ভ্রমণ

মধ্যরাতে মধ্যপ্রদেশ

গাজী মুনছুর আজিজ
 | প্রকাশিত : ২৭ জুন ২০১৭, ১০:১৩

নান্দনিক স্থাপত্যের জন্য সারা পৃথিবীর শিল্পরসিকদের কাছে পরিচিত খাজুরাহোর মন্দির। এ মন্দিরের রাজ্যেই প্রতি বসন্তে অনুষ্ঠিত হয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের বর্ণাঢ্য উৎসব। এ উৎসব ও মন্দির দেখতে অসংখ্য পর্যটক হাজির হন খাজুরাহোতে। বাংলাদেশ থেকে রওনা হতেই নিজেকে তাদের তালিকায় যেন দেখতে আকুল হলো মন।

ট্রেন থেকে যখন নামি, তখন জাবলপুর স্টেশনের ঘড়িতে রাত ২টা। মধ্যরাতে ভারতের এ মধ্যপ্রদেশ রাজ্যে আপাতত আমার কোথাও যাওয়ার নেই। আমার পরবর্তী স্টেশন সাতনা। স্টেশনের তথ্য অনুযায়ী সে ট্রেন ছাড়বে সকাল ৭টা ২০ মিনিটে। তাই স্টেশনের ওয়েটিং রুমের চেয়ারে পিঠ হেলিয়ে দিই। ৭টার দিকে মুখ ধুয়ে স্টেশনের টি-স্টল থেকে চা খাই, সঙ্গে বিস্কুট। তারপর টিকিট কেটে উঠি ট্রেনে।

লোকাল ট্রেন। ভিড় বেশি। পারলে একজন আরেকজনের কোলে বসেন অবস্থা। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। যে যার পাশে ইচ্ছে ঠাসাঠাসি করে বসছেন। মাথার উপর যেখানে মাল-সামান রাখার জায়গা, সেখানেও বসছেন রীতিমতো গায়ে গা মিশিয়ে। আমার ডানে-বামেও দুইজন নারী বসেছেন। একজন সদ্য মা হয়েছেন, কোলে অল্প বয়সের বাচ্চা। আরেকজন বয়স্ক। খুব সম্ভবত তিনি সদ্য মায়ের শাশুড়ি অথবা মা। এরই মাঝেই কোনোমতে বসে আছি। এ ভিড়ের ভেতরও হকার আসছেনÑ চুড়িঅলা, মালাঅলা, নানা ধরনের খাবারঅলা। চায়ের কেতলিঅলাও আসেন চা নিয়ে। কী আর করা, বসে আসি তাই আরেক কাপ চা খাই অনটাইন কাপে।

একটা স্টেশন আসলে লোক যা নামেন, তার চেয়ে বেশি ওঠেন। ফলে ভিড়ও বাড়তে থাকে। প্রায় ঘণ্টা চার পর আসি সাতনা স্টেশনে। মধ্যপ্রদেশের জেলা শহর সাতনা। স্টেশন থেকে অটোতে আসি বাস স্ট্যান্ড। তারপর উঠি লোকাল বাসে। উদ্দেশ্য খাজুরাহো নৃত্য উৎসব, সঙ্গে বহুল পঠিত খাজুরাহো মন্দির দর্শন। এ মন্দিরের পাশেই চলছে নৃত্য উৎসব। বাংলাদেশের ‘সাধনা’ উৎসবে যোগ দিয়েছে অতিথি রাষ্ট্র হিসেবে। নৃত্যের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ ৩২ জনের এ ‘সাধনা’ দলের নেতৃত্ব দেন সাধনার শিল্পনির্দেশক লবুনা মারিয়াম। সংবাদ সংগ্রহের জন্য সাধনার এ দলে বন্ধু রাসেল মাহমুদও আছেন। তারা এসেছেন উৎসব শুরুর আগে। মূলত রাসেল মাহ্মুদের সঙ্গে খাজুরাহো মন্দিরের পাশে বসে এককাপ চা খাবো বলেই এ সফর।

সাতনা শহর ছেড়ে বাস কিছুটা আসলেই শুরু হয় ধুলার পথ। এবড়োখেবড়ো পথ। এ পথে বাস চলে হেলেদুলে। আর কিছুক্ষণ পরপরই আসে স্টপেজ। ঢাকার তেরো নম্বর গাড়ির মতোই। দাঁড়ানো যাত্রীরও অভাব নেই। দেখি সাধু টাইপের দাঁড়ানো এক যাত্রী সবাইকে নারকেলের ছোট ছোট টুকরা দিচ্ছেন। সবাই তা সঙ্গে সঙ্গে ভক্তি করে মুখে পুরছেন। আমাকেও দিয়েছেন, কিন্তু আমি আর সাহস করে মুখে না পুরে হাতেই রাখি।

বাসের কন্ডাক্টর জানান, সড়ক পথে সাতনা থেকে খাজুরাহোর দূরত্ব ১১৪ কিলোমিটার। সময় লাগবে চার ঘণ্টার মতো। ঘণ্টাখানেকের বেশি চলার পর বাস যে পথ দিয়ে এখন চলছে সে পথের অবস্থাও নাজুক। পথের দুই পাশে বাড়িঘর খুব কমই দেখি। গ্রাম আছে, তবে ঘনবসতি নেই। ফসলি জমিতে ধান বা গম জাতীয় ফসল আছে। প্রায় তিন ঘণ্টা পর বাস এসে থামে পান্না শহরের বাজারে। এখানে কিছু যাত্রী নামেন। আবার কিছু যাত্রী ওঠেন। পান্না মধ্যপ্রদেশের একটি জেলা শহর। পান্না নামের কারণ জানতে চাইলে মধ্যবয়স্ক পাশের যাত্রী জানান, এ জেলায় পান্নার খনি আছে, সেজন্য এ জেলার নাম পান্না।

দশ মিনিট বিরতি শেষে পান্না বাজার থেকে বাস আবার চলতে শুরু করে। কিছুক্ষণ চলার পরই দেখি দুই পাশে বন। তার মাঝ দিয়েই বাস চলছে। দেখি পথের দুই পাশেই বসে আছে অসংখ্য বানর, মুখপোড়া হনুমান ও চশমাপরা হনুমান। বনের এ পথটি বেশ লম্বা। অনেকক্ষণ ধরেই পথের দুই পাশে এসব বানর ও হনুমান দেখি। বনের ভেতরও একগাছ থেকে আরেক গাছে চলাফেরা করতে দেখি অনেক বানর ও হনুমানকে। পাশের যাত্রী জানালো এ বনে এসব অনেক আছে। বনের ভেতর থেকে পাখির কিচিরমিচিরও শুনি।

প্রায় চার ঘণ্টা চলার পর বাস এসে থামে খাজুরাহো যাওয়ার পথের মুখে। কিন্তু আমি বসেই আছি। খাজুরাহো বলে বাসের কন্ডাক্টর ডাকলেও আমি বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারলাম তখন, যখন বাস স্টপেজ ছেড়ে পাঁচ মিনিটের পথ অতিক্রম করেছে। তাই বাধ্য হয়ে পরের স্টপেজে নেমে আবার উঠি খাজুরাহো যাওয়ার লোকাল বাসে। পাঁচ মিনিটেই আসি আগের স্টপেজে, যেখানে নামার কথা ছিল। এবার আর নামি না, কারণ এ বাসই যাবে খাজুরাহো। চালক জানালেন এখান থেকে খাজুরাহোর দূরত্ব প্রায় ১১ কিলোমিটার।

খাজুরাহোর এ পথটি সত্যিই সুন্দর। পথের দুই পাশে বড় বড় গাছ। পথের মাঝেও বড় বড় গাছ আছে। মূলত মাঝের এ গাছ রোড ডিভাইডার হিসেবে কাজ করছে। আর পথের দুই পাশেই গমক্ষেত। জনবসতিও খুবই কম। অনেকটাই ছিমছাম-নিরিবিলি। পথের দুই পাশে মাঝেমধ্যে আবাসিক হোটেল চোখে পড়ে। পর্যটকদের জন্যই এ ব্যবস্থা। দশ মিনিটের মাথায় আসি খাজুরাহো বাসস্ট্যান্ডে। ততক্ষণে বিকেল প্রায় শেষ।

বাসস্ট্যান্ডের টি-স্টলে চা খাই, সঙ্গে হালকা নাশতা। তারপর হেঁটে আসি খাজুরাহো মন্দিরগুলোর কাছে। বাসস্ট্যান্ডের কাছেই মন্দিরগুলো। এ মন্দিরগুলোর পাশেই চলছে নৃত্য উৎসব। উৎসবে প্রবেশ করে প্রথমে আসি বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে। প্যাভিলিয়নের মঞ্চে তখন বাংলাদেশের শিল্পীরা মনিপুরি নৃত্য পরিবেশন করছেন। নৃত্য শেষ হলে দেখা হয় রাসেল মাহ্মুদ ও লুবনা মারিয়ামের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে কথা শেষে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের গ্যালারি ঘুরে দেখি। গ্যালারিতে ‘সাধনা’ তুলে ধরে বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের নদীর বর্ণনা, মসলিন, জামদানিসহ তাঁতের ইতিহাস, গাজীর গান ও পটগানসহ লোকসংস্কৃতির কথা, কাঁসা-পিতল, কাঠ-বাঁশ, মৃৎশিল্পসহ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিভিন্ন নমুনা। গ্যালারি দেখে রাসেল আর আমি বের হই উৎসব প্রাঙ্গণ ঘুরতে।

উৎসব উপলক্ষে এখানে মেলা ও প্রদর্শনী চলছে। মধ্যপ্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের তাঁতের কাপড়সহ নানা ধরনের হস্তশিল্পের প্রদর্শনী ও বিক্রয় চলছে। এছাড়া বিভিন্ন নাচের পোশাকের প্রদর্শনী ও চিত্রকলা প্রদর্শনীর প্যাভিলিয়নও আছে।

নান্দনিক স্থাপত্যের জন্য সারা পৃথিবীর শিল্পরসিকদের কাছে পরিচিত খাজুরাহোর মন্দির। এ মন্দিরের রাজ্যেই প্রতি বসন্তে অনুষ্ঠিত হয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের বর্ণাঢ্য আসর। ভূপালের ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান সংগীত ও কলা একাডেমি সপ্তাহব্যাপী আন্তর্জাতিক এ উৎসবের আয়োজন করে। খাজুরাহো গ্রুপ অব মনুমেন্টসের পাশেই এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এবার ছিল এ উৎসবের ৪৩তম আয়োজন। বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো এ উৎসবে অংশগ্রহণ করে।

ঘুরে ঘুরে মেলার বিভিন্ন পণ্য দেখে আসি উৎসবের মূল মঞ্চের সামনে। মঞ্চে তখন নৃত্য পরিবেশন করেন শিল্পী রুক্সিনী বিজয় কুমার। সত্যিই তার নাচ দারুণ।

ছবি: লেখক

(ঢাকাটাইমস/২৭জুন/এজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :