ভারত-পাকিস্তান নিয়ে আমরা কেন ঝগড়া করব

শেখ আদনান ফাহাদ
| আপডেট : ২০ জুন ২০১৭, ১৬:১৬ | প্রকাশিত : ২০ জুন ২০১৭, ১৬:১৪

ক্রিকেট খেলল পাকিস্তান আর ভারত। মাঠে ভালো খেলে জিতল পাকিস্তান, খারাপ খেলায় পরাজিত হয়েছে ভারত। পাকিস্তান বিজয়ের ট্রফি নিয়ে, ভারত পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে যার যার দেশে ফিরে গেছে। ভারত-পাকিস্তান খেলা শেষ। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য! আমাদের যুদ্ধ শেষ হচ্ছে না। ভারত-পাকিস্তান খেলা নিয়ে ফেসবুকে চলছে ভয়াবহ বাক্য ও ছবি যুদ্ধ। কেন হবে এমন? স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ৫০ বছর হতে চলল। এখনো কেন আমরা শতভাগ বাংলাদেশি বাঙালি হয়ে উঠতে পারব না? এখনো কেন নিজ দেশের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে শুধু বাংলাদেশকে আমরা ভালোবাসতে পারব না? সমস্যা কোথায়?

১৮৫৭ সালের ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সিপাহি-জনতার সম্মিলিত স্বাধীনতা যুদ্ধ সফল হলে তখনই আমরা স্বাধীনতার স্বাদ পেতাম। তৎকালীন পূর্ববঙ্গে বাঙালি মুসলমান হাবিলদার রজব আলী ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর তাঁর সাথী সিপাহীদের নিয়ে চট্টগ্রাম সেনা ছাউনি ত্যাগ করে একের পর এক ট্রেজারি কব্জা করে, জেলখানায় আটক বন্দীদের মুক্ত এবং ব্রিটিশদের অস্ত্রাগারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সীতাকুণ্ড ও পার্বত্য চট্টগ্রাম দিয়ে আগরতলা যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ত্রিপুরার তৎকালীন রাজা ইংরেজ পক্ষ অবলম্বন করলে আমাদের বীরযোদ্ধারা সিঙ্গারবিল হয়ে মনিপুর গমন করেন। সেখানে যাত্রাপথে সিলেটের লাতু এলাকায় ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। সেখানে ইংরেজ সেনাপতি আর, বি বায়ঙ নিহত হন (বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ইতিহাস ও সংবাদপত্র, ইমরান জাহান, পৃষ্ঠা-৩, বাংলা একাডেমি, ২০০৭-২০০৮)। কিন্তু সিলেট থেকে প্রেরিত বাড়তি ইংরেজ সৈন্যের সঙ্গে আর পেরে ওঠেননি বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার রজব আলী ও তার সাথীরা।

যদি রজব আলীরা সেদিন সফল হতেন তাহলে ১৮৫৭ সালেই আমরা স্বাধীন হই। ১৯৪৭ সালে আমরা প্রথমবারের মত ভারত থেকে স্বাধীন হলাম। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ আন্দোলনের উপর সওয়ারি হয়ে আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ অন্তর্ভুক্ত হলাম। পাকিস্তান আন্দোলন অনিবার্য করে তুলেছিল ব্রিটিশ শাসক এবং তাদের ঘনিষ্ঠ হিন্দু জমিদার শ্রেণি। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থটি পড়লে পাকিস্তান আন্দোলনের পটভূমি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

যদিও মুসলিম লীগের তৎকালীন প্রগতিশীল অংশের নেতৃবৃন্দ কলকাতা, দার্জিলিং, আসামের কাছাড়, করিমগঞ্জ, আর বর্তমান বাংলাদেশের ভূখণ্ড নিয়ে বাঙালিদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের সাম্প্রদায়িক হিন্দু এলিট শ্রেণি আর পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক মুসলিম এলিট শ্রেণি দিল্লিতে গোপন মিটিং করে রেডক্লিফ কমিশনের যোগসাজশে আমাদের কলকাতা, দার্জিলিং, কাছাড়, করিমগঞ্জ ছেড়ে দিয়ে ভারত, পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র জন্ম দেয়। যারা একথাগুলো শুনে চমকে উঠছেন তাদেরকে বলব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি ভালো করে পড়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু (তৎকালীন মুজিব) নিজ লেখায় দুঃখ করে বলেছেন, তাদেরকে জানানোই হয়নি যে, দিল্লিতে এমন একটা মিটিং করে নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী ভারতবর্ষ ভাগ করা হচ্ছে! কলকাতার দাবি কোনোভাবেই ছাড়তে চাচ্ছিলেন না মুসলমানরা। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের জন্য ভাবতে বয়েই গেছে পাকিস্তানের মুসলিম লীগ লিডারদের। স্বার্থান্বেষী জিন্নাহ-নাজিমুদ্দিনরা ইন্ডিয়ার কাছে কলকাতাকে ছেড়ে দিলেন। কলকাতা পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলে পাকিস্তানের অন্যান্য শহর করাচি, লাহোর গুরুত্ব হারাবে, তাই। অন্যদিকে ইন্ডিয়ার হিন্দু এলিটরা কলকাতা ছাড়লেন না। কলকাতা ছিল ব্রিটিশ আমলের রাজধানী, কলকাতা ছেড়ে দিলে তাদের আর থাকে কী? ১৯০৫ এ যারা ‘বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ’ বলে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন দিলেন, তারাই আবার ১৯৪৭ সালে আমাদের সঙ্গে থাকতে চাইলেন না।

বলাবাহুল্য ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি হলেও দুটি পর্বেই পশ্চিমবঙ্গীয়রা অর্থনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক কারণে আমাদের অবস্থানের বিরোধিতা করল। যে ইতিহাস বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের অনেক ছেলে-মেয়ে জানেনই না। বলা উচিত, জানতে দেয়া হয়না। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার, তৎকালীন তরুণ মুজিব এবং অন্যান্য প্রগতিশীল মুসলিম লীগ নেতারা এদেশের হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষজনকে কখনোই আলাদা করে দেখেননি এবং সচেতনভাবে সকলের ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার করেছেন এবং প্রকাশ্যে কাজও করেছেন। পাকিস্তান আমলে বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে বাঙালি হিন্দুদের সমস্যা যতখানি হয়েছে তার চেয়ে অনেকবেশি হয়েছে বিহারি মুসলমানদের সঙ্গে। পাকিস্তানি আর বিহারি মুসলিমদের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানদের যে কত বড় গৌরবময় পার্থক্য রয়েছে সেটি আমরা পরবর্তীতে ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৯ এবং ১৯৭১ সালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনসমূহে দেখেছি।

যাইহোক, ভারত-পাকিস্তানের ঝানু রাজনীতিবিদের কাছে যৌথভাবে ধোঁকা খেয়ে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তি আমাদের পূর্বপুরুষরা মেনে নিলেও পাকিস্তানের সঙ্গে সংসার যে টিকবেনা, তা লেখক-সাহিত্যিক এবং সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, গবেষকরা ১৯৪৭ সালের শুরু থেকেই বলেছেন। সাংবাদিক আব্দুল হক, ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ এনামুল হক, বহু ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তানিদের নাক উঁচু ভাব এবং বৈষম্যমূলক আচরণের ফলে পাকিস্তান যে টিকবেনা সে ভবিষ্যৎবাণী তারা বহুবার করেছেন। এরপরের ইতিহাস আমাদের সকলের জানা। পাকিস্তানি শাসকরা রাষ্ট্রগঠনের দিকে মনোযোগ দিলেন, কিন্তু জাতিগঠন প্রক্রিয়া বন্ধ রাখলেন কিংবা পাঞ্জাবি বাদে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে অবজ্ঞা প্রদর্শন করলেন। পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশ হয়েও মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে অবহেলিত হয়ে, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়ে বাঙালিরা বুঝে যায় এবং সিদ্ধান্ত নেয় এই পাকিস্তানের সঙ্গে আর থাকা যাবে না। সেই অনুধাবনই পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাস্তবায়িত হয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালির উপর গণহত্যা শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে ফরজ করে তোলে।

পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র বিপ্লবে ভারতের সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা থেকে বাঁচতে কোটি বাঙালি ভারতের আগরতলা, আসাম, মেঘালয়, কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে গিয়ে অস্ত্র ও যুদ্ধ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ভারতের হাজারের বেশি সৈন্য আমাদের স্বাধীনতার জন্য জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছেন। এজন্য আমরা ভারতের কাছে সে সময়ের জন্য আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। সে সময়ের কৃতজ্ঞতার জন্য সারাজীবন গোলাম হয়ে থাকতে হবে? এটিই হল বর্তমানে এদেশের অধিকাংশ ছেলে-মেয়ের প্রশ্ন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা, এদেশের ছোট একটি অংশের বেঈমানি এবং রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস এর মতো বর্বর বাহিনী গঠন, ভারতের সহযোগিতা ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করেই বদনকিতাবের ভারত-পাকিস্তান কেন্দ্রিক ঝগড়া ঘুরপাক খাচ্ছে। একদল ভারত বলতে অজ্ঞান, আরেকদল ভারত বিষয়ে ভয়াবহ বিদ্বেষ প্রকাশ করছে। এবং এই সুযোগে এই দুই চরমপন্থি অংশটি সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু এবং মুসলমানকে নিজেদের দলে টানার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। এদের মধ্যে এমনও আছে যে, ভারত-বাংলাদেশ খেলায় ভারতকে সাপোর্ট করবে বলে বদনকিতাবে পোস্ট দিচ্ছে। আরেকদল ভারতের বিরোধিতা করতে গিয়ে বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের মধ্যে পার্থক্য ভুলে যাচ্ছে। এই দুইদলের একটাও একজন সাচ্ছা বাংলাদেশি বাঙালির কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

খেলা হয় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে, ঝগড়া করছে আমাদের ছেলে-মেয়েরা। ভারতের পরাজয়ে এদেশের মুসলমানদের বা ভারতের মুসলমানদের কোনো দায় নাই। কিন্তু এদেশে কেউ কেউ আছেন, ভারত হেরে গেছে বলে পুরো মুসলমান সমাজকে গালিগালাজ করছেন। এই সামান্য কয়েকজন চরমপন্থি ভুলে যাচ্ছেন যে, এদেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাঙালি মুসলমান সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। অন্যদিকে ভারতের পরাজয়ের খুশিতে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে এদেশের মুসলমানদের একটা অংশ ‘পাকিস্তান’ বলে স্লোগান দিতেও লজ্জা পাচ্ছেনা। এখানেই আমাদের সমস্যা নিহিত। এই দেশদ্রোহী হিন্দু এবং মুসলমানের অংশটি সংখ্যায় খুব কম, কিন্তু শোর তুলতে উস্তাদ। তবে এ কথা সত্য যে সেদিন ভারত-পাকিস্তান খেলায় ভারতের পরাজয় কামনা করেছে, এমন বাংলাদেশির সংখ্যাই বেশি। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেদিন অধিকাংশ মানুষ ভারতের পরাজয় কামনা করেছে, কারণ ভারত এর আগে সেমিফাইনালে আমাদেরকে হারিয়ে দিয়েছিল। এবং ম্যাচ চলাকালীন বিরাট কোহলির অশালীনভাবে জিহ্বা বের করে দিয়ে উদ্ধত আচরণের জন্য আমাদের দেশের মানুষের মেজাজ খারাপ ছিল। কিন্তু ভারতের পরাজয় কামনা করা আর পাকিস্তানের বিজয় কামনা করা এক বিষয় নয়।

অনেকে ফেসবুকে লিখেছে, ভারতের পরাজয়ে অনেক খুশি, কিন্তু খুশি প্রকাশ করতে বিব্রত হচ্ছেন। কারণ পাকিস্তান প্রতিপক্ষ। আমি নিজে লিখেছি, শত্রুর কাছে আমাদের বন্ধুর পরাজয়! ভারতের অনেক হিন্দু বন্ধুবান্ধব পাকিস্তানের ভালো খেলার প্রশংসা করে বদনকিতাবে পোস্ট দিয়েছে। কিন্তু হিন্দু ধর্মের বলে তাদেরকে রাজাকার বলার কোনো সুযোগ নাই। কিন্তু বাংলাদেশের যারা নিছক খেলার নামে পাকিস্তানের ভালো খেলার প্রশংসা করেছে সবাই রাজাকার বলে গালি খেয়েছে।

ভারত ইস্যুতে ন্যায্য কথা বললে আমাদের কিছু কিছু মানুষ পাকিস্তান ইস্যু নিয়ে আসে। পাকিস্তানকে আমরা তালাক দিয়েছি সেই ১৯৭১ সালে। এখন ২০১৭ সাল। এই সময় ভারত যদি আমাদের নদীর পানি না দেয়, শেওয়াগ যদি আমাদেরকে অপমান করে কথা বলে, সীমান্তে যদি ফেলানির মত কাউকে গুলি করে মারে তাহলে কি আমরা কথা বলতে পারব না? যাইহোক, দেশকে ভালোবেসে কাজ করে যাওয়ার লোকই বাংলাদেশে বেশি। এজন্যই বাংলাদেশ এখন সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির মানদণ্ডে বিশ্বের ৩২তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। দেশে লুটেরা আছে, বিদেশে অর্থসম্পদ পাচারকারী আছে এবং এখানেও আমরা হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন করতে পারি। এতকিছুর পরেও আমরা রাষ্ট্র হিসেবে বেশ ভালো করছি। আমাদের এই অগ্রযাত্রায় সামান্য সংখ্যক মুসলিম এবং হিন্দু রাষ্ট্রদ্রোহীকে হয় ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে অথবা শোধন প্রক্রিয়ার মধ্যে আনতে হবে।

লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :