুনরাবৃত্তির সামনে। মার্চে সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে যোগদান করেছি শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত যশোরের অভয়নগর উপজেলায়। আরও অবাক করা ঘটনা হল, ইউএনও স্যার বহিঃবাংলাদেশ ছুটিতে থাকায় গত দেড়মাস ধরে বসছি বাবার আসনে, উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে।

এ এক অন্যরকম অনুভূতি। শৈশবের বাবার জুতো পরার আবেগ। অফিস অফিস খেলার অনুভূতি। বোঝানো যাবে না। চোখ বোঝে। তাই প্রতিক্রিয়া জানাতে একদম দেরি করেনি।
বাবার অর্জন পাহাড়সম। সে পাহাড়ে চড়তে চাই না। চাই পর্বতসম অর্জনকে কুর্নিশ করে বাবার সুনামটা ধরে রাখতে। চেষ্টা করছি অবিরাম। নিজের মত করে।
সম্পদের প্রাচুর্য নেই আমার বাবার। তবে আছে আকাশছোঁয়া সাহস আর আত্মবিশ্বাস। বাবাকে কখনও ঘাবড়াতে দেখিনি। বিচলিত হতে দেখিনি কঠিন বিপদের ক্ষণেও। ছোটবেলা থেকে খুব ভয় পেতাম। শ্রদ্ধাও করতাম খুব। কোনোদিন বলা হয়নি ‘তোমাকে খুব বেশি ভালবাসি বাবা। বাবা দিবসে তোমাকে প্রণাম।’

লেখক: অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত), যশোর