দেশ-বিদেশে বগুড়ার জালিটুপি

প্রতীক ওমর, বগুড়া থেকে
 | প্রকাশিত : ২৩ জুন ২০১৭, ১১:২০

উত্তরাঞ্চলের রাজধানীখ্যাত বগুড়া অনেক কারণেই বিখ্যাত। দই, মিষ্টির পাশাপাশি কৃষি যন্ত্রপতি, মাঠে উৎপাদিত কাঁচামাল যেমন দেশব্যাপী বিখ্যাত হয়েছে তেমনি সাম্প্রতিক সময়ে হস্তশিল্পের কারুকার্যও প্রশংসা কুড়িয়েছে। বগুড়া শহর এবং এর আশেপাশের গ্রামগঞ্জের অনেক পরিবার তাদের উপার্জনের প্রধান পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন হস্তশিল্পকে। এখানকার গালিচা, শাড়ি, বিছানার চাদর, টি-শার্ট এর পাশাপাশি নান্দনিক জালিটুপি সবার নজর কারতে সক্ষম হয়েছে। সরকারের সহযোগিতা পেলে এ শিল্পকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারবেন বলে কারীগররা জানান।

ঈদকে সামনে রেখে টুপির এই কারিগররা সারা বছর ধরে বুননের কাজ করে থাকেন। মুসলিম সম্প্রদায় দুই উৎসবে বাহারী পাঞ্জাবির সাথে নান্দনিক টুপির ব্যবহার হয়ে আসছে যুগযুগ ধরে। সংগত কারণেই এর চাহিদা কখনই কমে না। ঈদ ছাড়াও মুসলমানরা ধর্মীয় উৎসব গুলোতে টুপির ব্যবহার করে থাকেন।

শুধু তাই নয়, এখানকার কারিগরদের তৈরি টুপি দেশের গ-ি ছাড়িয়ে জায়গা করে নিয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। এক সময়ের ফেরি করে বিক্রি হওয়া এ টুপি এখন বিক্রি হচ্ছে দেশ-বিদেশের বড় বড় মার্কেটে।

চীন এবং পাকিস্তানের তৈরি টুপির মাঝে আলাদা আসন করে নিয়েছে বগুড়ার টুপি। গ্রামের নারীদের তৈরি নান্দনিক এ টুপি এখন ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের শহরগুলোতে ঝড় তুলতে সক্ষম হয়েছে।

জানা গেছে, ১৯৯০ সালের প্রথম দিকে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার চকধলি গ্রামের কয়েকজন নারী টুপি তৈরির উদ্যোগ নেন। শেফালি বেগম তাদের অন্যতম একজন। এ দলের নারীরা টুপি তৈরিতে সফল হওয়ার পর আশেপাশের গ্রামের নারীরাও আস্তে আস্তে এ শিল্পের সাথে জড়িয়ে পড়েন। যদিও টুপি তৈরির শুরু কোন গ্রামে তা নিয়ে ভিন্ন মত আছে। কারো মতে বাণিজ্যিকভাবে প্রথমে শেরপুর উপজেলার কল্যাণী গ্রামের নারীরা টুপি তৈরি শুরু করেন। তবে যে গ্রামই প্রথমে কাজটি শুরু করুক না কেন বগুড়ার প্রায় সবকটি উপজেলায় এ শিল্প এখন লাভজনক হয়ে উঠেছে। কর্মসংস্থান হয়েছে ৩ লক্ষাধিক নারীর। এসব নারীরা সংসারের অন্যান্য কাজের ফাঁকে টুপি বুননের কাজ করে থাকেন। একাজ করে অনেক অসচ্ছল পরিবার অর্থনৈতিক ভাবে সচ্ছল হয়েছেন।

জড়িপে দেখা গেছে এ পেশার সাথে জড়িতদের শতকরা ৯৫ ভাগ নারী। এসব নারীদের কোনো একাডেমিক প্রশিক্ষণ নেই।

অত্যাধুনিক কম্পিউটারাইজড মেশিনে তৈরি চীনা টুপি অনেক বেশি হলেও শিল্প শৈলী আর গুণগত কারণে হাতের তৈরি টুপিই সেরা। এ জন্য ক্রেতাদের নিকট বাংলাদেশের টুপির আলাদা কদর রয়েছে। চাহিদাও আছে অনেক। এর মধ্যে বগুড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলার নারী কারিগরদের ক্রুশকাঠিতে গড়া টুপির কদর সবচেয়ে বেশি।

বাংলাদেশ জালিটুপি অ্যাসোসিয়েনের সভাপতি ও জুয়েল ক্যাপ ডিপোর মালিক জুয়েল আকন্দ ঢাকাটাইমসকে জানান, জেলায় এই শিল্প এখনো কুটির শিল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেও সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে টুপি শিল্পের বেশ উন্নতি ও প্রসার ঘটেছে সাম্প্রতিক সময়ে। সৌদি, কুয়েত, দুবাই, পাকিস্তান, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের লাখ লাখ টুপি। তিনি আরো জানান, এখানকার জালিটুপি বছরে ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকা বিক্রি হয়।

দেশ এবং আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার ওপর নির্ভর করে বগুড়া-চট্টগ্রাম ও ঢাকায় গড়ে ওঠা টুপি শিল্পে প্রায় ছয় লাখ নারী শ্রমিক কর্মরত আছেন। সাম্প্রতিক উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য জেলাতেও এ শিল্পের প্রভাব পড়েছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, নওগাঁ, দিনাজপুর, এবং সর্ব উত্তরের তেঁতুলিয়ার নারীরাও টুপি তৈরির কাজে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছেন। বগুড়া জেলার শেরপুর, শাজাহানপুর, বগুড়া সদর উপজেলা আর রাজধানীর তাঁতী বাজারের টুপি ব্যবসায়ীরা শেরপুর-ধুনটের টুপিকে কেন্দ্রকরে জমজমাট ব্যবসা করে যাচ্ছেন। এসব টুপি রাজধানীসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং রপ্তানি হয় অন্যান্য মুসলিম প্রধান দেশেও।

উদ্যোক্তারা জানান, বগুড়ার গ্রামাঞ্চল থেকে প্রতিটি টুপি ৩০-৬০ টাকা দরে কিনে ঢাকায় ৫০-১২০ টাকায় বিক্রি করেন। নারী হস্তর্শিল্পিদের তৈরি এসব টুপির নাম করণ করা হয়েছে বিভিন্নভাবে। যেমন-আনারস টুপি, গাছফুল টুপি, মাকড়সা টুপি, বিস্কুট টুপি, পাঁচ পয়সা এবং কদম ফুল টুপি উল্লেখ যোগ্য।

নাম এবং কোয়ালিটি ভেদে এসব টুপি বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়ে থাকে। টুপি তৈরির সঙ্গে জড়িত নারী কারিগররা জানান, দেশের বাইরে এ টুপির চাহিদা প্রচুর। টুপির ডিজাইনের ওপর উন্নত প্রশিক্ষণ নিতে পারলে আরো আকর্ষণীয় আর মনোরম ডিজাইনের টুপি বানাতে পারবেন তারা। এর ফলে রপ্তানি আরো বাড়ত এবং দামও ভালো পাওয়া যেত। কিন্তু এদিকে সরকারের দৃষ্টি নেই বলে অভিযোগ তাদের।

এ শিল্পের সাথে জড়িতরা জানান, এক সময় তারা ক্রুশকাঠি ও সুতা কিনে টুপি সেলাই করে বিচ্ছিন্নভাবে বিক্রি করতেন। এজন্য খুব একটা ভালো দাম পেতেন না। এখন তারা সমিতির মাধ্যমে টুপি বিক্রি করেন। ফলে পাইকাররা বাড়ি থেকেই টুপি কিনে নিয়ে যায় এবং কাঁচামালও তারাই সর্বরাহ করে থাকেন।

এক সপ্তাহ পরপর বাড়ি থেকে নগদ টাকায় টুপি কেনাবেচার ব্যবস্থা চালু আছে বর্তমানে। এতে অনেক অসচ্ছল পরিবারের নারীরাসহ স্কুল-কলেজ পড়–য়া মেয়েরাও সংসারের খরচ মেটাতে টুপি সেলাইয়ের দিকে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। অনেক মেয়েই টুপি বানিয়ে লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছেন।

টুপি ব্যবসায়ীদের স্থানীয় সংগঠন বাংলাদেশ জালিটুপি অ্যাসোসিয়েশনের নারী সদস্য চম্পা ও যাকিয়া ঢাকাটাইমসকে জানান, সমিতি হওয়ায় তাদের বেশ সুবিধা হয়েছে। তাদের তৈরি টুপি এই সংগঠনের মাধ্যমে নির্ধরিত দামে বিক্রি হয়।

এসব কুটিরশিল্পের নারী কারিগরদের যাবতীয় সমস্যা নিরসন করে তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় এনে আরো সক্রিয় করলে এবং সুদ মুক্ত ঋণ ও শুল্ক মুক্ত সুতা আমদানি করার ব্যবস্থা করলে এ শিল্পকে অনেক দূর নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

এ ব্যাপারে বগুড়া-৫ আসন (শেরপুর-ধুনট) সংসদ সদস্য হাবিবর রহমানের সাথে কথা বলেলে তিনি দেশের গার্মেন্টস শিল্পের মত এখানকার টুপি শিল্পকে সরকারি সহায়তা প্রদানের জন্য বিষয়টি নিয়ে সংসদে কথা বলার আশ্বাস দেন।

(ঢাকাটাইমস/২৩জুন/প্রতিনিধি/ইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :