আমার জীবনে চাহিদা বলে কিছু নেই-৩

শিমূল ইউসুফ
| আপডেট : ২৭ জুন ২০১৭, ১০:১৫ | প্রকাশিত : ২৭ জুন ২০১৭, ১০:০৩

শিমূল ইউসুফ। অভিনয় জগতে অসামান্য দ্যুতি ছড়ানো এক নাম। বাংলা নাটকের প্রবাদ পুরুষ সেলিম আল দীন তাকে বলেছিলেনএকালের মঞ্চকুসুম ঢাকাটাইমস সাপ্তাহিক এই সময়ের সঙ্গে এক দীর্ঘ আলাপচারিতায় তার বেড়ে ওঠা, স্বাধীনতার সংগ্রাম সমসাময়িক সাংস্কৃতিক আবহ, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পারিবারিক নানা সংকট, নিজের স্বামী নাসির উদ্দিন ইউসুফের কর্ম, একাত্তর থেকে যাবৎকালের মঞ্চ চলচ্চিত্রের নানা বিষয় মেলে ধরেছেন। আজ তৃতীয় পর্ব।আলাপচারিতায় ছিলেন প্রধান প্রতিবেদক হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

হঠাৎ করে মঞ্চে আসার ব্যাপারটা আসলে কী?

’৭৪-এ ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে প্রথম বিদায় মোনালিসা-র মঞ্চায়ন হবে। ওখানে অরিন্দম নাট্যগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের প্রথম নাট্যদল ঢাকা থিয়েটার। ঢাকা থিয়েটার প্রথম ঢাকার বাইরে অনুষ্ঠান করতে গেল। নাটকের জন্য নির্ধারিত প্রধান চরিত্রটি আগের দিন জানিয়ে দিলেন যে, ফ্যামিলি তাকে চট্টগ্রাম যেতে দেবে না। ঢাকা থিয়েটারের তখন বেকায়দা অবস্থা। কাকতালীয়ভাবে আমি তখন ছুটিতে এসেছি। পড়তাম ভারতের বরোদা চারুকলায়। এর আগে ঢাকায় আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েরা বিদায় মোনালিসা-র অভিনয় করে, আমিও ছিলাম। আফজাল (আফজাল হোসেন) আমার দুই বছরের সিনিয়র। আমাকে ধরল- তুমি শোটা করেছ, চট্টগ্রামে চলো। ওখানে ওরা টিকিট বিক্রি করেছে। মাত্র দুইটা শো। প্লিজ, উদ্ধার করো। সেই থেকে আমি ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হলাম। এদিকে আমার ছুটি শেষ। আমি ভারতে ফিরব। আমি কচিকাঁচা করে বড় হয়েছি। মা আমাকে যেতে দিলেন না। নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু দুদিন পর স্ক্রিপ্ট দিল মুনতাসীর ফ্যান্টাসি-র। বলল, একটু পড়ে দেখ তো কী সুর করা যায়। আমি ফাঁসলাম। দেখলাম এটাই আমার জায়গা। সেই থেকে আমি ঢাকা থিয়েটারে।

প্রথম পারফরম্যান্সে কেমন সাড়া পেয়েছিলেন?

আসলে আমার নাটক করার কথা ছিল না। আমি গান করতাম। আমি সংগীত নিয়েই থাকতাম। কেন জানি নাটক আমার ভালো লেগে গেল। মনে হলো যে, করি, দেখি কেমন হয়। কী রকম লাগে। ভালোলাগা থেকেই কিন্তু নাটক করা।

বাচ্চু ভাই তখন নির্দেশক। আপনি সংগীত নিয়ে ছিলেন। তারপর নাটকে ভালো লাগা। বাচ্চু ভাইয়ার অনুপ্রেরণা কেমন ছিল?

পুরো দল আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। যেমন- ঢাকা থিয়েটারে আসার আগে আমি কখনোই গানে সুর করিনি। তো ঢাকা থিয়েটার আমাকে সেই সুযোগটা দিয়েছিল। দেখো পারো কি না গানে সুর তুলতে। ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’ নাটকের সব গান আমার সুর করা।

সংগীত কিন্তু ছেড়ে দেওয়ার কোনো বিষয় নয়। কারণ সংগীত আমার সঙ্গে সঙ্গেই আছে। ঢাকা থিয়েটার করছি। তার মিউজিক করছি। নিজে গান করছি। সংগীতনির্ভর নাটক হচ্ছে ঢাকা থিয়েটারের মঞ্চে। আগে পাঁচালি আঙ্গিকের নাটকগুলো যে এভাবে হয়, এটা কেউ বুঝত না। নাচ, গান, অভিনয় একসঙ্গে হতে পারে এটা কেউ বুঝত না। এটা আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী রীতি থেকে নেওয়া। আগে বুঝত না। কিন্তু এখন প্রায় সব দলই বর্ণনাত্বিতরীতিতে নাটক হয়। এ অর্জন কিন্তু সাধু গান করে পেতাম না। এই শিল্পের দরজাগুলো কিন্তু আমার জন্য অনেক খুলেছিল। যেমন কোরিওগ্রাফি। নাচ। আমার মেজো বোন নাচে। তাকে দেখেই আমি নাচ শিখেছি। কিন্তু নাচের শিল্পী তো আমি না। ঢাকা থিয়েটারে এসে কী হলো? নাটকের কোরিওগ্রাফি করলাম। ওই চারুকলায় পড়েছি ছোটবেলায়। কচিকাঁচার মেলা করেছি। সেই আইডিয়াটা লাগল কসটিউম ডিজাইন করতে গিয়ে। চিত্রনাট্য সম্পাদনা করেছি। সেলিম আল দীনের কাজ। এত বড় মানুষের কাজ করা, এত বড় বড় নাটক ছোট করে আনা সেটার শিক্ষা পেয়েছি। কীভাবে করতে হয়, সেটা শিখেছি। সেলিম আল দীন বলেছিলেন- ‘যদি কাটতে হয়, যদি ছোট করতে হয়, তো শিমূল ছাড়া আর কেউ করবে না। আমার নাটক কেউ ধরবে না।’

আপনি যখন থিয়েটারে গেলেন তখন নানা ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হলেন। তখন আপনার গানের গুরুদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল?

হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি সুধীনদার কাছ থেকে গান শিখেছি ৯৬-এ। লালনসংগীত শিখেছি। সুধিনদা একদিন আমাকে বললেন, ‘তুই যদি গান গাইতে চাস তাহলে সুর ওঠা। দেখ পারিস কি না। আমি বললাম আচ্ছা ঠিক আছে। তো আমাকে শেখালেন প্রথম লালনের গান। আশা সিন্ধু কুলে বসে আছি গো সদায়। তো দাদা অফিসে গেলেন। আমি সুর তুললাম। পরে তাকে শোনালাম। সুধিনদা বললেন, ‘তুই লালন গা। তোর গলার এত হাইরেঞ্জ। লালনটা তোর গলায় খুব ভালো আসবে। তো আমি ওনার কাছে শুধু লালন শেখা শুরু করলাম। নজরুলসংগীত পাশাপাশি লালনসংগীত। সেই হিসেবে আমার লালনসংগীতের একটি সিডি আছে। ভাবলাম আমার তো কিছুই নাই। অন্তত যা শিখলাম তা যদি একটু করে রাখতে পারি। তো এই ব্যাপারে আমি সুধিনদার কাছে কৃতজ্ঞ।

সেলিম আল দীনের সঙ্গে আপনার পরিচয় ঢাকা থিয়েটারে কাজ করতে গিয়ে। তিনি পারিবারিকভাবেই আপনাদের অনেক ঘনিষ্ঠ ছিলেন। প্রিয় মানুষ ছিলেন। তার সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা স্মৃতি থেকে যদি বলতেন।

তার স্মৃতিতে বলে শেষ করার মতো না। প্রচুর আছে জমা। আমার জীবন গল্পে যেসব মানুষের কথা বলতে হবে, তার মধ্যে আলতাফ মাহমুদ তো আছেনই তারপর সেলিম আল দীন আর নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। এই তিনজন মানুষ না থাকলে আমি আজকে এখানে আসতেই পারতাম না। কারণ আমি মানসিকভাবে মানুষ হয়েছি এ তিনজনের কাছে এসে। আমার যে বেড়ে ওঠা। বা আমি যা আছি, যা ভাবি, যা করি তার সব কিছুর পেছনে এই তিনজন মানুষ আছেন।

সেলিম ভাই এমন একটা মানুষ ছিলেন, তিনি যদি কিছু বোঝাতে যেতেন তখন হা করে আমাদের শুনতে হতো। মানে তার বলার ভঙ্গি এবং বলার ভেতরে এমন কিছু থাকত যে অন্যদিকে মনোযোগ দেওয়াটা সম্ভব ছিল না।

আর আমার বাসা ছিল সেলিম ভাইয়ের সেকেন্ড হাউস। সেকেন্ড হোম বলতে যেটা বোঝায়। এখানে যে কোনো সময় উনি আসতেন। যে কোনো সময় উনি খাবার খেতেন। ঘুমাতেন। জাহাঙ্গীরনগরে তার বাসা ছিল। আর ঢাকায় হলো আমার বাসা। যত আবদার আমার কাছে। বাচ্চুর কাছে। কী লাগবে, না লাগবে- সবকিছু বাচ্চু এবং আমি দেখাশোনা করতাম। তার কোনো কিছু দরকার সেটার জন্য বাচ্চাদের মতো জেদ করতেন। ‘আমার লাগবে।’ আমি আর বাচ্চু প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করতাম। আবার কখনো বলতেন, ‘আমার খুব ক্ষুধা লাগছে খেতে দে।’ পাঁচ মিনিট দেরি হলেই বাচ্চাদের মতো চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিত। নিচ থেকে উঠত ‘ক্ষিধা লাগছে, ক্ষিধা লাগছে’ করতে করতে। খাওয়া না পাওয়া পর্যন্ত চিৎকার চলত। আর আমার সঙ্গে সেলিম ভাইয়ের বিভিন্ন সময়ের যে অবসর সময় কাটত; ঠিক অবসর সময় না, যেমনÑ রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে। বলতাম, ‘ভাই, তুই কি এটা শুনছিস? বল তো, ‘না। বাজা।’ বাজাতাম। একদম বিমুগ্ধ হয়ে শুনত। একদম চোখ বুজে, শুয়ে গান শুনছে। সেলিম ভাইকে গান শুনিয়েও খুব মজা ছিল। সিডি ছেড়ে দিতাম তিনি শুনতেন।

মঞ্চের অনেক শিল্পী সেলিম আল দীন নিজ হাতে গড়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি কোন বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিতেন?

তিনি শিল্পী গড়তেন না। ছাত্র গড়তেন। যাদের মনে হতো এরা আগামীতে ভালো কাজ করবে, তাদের তিনি খুব কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করতেন। সেখানে তার সঙ্গে তার সম্পর্ক একদম পিতা-পুত্রের মতো বা কন্যার মতো। নিজে তো নিঃসন্তান ছিলেন। এজন্য বাচ্চাদের সন্তানের মতো আদর করতে পছন্দ করতেন।

১৯৭৯ সালে বিয়ের পর সংসার জীবন কীভাবে শুরু করলেন?

এখন যেখানে বসে আছি (১১/১ খ, পুরানা পল্টন লাইন, ঢাকা) এটা আমার শ^শুরবাড়ি। শ^শুরের ভিটা। এখানে একটা বাংলোবাড়ি ছিল। আমরা যৌথ পরিবারে ছিলাম। আমার শ^শুর সিএসপি ছিলেন। উনি সচিবালয়ের কাজ করতেন। যুগ্ম সচিব ছিলেন। তখন তিনি অবসরে চলে গেছেন। বিয়ের দু-বছর পর তিনি মারা যান। শ্বশুরের আদিবাড়ি পুরান ঢাকার নবাবগঞ্জে। শ্বশুর কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে অর্থ বিভাগে ছিলেন। পরে পল্টনে বাড়ি করেন- এটাই বাচ্চুদের আদিবাড়ি।

বিয়ের পর মঞ্চে আপনাদের কাজের পরিবেশটা কেমন ছিল? তিনি (নাসির উদ্দীন ইউসুফ) কি আপনাকে বেশি গুরুত্ব দিতেন?

ঢাকা থিয়েটারে নাসির উদ্দীন ইউসুফের কাছে আমার কোনো অতিরিক্ত গুরুত্ব ছিল না। আর আট দশটা সদস্য যেই রকম আমিও ঠিক ওই রকম ছিলাম। ঢাকা থিয়েটারে প্রীতি ধোপে টিকে না। হা হা হা। উল্টো বরং আমি সবচেয়ে বেশি বকা খেতাম। এখনো বকা খাই। অন্যের ঝাল আমার ওপর মেটায়। (মুখ টিপে হাসলেন)।

নাসির উদ্দীন ইউসুফকে একজন গেরিলা যোদ্ধা, সুনামধন্য নির্মাতা, একজন শিল্পী হিসেবে আমরা জানি। একজন জীবনসঙ্গী হিসেবে আপনি তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ও একেবারেই বাউন্ডুলে। কোনো রকমে ওর ঠিকানা নাগাল পাওয়া যায় না। আজকে ঢাকা তো কালকে কলকাতা, পরশু লন্ডন। এই হচ্ছে তার মতিগতি। সংসার কী জিনিস জানে না। মাসের প্রথমে টাকা আমার হাতে দিয়ে সারা মাস ফুর্তি করে, আনন্দ করে, কাজ করে কাটায়। আমার হলো সব দায়। শুরু থেকেই এমন। কারণ ও এসবের মধ্যেই নেই। কিসের সংসার! কিসের কি! আসলে ক্রিয়েটিভ মানুষদের সংসারে বাধাটা কঠিন হয়ে যায়। আর ভীষণ ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। মানুষের সঙ্গে মিশতে পছন্দ করে। ভালোবাসতে পছন্দ করে। গ্রাম থিয়েটার আছে। গ্রাম থিয়েটারের কর্মীদের পেলে আমি কে, তাও চেনে না। এ রকম অবস্থা। আমি ওকে কোনোদিন বাঁধার চেষ্টাও করিনি। আর আমি ওই জীবনও পছন্দ করি না। আমি মনেই করি, মানুষের জন্ম একবারই। তার একটা স্বাধীনতা থাকা দরকার।

আপনি বলছিলেন ক্রিয়েটিভ মানুষগুলো এ রকম হয়। আপনিও কি কম?

আমার হয়েছে কি, আমি খুব সংসার পছন্দ করা মানুষ। সংসার মানে কিÑখুব ঘর পছন্দ করা মানুষ। আমি খুব একটা বাইরে যাই না। কাজ না থাকলে কোথাও যাই না। কাজের মধ্যে আমার একটাই ঢাকা থিয়েটার। সেটা সন্ধ্যার সময়। আমাকে যদি বলে ঢাকা থিয়েটারে সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করতে হবে, আমি আছি। কিন্তু এর বাইরে ওইখানে যাওয়া, তমুক জায়গায় যাওয়াÑআমার ভালো লাগে না। সে কারণে আমি এত সময় পাই গুছিয়ে কাজ করার। একজন তো উড়ানচ-ী। আর একজন যদি সাংসারিক না হয়, ঘরে যদি না থাকে তাহলে ঘরটা উচ্ছন্নে যাবে। আমি ছোটবেলা থেকে খুব কম চাহিদার মানুষ। আমার জীবনে চাহিদা বলে কিছু নেই। যা পাই তাতেই খুশি।

এখন পর্যন্ত অনেক কাজ করেছেন। অভিনয়, মিউজিক, কস্টিউম, কোরিওগ্রাফি এত সব কাজ করতে গিয়ে কখনো ক্লান্তি আসেনি?

মোটেও না। আমার নিজের সঙ্গে এসব মিশে গেছে। কখনো ক্লান্তিবোধ করিনি। যা করেছি সব মঞ্চের জন্য করেছি। নাটকের জন্য করেছি। এখন পর্যন্ত মনে হয় অভিনয় করেছি ৩৩টি নাটকে। আর নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয়েছে দুই হাজারেরও বেশিবার। এক ‘বিনোদিনী’ই (নাটক) তো একশ তেইশবার মঞ্চস্থ করেছি।

‘বিনোদিনী’ নাটকের বিনোদনী সম্পর্কে পাঠকদের যদি বলতেন...

আধুনিক বাংলা মঞ্চ নাটকের প্রথম অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসির জীবন নিয়ে করা ‘বিনোদিনী’ নাটকটি। ১৯৭৪ সালে বিনোদিনীর বয়স এগারো বা বারো। তখনই মঞ্চে প্রথম অভিনয় করেন গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের ‘শত্রুসংহার’ নাটকে। সেখানে তিনি ছিলেন দ্রৌপদীর সখী। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত গ্রেট ন্যাশনাল, বেঙ্গল, ন্যাশনাল ও স্টার থিয়েটারের সেই সময়ের প্রায় সব নাটকের প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করেছিরেন বিনোদনী। অল্প সময়ের মধ্যে চারদিকে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্র জীবনে এ নারী ৮০টি নাটকের ৯০টির বেশি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। বিনোদিনী দাসির জীবনকে নাট্যরূপ দিয়েছেন নাট্যকার ও লোক-গবেষক সাইমন জাকারিয়া, নির্দেশনা উপদেষ্টা সেলিম আল দীন, নির্দেশনা নাসির উদ্দীন ইউসুফের। আর অভিনেতা একজনই, আমি।

একা অভিনয় করে একটা নাটককে টেনে নিয়ে যাওয়া তো সহজ কথা নয়। এটা কীভাবে সম্ভব হলো?

এটা ঠিক বিনোদিনীর মতো তো এখনো বাংলাদেশে আর কাউকে পাইনি। যে কিনা একাই এভাবে পুরা নাটক টেনে নিয়ে চলে যায়। এটা তো অনেক কঠিন। বিনোদিনী আর কেউ করতে পারবে কি না, জানি না। আসলেই বেসিক ট্রেনিং সংগীত ও নৃত্য না থাকলে তারা বিনোদিনী করতে পারবে না। আমি যেভাবে উপস্থাপন করেছি বিনোদিনী, সেটা হয়তো পাওয়া যাবে না। অন্যভাবে হয়তো পাওয়া যাবে।

‘বিনোদিনী’ যখন একা আপনাকে করার জন্য বলা হলো, তখন আপনি আগ্রহী ছিলেন?

‘বিনোদিনী’ আমি একা করব এটা সেলিম আল দীন ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ অনেক আগে থেকেই সলাপরামর্শ করে রেখেছিলেন। তা আমি জানতাম না। মানে অনেক আগে থেকেই এটা ঠিক ছিল যে, ওনারা আমাকে দিয়ে একটা একক করাবেন। কোনটা করাবেন সেটাও সেলিম ভাই বাচ্চুকে পরামর্শ দিয়ে দিয়েছিলেন যে, ‘বিনোদিনী দাসীর অটোবায়োগ্রাফিটা ওকে দিয়ে করা। বিনোদিনী দাসি কবিতার সব সুর আমি করেছি গান হিসেবে। নাটকের কিছু কিছু অংশে পারফর্মেন্স করা হয়েছে। তো এই ষড়যন্ত্রটা আমি আগে জানতাম না। এটা টের পেলাম যখন নাকি বিনোদিনী দাসী রিসার্চ করা শুরু হলো। আমি আর বাচ্চু সেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে রেফারেন্স নিয়ে শান্তিনিকেতন থেকে বইটি এনেছিলাম। ওখানে একটা মাত্র বই ছিল। তো সেই বইটা আমরা সংগ্রহ করে নিয়ে আসি। সেলিম ভাইকে বললাম, ‘সেলিম ভাই তুই লেখ। তুই লিখে দে তাহলে আমার জন্য মুখস্থ করতে সুবিধা হবে। কারণ ওটা ছিল সাধু ভাষায় লেখা।’ সেলিম ভাই বলল, ‘অসম্ভব। ওনার লেখার ওপর আমি একটা অক্ষরও বসাতে পারব না। এত সাহস আমার নেই। তোমাকে এটা থেকেই করতে হবে। তুমি এডিট করে নাও।’ আমি মহামুশকিলে পড়লাম। এক হলো অন্যের ডায়েরি। তার মধ্যে তার আবেগ, তার দুঃখ-কষ্ট, এটা আমার সঙ্গে কোনও রকমভাবেই যাচ্ছিল না। ওনার জীবনটাই তো অন্য রকম। মহা মুশকিলে পড়ে গেলাম। কিছুতেই মুখস্থ হচ্ছিল না। কিন্তু এদিকে ‘মেঘনাথবধ’ কাব্য মুখস্থ হয়ে গেছে, ‘নীল দর্পণ’ মুখস্থ হয়ে গেছে, নিমাই সন্যাসী মুখস্থ হয়ে গেছে। সবই মুখস্থ হয়ে গেছে কিন্তু ওনারটা মুখস্থ হচ্ছিল না। বাচ্চুকে বললাম, ‘বাচ্চু আমি তো কিছুতেই পারছি না।’ বাচ্চু বলল, ‘আমি জানি না তুমি কী করবে। মুখস্থ তোমাকে করতেই হবে শিমূল।’ বাসায় বসে বসে তার ডায়েরি মুখস্থ করা এবং যখন এটা উপস্থাপনে গেলাম তখন দেখা গেল ব্লকিং। ফিজিক্যাল করতে গেলে ওনার কথা ভুলে যাই। আর কথা মনে করতে গেলে ফিজিক্যাল ভুলে যাই। মানে মহাযন্ত্রণায় ছিলাম। আমি এটা সিরিজ রিহার্সেল করেছি। একদম টানা আঠারো দিন। সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা। আমাকে কোনো রকম ছাড় দেওয়া হয়নি। বাচ্চু বলেছিল তুমি যদি এটা প্র্যাকটিস করতে না পারো, তাহলে জীবনেও পারবে না। তো প্রথম দিকে মনে হতো ঠিক আমি ওনার কাছাকাছি যেতে পারছি না। উনি যা লিখেছেন সেগুলো তো ধারণ করে আমাকে বলতে হবে। তো প্রথম দিকে আমি তেমনটা পারিনি। একদম সত্যি কথাটা বলছি। আমি করতে করতে ওনাকে ধারণ করেছি।

বিনোদিনী নাটকটি প্রথম কোথায় প্রদর্শিত হয়েছিল?

মহিলা সমিতিতে। ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটের নাটক। পুরোটা সময় আমাকে একাই মুখস্থ করতে হচ্ছে। একাই পারফর্ম করতে হচ্ছে।

তখন অনুভূতি কেমন ছিল?

আমি সেটা বলতে পারব না। আমি সেন্সলেস ছিলাম মনে হয়। এত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে কিছু বলতে পারব না। মানে আমি কী দিয়ে, কী করে আসছি বলতে পারব না। আমার ১৮ দিনের প্র্যাকটিসটা হড়বড় করে বলে চলে আসছি। তবে সবাই বলছিল খুব ভালো হয়েছে।

এ নাটক নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কিংবা প্রাপ্তি কতটুকু?

প্রাপ্তি অনেক। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো, ১৩০ বা তারও বেশি সময় আগেকার বিনোদিনী দাসীকে সবাই ভুলে যেতে বসেছিল। কিন্তু বিনোদিনী মঞ্চে আসার পর তার শিল্পীজীবনটাকে অনেকেই উপলব্ধি করতে শিখেছে। আরেকটি বিষয় হলো, নাটকটি ওপার বাংলায় বেশি আলোড়ন তুলেছে। নাটকটি দেখার পর অনেকেই বলেছেন, বিনোদিনী কলকাতার কোনো দলেরই আগে আনা উচিত ছিল। কিন্তু এ বাংলা তা আগেই করেছে। এ কারণে আমাদের প্রাপ্তিটা বেশি মিলেছে।

নাটকটি দর্শকদের মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন?

অবশ্যই, দর্শকের মধ্যে প্রভাব পড়েছে। যারা বিনোদিনী সম্পর্কে জানত না, তাদের অনেকেই আজ এ নাটকের সুবাদে তাকে জানতে-চিনতে শিখেছে। আমার কাছে অনেকেই তাদের লজ্জার কথা জানিয়েছে যে তারা আগে এত বড় মাপের অভিনেত্রী সম্পর্কে জানত না।

ঢাকার মঞ্চে যেকোনো নাটকের চেয়ে ‘বিনোদিনী’ সবচেয়ে বেশি দেশের বাইরে প্রদর্শিত হয়েছে...

আমরা ভারতের একাধিক অঙ্গরাজ্যে নাটকটির প্রদর্শনী করেছি। ফিলিপাইনের বিশ্বনাট্য থিয়েটার অলিম্পিকস ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফুজাইরার বিশ্ব মনোড্রামা উৎসবে নাটকটি মঞ্চস্থ করেছি। নাটকটির মাধ্যমে আমরা শুধু দুই বাংলাতেই নয়, পৃথিবীর অন্যান্য ভাষাভাষীর দেশেও দেখাতে পারছি। আমরা এত বড় মাপের একজন অভিনেত্রীর জীবনকে পৃথিবীর নানা দেশে তুলে ধরতে পারছি। এটা কিন্তু খুবই গৌরবের বলে আমি মনে করি।

প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীন আপনাকে ‘মঞ্চকুসুম’ উপাধি দিয়েছিলেন...

হ্যাঁ, তিনি আমাকে ‘চাকা’ নাটকটি ‘একালের মঞ্চকুসুম’ বলে উৎসর্গ করেছিলেন। পরে সুফিয়া কামাল খালা এটাকে সমর্থন করে। সেই থেকে আমার নামের আগে ‘মঞ্চকুসুম’ জুড়ে গেছে। কিন্তু আমার এটাতে অস্বস্তি হয়। আমার কাছে মনে হয় এসব ঠিক না। আমি কাজ করছি, কাজ করব।

এটা আপনার প্রাপ্য বলেই আমরা মনে করি। সেলিম আল দীন ঠিক কাজটি করেছেন। মঞ্চ নাটকে আপনি অনেকের কাছে অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব।

তা-কি? আমি তো ফেরদৌসী মজুমদার, সারা জাকেরকে দেখে শিখেছি। তাদের দেখেই আমার আগ্রহটা ভেতরে তৈরি হয়েছে।

মুনতাসীর ফ্যান্টাসি নাটকটি কমেডিধর্মী ছিল। এরপর আপনার অভিনীত উল্লেখ্যযোগ্য নাটক কোনগুলো?

এরপর ‘কসাই’, ‘শকুন্তলা’, ‘চর কাকড়া’।

‘শকুন্তলা’ নাটকটি সম্পর্কে যদি কিছু বলতে চান।

কালিদাসের ‘শকুন্তলাকে’ ভেঙে সেলিম আল দীন নতুন ‘শকুন্তলা’ লিখলেন। সেটা হলো মর্তে যার জন্ম। সাবিত্রী ও মেনোকার সন্তান শকুন্তলা। যাকে ফেলে মেনোকা চলে গিয়েছিল। মালিনী নদীর তীরে ফেলে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে ঋষিকর্ণ তাকে নিয়ে আসে। যেহেতু তার মর্তে জন্ম। যখন সে ঋতুবতী হয় তখন সে তার দেহ থেকে স্বর্গের একটা সুবাস পায়। সে কিছুতেই বুঝতে পারে না কেন এটা হচ্ছে! তখন সে তার জন্মটা জানতে পারে। অসুস্থ হতে থাকে এবং চিকিৎসক এসে বলে ওর জন্ম পরিচয়। আসলে ও স্বর্গের মেয়ে। ও মর্তের মেয়ে না। যখন ওর জন্ম পরিচয়টা জানে শকুন্তলা তখন মনে করে তার মর্তে থাকাটা ঠিক না। তার মাকে সে বলে মেনোকা তুমি আমাকে নিয়ে যাও আমি তো তোমার সন্তান।

আপনার অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে আছে ফণিমনসা, কীর্তনখোলা, ধাবমান, নষ্টনীড়, দ্য টেম্পেস্ট। এর মধ্যে ‘দ্য টেম্পেস্টের’ কথা বলতে হয়। এটা সম্ভবত ইংল্যান্ডের একটা মঞ্চে আপনি অভিনয় করেছিলেন?

গ্রুপ থিয়েটারে। গ্রুপ থিয়েটারে যখন অলিম্পিক হলো। ইংল্যান্ড অলিম্পিক যেটা। তার আগে ওরা থিয়েটার অলিম্পিক করেছিল। অলিম্পিকের সূচনাটা হলো থিয়েটার অলিম্পিক। তো সেখানে শেকসপিয়রের ৩৭টি নাটক, ৩৭টি দেশ প্রেজেন্ট করবে। ৩৭টি ভাষায়। ৩৭টি ভাষার মধ্যে হয়তো ৩৭টি ভাষায় হয়নি। কারণ অনেকের ভাষায় ছিল ইংলিশ। অনেকে ইংলিশেই করেছে। কিন্তু আমরা মানে যখন বাংলাদেশিদের অফার করলÑ তখন আমরা বাংলায় নাটকটি করলাম। টেম্পেস্ট শেকসপিয়রের একদম শেষ নাটক। তারা আমাদের কে সিলেক্ট করে দিল টেম্পেস্ট। কারণ আমরা নদীমাতৃক দেশ। আমাদের এখানে ঝড়ঝাঞ্ঝা বেশি হয়। আমরা কীভাবে উপস্থাপন করি, ওরা দেখতে চেয়েছিল। শেকসপিয়রের গ্রুপ থিয়েটার। প্রায় সাড়ে চার শ বছর পরে শেকসপিয়রের থিয়েটারে আমরা বাংলা ভাষায় নাটক করেছি। যারা দুশো বছর আমাদের শাসন করে গেছে।

টেম্পেস্ট নাটকটা সম্পর্কে শুনতে চাই।

টেম্পেস্ট শেকসপিয়রের লেখা নাটক। আমরা এটা বাংলা করলাম। রুবায়েৎ আহমেদ এটার অনুবাদ করেন। আমরা ওটাকে থিয়েটারের স্টাইলে প্রেজেন্ট করেছি।

এটুকুই! কাহিনিটা সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন।

অনেক বড়। আমি বলতে পারব না।

সংক্ষেপ যতটুকু বলা যায়...

কাহিনিটা হচ্ছে—এক রাজাকে রাজত্বহীন করে তার ভাই। তার ছোট্ট মেয়েসহ রাতের অন্ধকারে কিছু বই আর কিছু জিনিস দিয়ে তাদের দ্বীপান্তরিত করে। মেরে ফেলার কথা ছিল। কিন্তু তারা মারা যায় না। একটি দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সে দ্বীপে কেউই নেই। রাজা জাদুবিদ্যা আয়ত্তে নেয়। তার এমনই ক্ষমতা হয় যে, সে কিছু আত্মাকে বশ করে। এ নতুন রাজার ভাই যখন তারা ওই দ্বীপে ভ্রমণে যায়, তখন আত্মারা জাহাজ বেঁধে ফেলে। তাদের প্রত্যেককে ওই দ্বীপে উঠতে হয়। তারপর তারা সেখানে বুঝতে পারে যে, ওর ভাই করেছে পুরো জিনিসটা। ওই আত্মারা তাদের বিপদে ফেলে। ভাইয়ের মেয়ের সঙ্গে ছোট ভাই মানে নতুন রাজার ছেলের প্রেম হয়। বিয়ে হয়। তারপর তার ভাই জানতে পারে যে সে ভুল করেছিল। ক্ষমা চায়। এই রকম আর কি।

মঞ্চ নাটকের পাশাপাশি টিভি নাটকেও কাজ করেছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন টিভি নাটকে আপনি নেই। কেন?

১৯৯১ সালের পরে আর টেলিভিশনে কাজ করিনি। ‘গ্রন্থীগণ কহে’ আমার টেলিভিশনে করা শেষ নাটক। টেলিভিশন আমাকে খুব একটা বেশি টানে না। আমার ইচ্ছা করেনি তাই আর করিনি। টেলিভিশনে গিয়ে বসে থাকা, সময় নষ্ট করা। আমি ওঠাকে সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু বলতে পারি না। তারচেয়ে বরং থিয়েটারে আমার অনেক কাজ আছে। আমি যে সময়ে ছেড়েছি ওই সময়ে আমাকে থিয়েটারে প্রচুর সময় দিতে হতো। যে কারণে আমি টেলিভিশনটা আর কন্টিনিউ করিনি।

আপনি চলচ্চিত্রেও অনেক কাজ করেছেন। এ অভিজ্ঞতা কেমন?

চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছি। কণ্ঠ দিয়েছি। গেরিলাতে আমার শেষ কাজ হলো। আমি মোরশেদুল ইসলামের প্রথম ছবি ‘আগামী’, তাতে আমি কাজ করেছি। আমি এর পরপর তিনটি ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছি। ‘একাত্তরের যিশু’-তে আমার গান গাওয়া আছে। ওটা লাকী আপা করেছেন। ছোটবেলায় চলচ্চিত্রে বাচ্চাদের গান করেছি। আলতাফ ভাইয়ের সংগীত পরিচালনায়। রবিন ঘোষের। আমি না অনেক কিছু ভুলে গিয়েছি।

কচিকাঁচার মেলায় আসলে আপনারদের কাজগুলো কী ছিল?

বাচ্চাদের মানসিকতা উন্নত করা। ব্রেইন ডেভেলপ করা। বিভিন্ন অঞ্চলের বাচ্চাদের নিয়ে আমরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতাম। এটা একটা সংগঠন। তখন কচিকাঁচার মেলা আর একটা কী যেন ছিল। ‘সবুজ চাঁদের হাট’ এ রকম বোধ হয় ‘মুকুল ফৌজ’ ছিল। আমরা কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় যেতাম। বড়রা নিয়ে যেত আমাদের। বিভিন্ন জায়গার বাচ্চাদের সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা আদান-প্রদান হতো। ওখানে একটা দল গঠন করে আসতাম। কচিকাঁচার মেলার একটা সংগঠন করে আসতাম। এ রকম এটা সিলেটে ছিল, নেত্রকোনায় ছিল, বিক্রমপুরে ছিল। আমার জানামতে, আমি যেগুলো দেখছি আর কি।

আপনার গানের ৫টি অ্যালবাম আছে। কিন্তু দীর্ঘদিন গানে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ কী?

এ মুহূর্তে গানের গলাটা নষ্ট। গানের জন্য একটা প্র্যাকটিস লাগে। সেটা এখন হচ্ছে না। গান অনেক কঠিন জিনিস।

কিন্তু এখন তো দেখছি যে কেউ চাইলেই শিল্পী হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যপারে আপনার মন্তব্য কী?

শিল্পী হওয়ার শর্টকাট কোনো রাস্তা হয় না। সেটার জন্য প্রথমে সময় দিতে হবে। খাটতে হবে।

গান, অভিনয়ের বাইরে আপনি নাট্য নির্দেশনাও দিয়েছেন। এ পর্যন্ত বোধ হয় একটিই?

হ্যাঁ। ‘ধাবমান’ আমার নির্দেশিত প্রথম নাটক। এর বাইরে আর করিনি। তবে ভবিষ্যতে করব।

‘ধাবমান’ নাটকটি নির্দেশনা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?

২০০৭ সাল সেলিম ভাই লিখলেন ‘ধাবমান’। প্রাণী হত্যার বিরুদ্ধে নাটক। সেলিম ভাই আমাকে বলল, ‘বাচ্চুকে বল না ‘ধাবমান’টা তাড়াতাড়ি মঞ্চে আনতে।’ নির্দেশনার ভার আমার ওপর পড়ল। কিন্তু সেলিম ভাই সোহরাব করবে কে? সেলিম ভাই বলল, ‘আমাদের এশা মা আছে না!’ আমি বললাম, এশা পারবে? সেলিম ভাই বলল, ‘আমাদের মেয়ে না! পারবে না কেন!’ এশা তখন থাইল্যান্ডে পড়াশোনা করছে। নাটকের কাজ শুরু করলাম। কেটেছেঁটে স্ক্রিপ্ট দাঁড় করালাম। পড়াশোনা শেষ করে এশা এলো। পদ্মার নাচন আর মাদার পিরের জারি দিয়ে নাটক শুরু করলাম। নাটকটি মঞ্চে আসার আগেই তো সেলিম ভাই চলে গেলেন!

টেলিভিশনের প্রতি আপনার কম আগ্রহের কারণ কী?

আমি ছোটবেলায় টিভিতে অনেক কাজ করেছি। প্রায় প্রতিদিন টেলিভিশনে কাজ করতাম। পরে নজরুলসংগীত শিল্পী হিসেবে করেছি। আমার কাছে খুব একটা না ভালো লাগত না। লাইভ পারফরম্যান্সের কাছে কিন্তু কোনো কিছুই যায় না। মঞ্চে আমি যে মজা পাই, যে নেশাটা আমার আছে- মিডিয়াতে তা নেই।

মঞ্চ নিয়ে আপনার নতুন কোনো ভাবনা আছে? আগে মঞ্চ থেকে টিভিতে শিল্পী আসত। এখন সরাসরি টিভিতে আসছে। শিল্পী তৈরিতে মঞ্চের ভূমিকা আসলে কী?

মঞ্চে আসলে চর্চা করার একটা ভালো জায়গা। এখানে উচ্চারণ, ফিজিক্যাল ফিটনেস ঠিক করার কর্মশালা হয়। সেগুলো আমাদের কাজ। আর মঞ্চে পারফরম্যান্সের জায়গাটা কিন্তু নির্দেশকের। নির্দেশক বুঝতে কাকে দিয়ে কোনটা হবে। আর এমনিতে সাংগঠনিক কিছু কাজও থাকে। লাইটের জন্য। তারপর মিউজিক হ্যান্ডসের জন্য শিল্পী তৈরি করা হয়। ভোকালিস্ট তৈরি হয়। এসব মৌলিক প্রশিক্ষণ আমরা মঞ্চে দিই। মঞ্চে ওঠার ব্যাপারে যে ভীতি থাকে, সেটাও কাটিয়ে তোলার ব্যবস্থা করি। এগুলো শেখে কেউ যদি কিছু করতে পারে, তাহলে সেটা তার জন্য ভালো।

ভালো অভিনয়ের জন্য কোন বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন?

পুরোটাই শৃঙ্খলার ব্যাপার। রিহার্সেল অভিনেতার জন্য বড় জায়গা। সময়ানুবর্তী হতে হবে। অন্যের সঙ্গে ডায়ালগ থাকলে আগে থেকেই পারস্পরিক সম্পর্কগুলো খুব মজবুত করতে হবে। যেদিন আমার পারফরম্যান্স থাকে, সেদিন আমি কথা কম বলি, ফোন করি না। সরে গিয়ে অন্য কাজ করলে মনোসংযোগ নষ্ট হয়। রিহার্সেল রুমে প্রবেশমাত্রই আমি নাটকে ঢুকে যাই, এজন্য কনসেন্ট্রেশন খুব দরকার। মঞ্চে ঢোকার মুহূর্তে অবশ্যই শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। মানসিক, দৈহিক একাগ্রতা থেকে শুরু করে সব কিছুতেই মেডিটেশনের মাধ্যমে গভীর মনোযোগ তৈরি করতে হবে।

কারো কারো পারফরম্যান্সের সময় এমনও হয় যে, সে শব্দ বা সংলাপ ভুলে যায়। যেটা অন্যের জন্য ‘কিউ’ ছিল। ‘কিউ’ হারিয়ে যায়, লাইভ পারফরম্যান্সে এটা হবেই। মঞ্চেই এটা রিকোভার করতে হবে। একটা গল্প বলি টেম্পেস্ট নিয়ে। আমরা টেম্পেস্ট রোমে নিয়ে যাই। একজন ‘প্রসপারো’ করছিল, আমি করছিলাম ‘এরিয়াল’-এর চরিত্র। সব রকমের আধুনিক সুবিধাসংবলিত বড় হল দর্শকে পরিপূর্ণ। প্রসপারো খানিকটা নার্ভাস হয়ে পড়ল। আমি এরিয়াল, ঘূর্ণি নাচন নিয়ে যখন মঞ্চে ঢুকলাম তখন এরিয়ালের একটা ডায়ালগ ছিল ‘জাহাজডুবির ঘটনা কী বল?’ ওমা, সে ডায়ালগ ভুলে গেছে, ওটা ছিল আমার ‘কিউ’। ‘কিউ’ না পেয়ে আমি তো জাহাজডুবি বর্ণনা করতে পারছিলাম না। আমি কিউ’র আশায় নেচেই চলছিলাম আর ইম্প্রোভাইজ করছিলাম ‘প্রভু, কি জানতে চান, বলুন’। সে ‘কিউ’ দিচ্ছে না। একসময় পেছন থেকে সে হঠাৎ বলে ফেলল ‘শাবাশ এরিয়াল’। মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছে কথাটা। আমি পরম আকাক্সিক্ষত কিউটা ধরে নিলাম, রিপ্লাই করলাম। ওর চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করল, বুঝল কত বড় মিসটেক করেছে। মঞ্চের অভিজ্ঞতা আমার এ রকমই। পরের দিনও টেম্পেস্টের শো। রাতে তার সঙ্গে বারবার রিহার্সেল করতে হয়েছে। পরদিনের শো-ও ভালো হয়েছে।

তার মানে একজন অভিনেতার জন্য রিহার্সেলের বিকল্প নেই। তাই তো?

হ্যাঁ, তাই। বেইলি রোডে মহিলা সমিতির মঞ্চে আমাদের ঢাকা থিয়েটারের শো-র আগে গ্রিন রুমে যার সঙ্গে যার ডায়ালগ ছিল আমরা দুজন দুজন করে রিহার্সেল করতাম, আস্তে আস্তে সংলাপ আওড়াতাম। আমি এটা বেশি করেছি আসাদের সঙ্গে (রাইসুল ইসলাম আসাদ)। অনেক কিছু অন স্টেজ রিকোভার করতে হয়। মজা আছে। দর্শকের উষ্ণতা, নিশ^াস-প্রশ্বাসের শব্দ পাওয়া যায়, তাদের হাসি কান্নার শব্দ শুনতে পাই। টেলিভিশন নাটকে এটা পাইনি। মঞ্চের এ জিনিসটাই আমাকে টানে।

সেলিম আল দীন বাংলা নাটকের প্রবাদ পুরুষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-পরবর্তীকালে তাকে সফল নাট্যকার বলা চলে। এ ব্যাপারে আপনার কী মন্তব্য?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেখানে শেষ করেছেন, সেলিম ভাইয়ের শুরুটা সেইখানে। সেলিম ভাই ঔপনিবেশিক মানসিকতাকে ঘৃণা করতেন। তিনিই বাংলা নাটককে ঔপনিবেশিকতার আগল ভেঙে বের করে এনে বাংলা নাটককে মুক্ত করলেন। বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য অন্বেষণ করে বাংলা নাটককে স্বকাল আর স্বভূগোলের ওপর দাঁড় করালেন। এখানেই তিনি আলাদা হয়ে গেলেন। হয়ে উঠলেন বিশিষ্ট।

সেলিম আল দীন চলে যাওয়ার পর বাংলা নাটকের একটা নীরব সংকট তৈরি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। অনেকে বলেন, একটি নক্ষত্রের পতন। আপনি কী মনে করেন? এখন যারা আছেন তাদের কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

সেলিম ভাইয়ের কাছাকাছি কাউকে পাই না। তার ভাষাটাই আলাদা। যেটা একটা নেশার মতো। আমরা যে অভিনয় করতাম, এখনো করি। সেলিম ভাইয়ের যে সংলাপ বলি, সেটা একটা নেশার মতো। আমার নাটক করার পেছনে সেলিম আল দীনের বলাও একটা কারণ। মানে এত সমৃদ্ধ ভাষা, এত সুন্দর বাংলা। এটা বলতে পারাটাও আমার কাছে মনে হয় একটা বড় সুযোগ। তো আমি সেলিম ভাইয়ের ধারে কাছে কাউকে ফেলতে পারব না।

এখন যারা কাজ করছেন তাদের মধ্যে কাদের কথা বলবেন?

এখন তো মাসুম ভালো লিখছে। ভালো করছে। পাভেল আজাদ ভালো করছে। ও ডিরেকশন অনেক ভালো করছে। লেখেও ভালো। এরা তো আছেই। আর আমাদের গ্রাম থিয়েটারের যে সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না। ও কিন্তু খুব ভালো লেখে।

আপনি বোধ হয় এখনও কোনো নাটক লেখেননি...

না, অসম্ভব। এটা আমার দিয়ে হবে না। তবে কাজ করতে করতে বিশেষ একটা অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় কোনটা কেমন হচ্ছে।

যারা মঞ্চের বা টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখছেন তাদের কোন বিষয়গুলো বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার বলে আপনি মনে করেন?

সৌন্দর্য। সব কিছুরই একটা সৌন্দর্য আছে। শিল্পের সৌন্দর্যের বিষয়টা আসলে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। মানে টেলিভিশনে এখন যেসব নাটক হয়, ভাষার দিক থেকে আমি দেখতে পারি না। এত স্ল্যাং, এত ভাঁড়ামো, এত কমেডি! সব সময় তো ভালো লাগে না। প্রতিটা জিনিসই এ রকম। শিল্প আসলেই একটা সৌন্দর্যের ব্যাপার। আমি যদি বলি, শিল্প কাকে বলে? সব মিলিয়ে একটা সৌন্দর্য খুঁজে পেতে চাই, তাই না? পেইন্টিং বলেন, গান বলেন, নাচ বলেন, অভিনয় বলেন, নাটক বলেন, সাহিত্য বলেন, সৌন্দর্যের ভেতর দিয়েই তো তাকে ফুটিয়ে তোলা হবে। সেখানে যদি সৌন্দর্যেরই অভাব থাকে তার শিল্প যোগ্যতা কোথায়?

কিছু সময়ে জন্য আবারও সেই ছোটবেলায় ফিরে যেতে চাই। তখনকার বৈশাখ উদ্যাপন কীভাবে হতো? মনে আছে নিশ্চয়ই?

আমার শৈশবে বৈশাখটা কিন্তু বাসাকেন্দ্রিক। বাসাকেন্দ্রিক মানে আমরা ভাই বোনরা সবাই মিলে নাচ-গান করতাম। সবাই তো জানে। আর আমার একদম বড় ভাই রুহুল আলম বিল্লাহ বড়দার জন্মদিন ছিল ২৪শে বৈশাখ। তো প্রতি বছর আমরা ওই যে বাসা থেকে চৌকি, টেবিল নিয়ে ঠিক বাড়ির পাশে মাঠে মঞ্চ করতাম। মায়ের শাড়ি দিয়ে প্যান্ডেল করতাম। প্রতিবার ঝড় আসত। ঝড়ে সব উড়িয়ে নিয়ে যেত। মা লাঠি নিয়ে সবগুলোর পেছনে দৌড়াতো।

আর যখন তরুণ, তখন?

তখন তো রমনা পার্কে হল। ছায়ানটের অনুষ্ঠান। আমি ছায়ানটের স্টুডেন্ট ছিলাম। তখনো আমরা বৈশাখ ওভাবে করিনি। ছায়ানটের বৈশাখী অনুষ্ঠানটা স্বাধীনতার পর থেকে তো শুরু হলো। ওখানে যেতাম ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে।

একটা সময় টেলিভিশন নাটকের বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদ যে সময়টায় নাটক লেখা শুরু করলেন। কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার এমনকি সংসপ্তকের মতো জনপ্রিয় নাটক ছিল। এখন নাটকের জনপ্রিয়তা কমছে বলে অনেকে মন্তব্য করেন। এ ক্ষেত্রে কাহিনি, নির্মাণকে অনেকে দায়ী করেন। আপনি কী মনে করেন?

অনেকাংশে সত্যি কথা। হুমায়ূন আহমেদের নাটকের মধ্যে আলাদা একটা চার্ম ছিল। সৌন্দর্য। তিনি হাস্যরসাত্মক কথা বলতেন কিন্তু তার মধ্যেও একটা সৌন্দর্য ছিল। আমরা খুব মজা পেতাম। উনি খুব সুন্দর করে রসিকতা করতেন। তো সেই মজার মজার কথাগুলোর জন্য আমরা বসে থাকতাম। অপেক্ষা করতাম। যেমন- ‘শঙ্খনীল কারাগার’। অথবা আমি যেটা করেছি তার ‘নির্বাসন’। বিষয়বস্তুতে অসম্ভব একটা গম্ভীরতা ছিল। কিন্তু কত সুন্দরভাবে সেটার উপস্থাপন করতেন, মানে লেখার উপস্থাপনা। যেমন ‘নন্দিত নরকে’। কত সুন্দর গল্প, তাই না? সব কিছু তো উপস্থাপনার ওপর নির্ভর করবে। তার লেখা যেমন ভালো, তেমনি উপস্থাপনাও ভালো ছিল। জনপ্রিয়তার কারণ এটাই। বলতে পারবেন না যে একটা নাটকে স্ল্যাং আছে, কোনো ভাঁড়ামো আছে বা কোনো কিছু যেমন তুই রাজাকার। তারই ধারাবাহিক ‘আজ রবিবার’-এ ‘তুই রাজাকার’ শব্দটা একটা ময়নাকে দিয়ে বলানো। এভাবে একটি শব্দকে, স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিকে আইডেন্টিফাই করা হয়েছে। কাজেই হুমায়ূন আহমেদ সেই জায়গায় শ্রেষ্ঠ। আমাদের সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে আমরা যে আনন্দ উদ্যাপন করি, কীভাবে করি, খুব অল্পতে করি, খুব সামান্যতে খুশি হই- এ জিনিসগুলো হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টির মধ্যে ছিল। যে কারণে তিনি এভাবে আমাদের মধ্যে জনপ্রিয়।

গেরিলা সিনেমা তৈরির সময় আপনি ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা কেমন?

না, একদম না। বাচ্চুর সঙ্গে আমি থাকতে পারিনি। কারণ ও শুটিং করেছে আলাদা। ঢাকার বাইরে। আমি মিউজিক করেছি আলাদা, ঢাকায় বসে। আমি কখনো কাজের সময় কাউকে বিরক্ত করি না। সেটা বাচ্চু হোক আর আমার মেয়ে হোক। ওর রংপুরে শুটিং। শেষ করে প্রায় দেড় মাস পরে এলো। ঢাকায় শুটিং হয়েছে ১০ দিন। সোনারগাঁয়ে। মাঝে মাঝে দু-এক দিন গিয়েছি দেখতে। তাও নিয়মিত না। কিন্তু আমি জানতাম। যেহেতু স্ক্রিপ্টটা আমার কাছে ছিল। কীভাবে সংগীত করা যায়, কসটিউমটা কী হবে। বিষয়বস্তু আমার খুব কাছ থেকে দেখা তো। তাই কসটিউম করতে বেশি কষ্ট হয়নি। আমার ভাইবোনেরা যেমন কাপড় পরতাম, মা যে রকম শাড়ি কাপড় পরতেন, সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছি। আমি ওই রকম পোশাকই দিয়েছি গেরিলাতে। কারণ কসটিউম আর মিউজিক তো আমার দায়িত্বে ছিল। আমার করতে খুব একটা কষ্ট হয়নি। আসলে ‘গেরিলা’ বাচ্চুর মানসিক শান্তির জন্য করা। মূলত বাংলাদেশের মেয়েরা নিগৃহীত ছিল, তাদের জন্য এটা করা। এটা ওর প্রশান্তির জন্য।

গেরিলাতে আপনি আপনার জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলো পোশাকের মাধ্যমে তুলে এনেছেন?

একদম। একেবারে স্পষ্ট। কারণ একাত্তরের স্মৃতি ছাড়া তো আমার কোনো স্মৃতিই নেই। তবে অনেক চ্যালেঞ্জও ছিল। একটা কমন সিনে ৪০০ লোক আছে। ২৬ মার্চ গণহত্যার পর যে লাশগুলো পড়ে থাকে। সাড়ে ৪০০ লোক শোয়া! তাদের কস্টিউম আমার করা। এগুলো ব্যক্তিকে ধরে ধরে করা। চেহারা, পেশা, ধর্মীয় ভিন্নতা অনুযায়ী প্রতিটি কস্টিউমই আলাদা। কস্টিউমগুলো এখনো সংরক্ষিত আছে, কত দিন থাকবে জানি না। পুরোনো দেখানোর জন্য কেমিক্যাল প্রসেস করা হয়েছে। যেমন ধরো একটা উদাহরণ- দৈনন্দিন জীবনের কাপড়গুলো পুরোনো হবে, এটা ডিরেক্টর বলে দিয়েছেন। ৩-৪ দিন চায়ের মধ্যে চুবিয়ে রাখা হয়েছে। তখন বর্ষাকাল ছিল, সারা রাত শুকাতে হয়েছে।

কিছু পোশাক বাংলাদেশ আর্মির, পুরোনোগুলো পাঞ্জাব রেজিমেন্ট থেকে নেওয়া হয়েছে। ব্যাজ, স্টার, এগুলো আমরা সংগ্রহ করেছি। আমরা ওদের কমিটমেন্টে মুগ্ধ। গোলাগুলির পর ঝোপঝাড়, কাদা, জঙ্গল থেকে প্রতিটা খোসা খুঁজে বের করা হয়েছে। গুলি আমরা বাংলাদেশ আর্মির কাছ থেকে কিনেছি। খোসা ফেরত দিতে হয়েছে, না হলে যে ওদের চাকরি চলে যাবে। আমরাও খুঁজে দিয়েছি।

আপনাদের মেয়ে এশা ইউসুফের কথা বলছিলেন। তিনি কী করছেন?

পড়াশোনা করেছে মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনে। ওর বাবার মতোই ওর স্বপ্ন। প্রডিউসার হবে। ও এখন এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার হিসেবে কাজ করছে। আয়নাবাজি সিনেমায় ও কাজ করেছে। ওটাই শেষ কাজ। আরো আসছে বোধ হয় দু-চারটা।

বাবা-মাকে দেখেই কি এ অঙ্গনে থেকে যাওয়া?

ও কিন্তু অভিনয় করে। ‘ধাবমান’ নাটকের মূল চরিত্রে অভিনয় করে। সোহরাব। ও খুব ভালো অভিনয় করে। টেম্পেস্টে ও মিরান্ডার চরিত্র করেছে। রাজকুমারীর চরিত্র করেছে। মা বলে বলছি না, ও মঞ্চে নিয়মিত হলে ওর সমকক্ষ হতে মানুষের সময় লাগবে। ও ছোটবেলা থেকে সেলিম আল দীনের কোলে বড় তো। ও ধারণ করে সেলিম আল দীনকে। কাজেই আমি সেলিম আল দীন বোঝানোর জন্য ওকে আলাদা নিয়ে বসতে হয় না। ও পড়লেই বুঝতে পারে। ছোটবেলায় কোলে কোলে বড় তো। যখন উইংসের পাশে বসা থাকত, ওর অনেক ডায়ালগ মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। ‘যৈবতী কন্যার মন’ নাটক ওর পুরো মুখস্থ। ওকে আলাদা করে তৈরি করতে হবে না।

আপনি তাকে মঞ্চের ব্যাপারে কতটুকু উৎসাহ দেন?

আমি কোনো কাজের কথাই বলি না। ওই যে আমার একটা কথা, মানুষের একটাই জীবন, স্বাধীনতা আছে। ওর যখন যেটা ভালো লাগে ও সেটাই করে। আমাকে কেউ কিছু চাপিয়ে দিলে পছন্দ করিনি বা করি না। তেমনি আমার মেয়েকেও কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না।

একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর পরও আপনার পারিবারিক জীবন আছে। সংসার আছে। রান্নাবান্না করেন?

একটা সময় করতাম। এখন করি না। সময় হয় না। (এক গাল হেসে) আমি কিন্তু বিক্রমপুরের বাবুর্চি। বাড়ি তো বিক্রমপুর। বাচ্চু বলে আমি তো বাবুর্চি ঘরে নিয়ে এসেছি। তো ভালো খাব।

একজন ক্রিয়েটিভ মানুষ স্বাধীন হবেন- এটাই স্বাভাবিক। আপনিও নাসির উদ্দীন ইউসুফ কিংবা এশা ইউসুফকেও স্বাধীন দেখতে পছন্দ করেন। এ থেকে অন্যদের শেখার আছে বটে।

আসলে শিল্পের তো কোনো বাধা-নিষেধ থাকা উচিত নয়। বাধা-নিষেধ থাকলেই এটা একটা আবদ্ধ হয়ে যাবে।

ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। জাহানারা ইমামের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্কটা কেমন ছিল?

বুবু (জাহানারা ইমাম) আমার মাকে ডাকতেন রাঙা মা। আমার মা তো অসম্ভব সুন্দরী ছিলেন। এতই সুন্দর যে বুবু রাঙা মা বলে ডাকতেন। আমরা সেই হিসেবে বড় বুবু বলে ডাকতাম। তো যুদ্ধের সময় রুমি মামা ধরা পড়ার পরে আমাদের এ দুই বাড়ি এক হয়ে গেল। কারণ রাতে রুমি মামা ধরা পড়লেন। আর সকালে আলতাফ ভাই ধরা পড়েছেন। ক্র্যাক প্লাটুনে ছিলেন সবাই। তখন আমরা দুই পরিবার মানে একটি পরিবার হয়ে গিয়েছিলাম। বুবুর দুঃখ-কষ্ট যা আছে মায়ের কাছে এসে বলতেন।

লেখালেখিতে আপনার আগ্রহ কেমন?

আসলে সেলিম ভাইয়ের নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখতে লিখতেই আমার সময় চলে যায়। ওই যে স্ক্রিপ্টিং করা আর কি। আমাকে প্রচুর খাটতে হয় আসলে। আমার আলাদা করে আর কোনো কিছু লেখার সময় হয় না। লিখব লিখব ভেবেও লিখি না।

আপনার তো অনেক কিছু লেখার আছে। এ জগতে যারা নতুন আসবে তারা আপনাকে জেনে অনুপ্রাণিত হবে।

না, আমার তা মনে হয় না। আমি কেন লেখব? আমাকে নিয়ে অন্যরা লেখবে। আমি তো ওইটাই চাচ্ছি। কিন্তু আমি জানি না আমি কতটুকু দিতে পারছি। নিজের সম্পর্কে আসলে বলার তো কিছু নেই তো। কী বলব? এখনো তো কাজ করছি। এন্ড অব দ্য ডে বোঝা যাবে যে আমি কী করেছি।

বই পড়ে অভিনয় শেখা যায় বলে মনে করেন?

বই পড়ে আমি অভিনয় শিখিনি। আমার চর্চার ভেতর দিয়ে আমি নিজেকে বের করে নিয়ে আসি। অভিনয়ের ক্ষেত্রে স্তানিস্লাভস্কি বা পিটার ব্রুকের বই হয়তো সাহায্য করে। জানার জন্য নাটকের বই পড়া যায়। সেলিম আল দীনের নাট্য অভিধান পড়লে উচ্চারণ এবং অনেক শব্দ জানা যায়। দু’বাংলা মিলিয়ে নাট্যভাষার ওপর এটিই একমাত্র বই। আমি সব সময় অভিধান ঘাঁটি। নতুন নতুন শব্দার্থ জানা বোঝার জন্য, আমার অভিনয়ে প্রয়োগ করার জন্য, স্টেজে আমার অভিনয়কে মূর্ত করার জন্য। ভালো অভিনয়ের জন্য এটা করতেই হবে। সেলিম ভাই বলতেন, ‘তোরা অভিধান দেখিস না কেন!’ অভিনয়ের ব্যাপারটাই শব্দের অর্থ বোঝার। আমার বাংলা সাহিত্য, উপন্যাস পড়া আছে ছোটবেলা থেকেই। আমার নিজের ভাষার ওপর যদি দক্ষতা না থাকে, তাহলে অন্যের ভাষা আমি কী করে বুঝব!

ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা আছে নিশ্চয়ই। কী কী করতে চান?

হ্যাঁ। বিনোদিনী তো একশো তেইশটা হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম দেড়শ করে এটাকে সেলিব্রেট করব। কিন্তু শারীরিক সমস্যা হওয়াতে আমি তো প্রায় চার মাস বিশ্রামে আছি। ডাক্তার ছয় মাস বিশ্রামে থাকতে বলেছে। এ বাধাটা চলে গেলে আমি আবার শুরু করব। আর যতটা পারি করব। হয়তো দেড়শ হবে না। পঁচিশ, ত্রিশটা হলেও তো হলো, তাই না? অন্তত পঁচিশটা তো থাক।

নতুন নাটক কিংবা নির্দেশনার পরিকল্পনা নেই?

হ্যাঁ। নতুন নাটক করব। নির্দেশনা দেব। নতুন নাটক ধরলে তো তখন আর আমার কোনো সময় থাকবে না। এক, দেড় মাস। স্ক্রিপ্টিং করতে আমার বড় একটা সময় যায়। নতুন যেটা ধরার ইচ্ছা আছে সেটা হলো- সেলিম আল দীনের একটা অটোবায়োগ্রাফি। দিনলিপি। দিনলিপি থেকে আমি তিনটা নাটক বের করার চেষ্টা করছি। তার জীবনের ওপরে। সেটার জন্য আমার প্রচুর সময় দিতে হচ্ছে। পড়ে ওটা এখন মোটামুটি মুখস্থ। তারপরও আমার মনে হয় ওটা আমার কম্পাইল করতে হবে। এটা একক করব, নাকি ক্যারেক্টার আনবÑ এটা এখনও ঠিক হয়নি। এ জিনিসগুলো নিয়ে আমি বাচ্চুর সঙ্গে বসিনি। তবে বসব। নির্দেশনা কী আঙ্গিকে করব, সেটা ঠিক করতে হবে। আবার বাচ্চু আমার কাজ সম্পর্কে ওকে জিজ্ঞেস করলে পছন্দও করে না। ও কিছু বলতে চায় না। বলবে হয়তো, ‘তোমার কাজ তুই করো।’ ধাবমানেও তা-ই করেছে। ও রিহার্সেল রুমে ঢোকেইনি। যদি কেউ বলে শিমূলের নাটক বাচ্চু করে দিয়েছেÑএ জন্য। এ জন্যই দূরে থাকে।

তিনি (নাসির উদ্দীন ইউসুফ) কি নতুন কোনো চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করছেন?

হ্যাঁ। ওর একটা কাজ তো প্রায় দুই বছর হয়ে গেল শেষ হয়ে গেছে। ‘আলফা’। এটা রিলিজ করবে আগে দেশের বাইরে। ‘আলফা’ একেবারে অন্য রকম। এটা ট্রান্স জেন্ডারের ওপরে। ফিজিক্যালি ছেলেমেয়ের ব্যাপারটা। ছেলেরা যে নিজেদের কখনো মেয়ে ভাবে আবার মেয়েরা নিজেদের কখনো ছেলে ভাবে। খুব কম্পিøকেটেড একটা বিষয়। এটা নিয়ে তেমন একটা বেশি কাজও হয়নি। এটা ওরই লেখা। ওরই স্ক্রিপ্ট। তবে এটা শেষ হয়েছে।

(বসার ঘরে) এই পোর্ট্রেট থেকে চোখ সরানো যাচ্ছে না। রঙ তুলিতে আপনাকে বেশ ফুটিয়ে তুলেছে। কে এঁকেছেন?

হা হা হা। এটা বিকাশ এঁকেছিলেন। লেখা আছে নিচে। ও খুব ভালো ছবি আঁকে। প্রোফাইল পিকচার তোলে মানে পেইন্টিং।

অনেক সময় দিলেন। কিন্তু মনে হচ্ছে আরও কিছু শোনার বাকি।

আমার একটু উঠতে হবে। আজ থাক।

ঠিক আছে। আর বিরক্ত করছি না। এতটা সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

ভালো থেকো।

সংবাদটি শেয়ার করুন

সাক্ষাৎকার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

সাক্ষাৎকার এর সর্বশেষ

‘স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনীতির স্বার্থে সরকারকে ভারসাম্যমূলক নীতি-উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে’: ড. আতিউর রহমান

প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল আর্মিরা ধরে নিয়ে যাবে: ফরিদা খানম সাকি

দাম বাড়ালে এতক্ষণে কার্যকর হয়ে যেত: ক্যাব সহ-সভাপতি নাজের হোসাইন

জন্ম থেকেই নারীদের যুদ্ধ শুরু হয়: নারী উদ্যোক্তা ফরিদা আশা

নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই

ভবন নির্মাণে সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র নেওয়ার নিয়ম করা উচিত: কাউন্সিলর আবুল বাশার

তদারকি সংস্থা এবং ভবন নির্মাতাদের দায়িত্বশীল হতে হবে: অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান

বেইলি রোডের আগুনে রাজউকের ঘাটতি রয়েছে: মো. আশরাফুল ইসলাম

নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে ভবন অনুমোদন দিতে হবে: ইকবাল হাবিব

বীমা খাতে আস্থা ফেরাতে কাজ করছি: আইডিআরএ চেয়ারম্যান জয়নুল বারী

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :