ঐ চাঁদ তোমার আমার

মোহাম্মদ অয়েজুল হক
 | প্রকাশিত : ২২ জুন ২০১৭, ২০:১৫

ঈদের চাঁদ ছোট। চাঁদ ছোট হলে হবে কী! ছোট দেখে বড় আনন্দ পাওয়া যায়। যার ইয়ে আছে তার তো আনন্দের কোনো সীমা নেই। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, সুনামগঞ্জ থেকে সুন্দরবন তার আনন্দ বাংলাদেশময় বিস্তৃত। মনের মাঝে আনন্দের টর্নেডো, ঘূর্ণিঝড়। আনন্দের ঝড়োবাতাসে প্রেমিক বেচারাদের পকেটের টাকা ঈদ মার্কেটেই উড়ে যায়। তাতে কি প্রিয়ার খিঃ খিঃ ঘিঃ ঘিঃ মার্কা হৃদয় ছ্যাদা করা হাসি লাখ টাকার চাইতেও দামি। ঈদের মাঠে অসহায় মানুষের জন্য, মসজিদের উন্নয়নের জন্য অনেক সময় টাকা তোলা হয়।

প্রেমিক বেচারাগুলো পকেটে টাকা চেপে রাখে, পকেটে তার প্রিয়া। টাকা না থাকলে প্রিয়া থাকে না। দুনিয়া-আখেরাত গোল্লায় যাক আগে প্রিয়ার সখ আহ্লাদ। অসহায় না খেয়ে মরুক তাতে কী! ইয়ের জন্য চাই দামি নেকলেস। ঈদের এক বছর আগে থেকে প্রোগ্রাম সেট। চাইনিজ দিয়ে শুরু আমেরিকা দিয়ে শেষ। মাঝখানে মধুমিতায় একটা সিনেমা, ফ্যান্টাসি কিংডমটা একটু পরির্দশন, নন্দন পার্কে চন্দন গাছের চেয়ারে বসে ঘণ্টাখানেক হাওয়া গেলা তারপর নভোথিয়েটার এই সব আর কী!

ঈদের দিন কোনো রকম নামাজ শেষ করেই একটা সিগারেট জ্বালায় মারুফ। বুকের ভেতর খুশি, একবার নামে আবার ওঠে। সকাল সকালই আসার কথা মেয়েটার। মিতা। ওর সাথে পরিচয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত শুধু ভালো আর ভালো লেগেছে মেয়েটাকে। ওর কথা ওর আচরণ…। সিগারেটটা পুরোপুরি শেষ হয় না, মিতা এসে হাজির হয়। লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পরেছে। লাল রংটা আবার মারুফের অসহ্য। আজকাল লাল রং দেখলে চমকে ওঠে। মনে হয় মিয়ানমার, সিরিয়া, ফিলিস্তিন অথবা ইরাকিদের বুকঝরা তাজা রক্ত। চোখের পাতায় ভেসে ওঠে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর তথাকথিত সন্ত্রাস দমনের চিত্র। অসহায় মানুষ হত্যার হোলিখেলা।

‘ঐ রিকাশা যাবে?’একটা রিকশা দেখে হাক দেয় মারুফ। ড্রাইভার দু’জনের একদম সামনে এসে ব্রেক করে। দু’জনকে ভালো করে দেখে। ‘ কই যাইবেন?’

‘ চলো যে দিকে চোখ যায়।’

‘সে কী কথা!’ রিকশা ড্রাইভার অবাক হয়। ঈদের দিন কথা না বাড়িয়ে রিকশায় চেয়ে বসে মারুফ। ‘ওঠো মিতা।’

রিকশা ড্রাইভারও আর কথা বাড়ায় না। জায়গায় জায়গায় গরু জবাই হচ্ছে। ‘খুব গোশত খাওয়া হবে তাই না মিতা? আমি গোশত খাবো, তুমি গোশত খাবে।’

‘ হু’ মিতা ঘাড় নাড়ে।

দিনটা কেমন যেন দ্রুত শেষ হয়, সন্ধ্যা নামে। পকেটের অবস্থাও করুণ। চাইনিজ শেষ করে কেবল রাস্তায় নেমে দাঁড়িয়েছে এমন সময় সামনে এসে দাঁড়ায় এক তরুণ। ‘ ‘হাই মিতা।’

‘হাই।’ মিতা পরিচয় করিয়ে দেয় ‘আমার খালাতো ভাই রঞ্জন।’

‘ও আচ্ছা, গুড।’

‘তুমি কি এখন বাড়ি যাবে?’ মিতার প্রশ্ন শুনে মারুফ অবাক হয়।

‘কেন?’

‘আমি এখন রঞ্জনের সাথে একটু বেরুবো।’

বুকের ভেতর অনেক চাপা কথা, মারুফ নিরুত্তর। নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। মিতা চলে যাই।

মারুফের সামনে-পেছনে, বামে-ডানে আরও কতো কপোত-কপোতি। মারুফ মিয়া এখন কপোতিহীন। বিদ্রোহী হয়ে উঠতে ইচ্ছা করে ওর।

ইচ্ছা করে কবিতা আওড়াতে-

নির্লজ্জ বেহায়া নারীর উল্লাস

যুগ যুগ ধরে ছলনাময়ী নারীর প্রতারণা

আর কতোকাল সইবো

সইতে পারি না… না না না….।

মারুফের পিঠে কারও হাতের আলতো স্পর্শ অনুভব করে। ‘কিরে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত পা ছুড়ছিস কেন?’ মারুফকে রাস্তার মাঝখান থেকে টেনে একপাশে সরিয়ে আনে মনির হোসেন। বন্ধু মানুষ।

‘সামনে ট্রাফিক হবো প্র্যাকটিস করছি।’

‘গুড, নিয়মিত প্র্যাকটিস কর। ’

‘মনির মন খারাপ।’ ব্যাথা ঝরে মারুফের কণ্ঠে।

‘কেন কী হয়েছে! ঈদের দিন আবার মন খারাপ কেন?’

‘মিতা একটা প্রতারক। আমাকে ফতুর করে খালাতো ভাইয়ের সাথে ভেগেছে।’

‘হা হা হা….’ গগন বিদারী চিৎকার করে হাসে মনির। বেশ কিছুক্ষণ চলে ওর হাসি। তারপর হাসি থামিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, ‘পাপের পথে সুখ নেই রে বন্ধু।’

‘আজ জানলাম।’

‘গুড।’

‘মারুফ, পরে কথা হবে, আমি একটা জরুরি কাজে যাচ্ছি।’

‘আল্লাহ হাফেজ।’

মনির আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে এক সময় চোখের আড়ালে চলে যায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ঢাকা শহরের রোড লাইটগুলো শহরটাকে আলোকিত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। পথ ধরে হাঁটতে থাকে মারুফ। রাস্তার পাশে একটা ছোট শিশু, কাঁদছে। পাঁচ-ছয় বছর বয়স হতে পারে। দূরে নোংরা কাপড়ে ফুটপাতে বসে আছে এক মহিলা। সম্ভবত শিশুটির মা। মারুফ ছেলেটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, ‘কিরে কাঁদছিস কেন?’

‘মা খালি মারে, টেকা দেয় না। দুপুরে কিচ্ছু খাইনি।’

ঈদের দিন কিছু খায়নি! মারুফের বুকের ভেতর কষ্ট হয়। পকেটের ভেতর হাত ঢোকায়। একশ টাকা অবশিষ্ট আছে। বের করে ছেলেটির হাতে দেয়, ‘নে ভাত কিনে খা গে।’

ছেলেটি হাত বাড়িয়ে টাকাটা নেয়। ওর চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। ‘খুশি হয়েছিস?’

‘হ, খুব খুশি হইছি স্যার।’

আকাশে ঈদের চিকন চাঁদ। মারুফ ছেলেটির হাত ধরে, ‘আয় একসাথে গান গাই।’

‘কী গান গামু স্যার!’

‘চাঁদ দেখেছিস, ঈদের চাঁদ?’

‘হ, ঐ তো আকাশে।’

‘ঐ চাঁদ ওঠে সবার মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। ধনী-গরিব সবার। আয় এক সাথে হাসি।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :