বাবা তখন ৫,৬৮০ টাকা বেতন পেতেন

প্রকাশ | ১৮ জুন ২০১৭, ২২:০৬

জিয়া হক

স্কুল লাইফে প্রতিবেশী মনির আমাদের ঘরে ঢুকে আমাকে বেশ কয়েকটি থাপ্পর দিলো। ব্যাথায় চিৎকার করছি। কান্না শুনে বাইরে থেকে ঘরে আসলেন আমার বাবা। এতক্ষণে মনির পালিয়ে গেছে। বাবা আমাকে ধমকালেন। বললেন, ‘তুমি অন্যায় না করলে মনির তোমাকে কেন মারবে? খবরদার— মারামরি করবে না কখনো’।

আমি মনিরকে কিছুই বলিনি। তবে মনির আমাকে কেন মারল সেটাও বুঝতে পারিনি। মনির আমার ছোট। ওকে তো আমি মারতে পারি না! তবুও বাবা বললেন মারামারি! আমি বলছি, ‘আমি ওকে না মারলে কীভাবে মারামারি হয়’? মা আমাকে বোঝালেন…।

এমন অনেক অনেক ঘটনা আছে বাবার। আমরা কোনো অন্যায় না করলেও বাবা বলতেন, ‘তোমরা ওখানে না গেলে তো ঝামেলা হতো না। কেন গেলে’? বাবার এই স্বভাব নিয়ে বাবার ওপর বড় বোনেরা রাগ করতেন। মেঝ আপা বলতেন, ‘আব্বা হুদাই আমাগো দোষ দ্যায়’।

এসব কারণেই হয়তো কখনো কারো গায়ে হাত দেয়নি। কাউকে রাগ করেছি বলেও মনে পড়ে না। বাবা বলতেন, ‘তুমি ভালো হলে সবাই তোমাকে ভালোবাসবে। তুমি তো খারাপ হতে পারো না’।

গ্রামে বড় হয়েছি। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা খেলার মাঠেও টুকটাক ঝগড়া করে। ব্যাট-বল নিয়ে হাতাহাতি হয় মাঝেমাঝে। বাবার ভয়ে কারো মার খেলেও তাকে কিছু বলতাম না। বাবা যেন কোনোভাবেই না জানেন সেই চেষ্টাও করতাম আপ্রাণ।

মিরজারচর সিনিয়র (এইচএসসি) মাদরাসায় অধ্যক্ষ ছিলেন বাবা। মনে পড়ে— বাবা তখন ৫,৬৮০ টাকা বেতন পেতেন। আমরা চার ভাই বাড়ির বাইরে লেখাপড়া করি। আমাদের মাসিক খরচ দিয়ে বাবার হাতখরচও থাকতো না। বাড়িতে বাজার করতে পারতেন না। জমির ফসল বিক্রি করে পুরো মাস চলতেন। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার বলতে যা বোঝায়, আমরা তেমনি ছিলাম। তবুও বাবাকে কখনো অন্যায়ের আশ্রয় নিতে দেখিনি। বাসায় ডেকে, জোড় করে কত ছাত্রকে যে সম্পূর্ণ ফ্রি রেজিস্ট্রেশন করে দিয়েছেন তা গুণে শেষ করা যাবে না। এই সময়ে তা অবাস্তব এবং অসম্ভব।

সম্পূর্ণ বৈধভাবেই আর্থিক উন্নতির অনেক সুযোগ পেয়েছেন বাবা। কিন্তু কোনো দিন সেই সুযোগ নেননি। নেয়ার চিন্তাও করেননি। এইজন্য বাবাকে অনেকেই বোঝাতেন। কটূ কথা বলতেন। শেষ জীবনে এসেও ওসবের জন্য বাবাকে একমুহূর্ত আফসোস করতে দেখিনি।

এখন বুঝি, বাবাই সঠিক পথে ছিলেন। তা না হলে এত অল্প বেতনে, ১০০% সৎভাবে জীবন-যাপন করে চারটা ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনে সাহায্য করতে পারতেন না।

বাবা এখনো বলেন, ‘তুমি সৎ থাকলে তুমি ভালো থাকবে’। বহমান এই নষ্ট সময়ে সৎ থাকাটা বড় কঠিন। তবে অসম্ভব নয়।

লেখকঃ তরুণ সাংবাদিক