রবীন্দ্রনাথের বনবাণীর উদ্ভিদরাজি
বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলীর পঞ্চদশ খ-ে পাওয়া যাবে বনবাণী কাব্যগ্রন্থ। রবীন্দ্র রচনাবলীর সুবিশাল পরিম-লে এতটা বৃক্ষস্তুতির পরও কবি কেন আলাদা করে বনবাণী রচনা করেছেন এই প্রশ্নের অনেকগুলো উত্তরের মধ্যে একটি এমন যে, তিনি অনেক ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, বনবৃক্ষ ছাড়া আমাদের একমুহূর্তও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
শুধু অনুধাবনই নয়, তিনি বিশ্বাসও করতেন, আর সে কারণে অসংখ্যবার লিখেছেনও। বনবাণীর ভূমিকাংশে কবিগুরু লিখেছেন, ‘আমার ঘরের আশপাশে যে-সব আমার বোবা-বন্ধু আলোর প্রেমে মত্ত হয়ে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে, তাদের ডাক আমার মনের মধ্যে পৌঁছল। তাদের ভাষা হচ্ছে জীবজগতের আদিভাষা, তার ইশারা গিয়ে পৌঁছায় প্রাণের প্রথমতম স্তরে; হাজার হাজার বৎসরের স্কুলে-যাওয়া ইতিহাসকে নাড়া দেয়। মনের মধ্যে যে-সাড়া ওঠে সেও ঐ গাছের ভাষায়- তার কোনো স্পষ্ট মানে নেই, অথচ তার মধ্যে বহু যুগযুগান্তর গুনগুনিয়ে ওঠে।’ তিনি এভাবেই বৃক্ষদের যুগযুগান্তরের প্রতিনিধি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, তাদের মঙ্গল বারতা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন গণমানুষের কাছে।
কবিগুরু বনবাণী কাব্যগ্রন্থে ভূমিকার পরপরই বৃক্ষবন্দনা শিরোনামে একটি দীর্ঘ কবিতা লিখেছেন। যার পঙক্তি সংখ্যা ৬৬। গোটা কবিতাটিই বৃক্ষবন্দনায় উৎসর্গীকৃত। আমাদের চারপাশের সবুজ বন্ধুরা কবিকে যে মোহমায়ায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে তিনি তা অন্তরাত্মা দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এ কারণইে তিনি কান পেতে বৃক্ষের কথা শোনেন, মুগ্ধ বিস্ময়ে তাদের স্নিগ্ধ শোভা উপভোগ করেন। তাদের হাসি কান্নায় সুখ দুঃখ অনুভব করেন। দীর্ঘ কবিতায় তিনি পৃথিবীতে বৃক্ষের আদিতম প্রতিনিধিত্ব, পারিপার্শ্বিক সম্পর্ক, নান্দনিকতা, বেঁচে থাকার সংগ্রাম, জীব-জগতের অপরিহার্যতা ইত্যাদি বিষয়ে অনেক গুত্বপূর্ণ বক্তব্য তুলে এনেছেন। কবিতার প্রথম পঙক্তিতেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
‘অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান
প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদিপ্রাণ,’
কবিতার একেবারে শেষ দিকে আছে
‘ওগো মানবের বন্ধু, আজি এই কাব
অর্ঘ্য ল’য়ে
শ্যামের বাঁশির তানে মুগ্ধ কবি আমি
অর্পিলাম তোমায় প্রণামী।’ [শান্তিনিকেতন, ৯ চৈত্র ১৩৩৩]
পরের কবিতাটি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে নিবেদিত। বৃক্ষের প্রতি যাঁর দরদ ছিল অন্তহীন, কবি তাঁকে ভুলেননি। দীর্ঘ কবিতায় ব্যক্ত করেছেন নিজের অনুভূতি। এই কবিতাটিও তিনি শান্তিনিকেতনে বসে লিখেছেন। তারিখ ১৪ অগ্রহায়ণ ১৩৩৫। এর পরের কবিতাগুলো অধিকাংশই বৃক্ষ শিরোনামে লেখা। প্রথমেই তিনি আলোচ্য গাছটির একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন। যাকে কাব্যাংশটির ভূমিকা নামে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। তারপর আছে কাক্সিক্ষত বৃক্ষের শিল্পিত বর্ণনা।
দেবদারু কবিতায় রবীন্দ্রনাথ দেবদারু এবং দেওদারকে একই গাছ ভেবেছেন। অবশ্য এটি নন্দলাল বসুর এক পত্রপটের প্রত্যুত্তরে লিখিত কাব্যলিপি মাত্র। রবীন্দ্রনাথ তখন শিলঙে, আর নন্দলাল কার্সিয়াঙে। শিল্পী হিমালয়ের পটভূমিতে দেওদার গাছের ছবি এঁকে কবিগুরুর কাছে পাঠালেন। তুলির আঁচড়কে কবি ভাষায় রূপ দিলেন:
‘তপোমগ্ন হিমাদ্রির বক্ষরন্ধ্র ভেদ করি চুপে
বিপুল প্রাণের শিখা উচ্ছ্বসিল দেবদারু রূপে।’ [শিলঙ, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৪]
কবি এখানে দেওদার আর দেবদারুকে একই গাছ ভাবলেও আদতে তরুদ্বয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেবদারু ছায়ানিবিড়, তাই পথতরুর আদর্শ। শাখা প্রশাখা দীর্ঘ নয় এবং বিন্যাসের একটি নির্দিষ্ট ধরন রয়েছে বলেই অনেক সময় পিরামিডাকৃতি হয়ে ওঠে, মূল কা- কখনই শাখায়নে লুপ্ত হয় না, স্বকীয় স্বাতন্ত্র্যে উদ্ধত থাকে। শুধু সবুজের ঐশ্বর্যে নয়, পাতার শ্বননেও এগাছ আকর্ষণীয়। কাঠ ততটা অর্থকরী না হলেও বাক্স, পেটরা, পেনসিল, ড্রাম ইত্যাদিতে ব্যবহার্য। এগাছের দীর্ঘ বীথি অত্যন্ত নয়নশোভন। [শিলঙ, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৪]
বনবাণী কাব্য এবং গদ্যের অপূর্ব সমন্বয়। এখানে ৮টি মূল বৃক্ষ শিরোনামে উঠে এসেছে প্রায় ২০টির মতো পুষ্প-বৃক্ষের কথা। অন্যান্য কবিতায় আছে আরো ১১টির মতো। আলোচ্য পুষ্প-বৃক্ষের প্রাসঙ্গিক উক্তি এবং সংশ্লিষ্ট ছবিগুলো এই লেখার সঙ্গে সন্নিবেশিত করা হলো।
দেবদারু
আমি যখন ছিলেম শিলঙ পাহাড়ে, রূপভাবক নন্দলাল ছিলেন কার্সিয়াঙে। তাঁর কাছ থেকে ছোট একটি পত্রপট পাওয়া গেল, তাতে পাহাড়ের উপর দেওদার গাছের ছবি আঁকা।
নীলমণিলতা
বেল জুঁই শেফালিরে
জানি আমি ফিরে ফিরে
চাঁপার কাঞ্চন-আভা সে-যে কার কণ্ঠস্বর সাধা,
নাগকেশরের গন্ধ সে-যে কোন্ বেণীবন্ধে বাঁধা।
বাদলের চামেলি-যে
কালো আঁখিজলে ভিজে,
করবীর রাঙা কঙ্কণঝংকার সুরে মাখা,
কদম্বকেশরগুলি নিদ্রাহীন বেদনার আঁকা।
কুরচি
কুরচি, তোমার লাগি পদ্মেরে ভুলেছে অন্যমনা
পারিজাতমঞ্জরিত লীলার সঙ্গিনীরূপ ধরি
চিরবসন্তের স্বর্গে, ইন্দ্রাণীর সাজাতে কবরী;
অপ্সরীর নৃত্যলোল মণিবন্ধে কঙ্কণবন্ধনে
পেতে দোল তালে তালে; পূর্ণিমার অমল চন্দনে
পণ্যের কর্কশধ্বনি এ নামে কদর্য আবরণ
রচিয়াছে ; তাই তোরে দেবী ভারতীয় পদ্মবন
শাল
বাহিরে যখন ক্ষুব্ধ দক্ষিণের মদির পবন
অরণ্যে বিস্তারে অধীরতা; যবে কিংশুকের বন
উচ্ছৃঙ্খল রক্তরাগে স্পর্ধায় উদ্যত; দিশিদিশি
শিমুল ছড়ায় ফাগ; কোকিলের গান অহর্নিশি
জানে না সংযম, যবে বকুল অজস্র সর্বনাশে
পলাশ বকুল চাঁপা, আলিম্পনলেখা এঁকে দিতে
তব ছায়াবেদিকায়, বসন্তের আবাহন গীতে
চামেলিবিতান
বাহিরেতে আমলকী
করিতেছে ঝকমকি,
বটের উঠেছে কচি পাতা
পরদেশী
আমার দেশে যে-মেঘ এসে
নীপবনের মরমে মেশে
বটের ফলে আরতি তার,
রয়েছে লোভ নিমের তরে,
বনজামেরে চঞ্চু তার
অচেনা ব’লে দোষী না করে।
শরতে যবে শিশির বায়ে
উচ্ছ্বসিত শিউলিবীথি,
শালের ফুল-ফোটার বেলা
মধুকাঙালী লোভীর মেলা,
বেণুবনের আগের ডালে
চটুল ফিঙা যখন নাচে
ঊষার ছোঁওয়া জাগায় ওরে
ছাতিমশাখে পাতার কোলে,
কুটিরবাসী
তরুবিলাসী আমাদের এক তরুণ বন্ধু এই আশ্রমের এক কোণে পথের ধারে একখানি গোলাকার কুটির রচনা করেছেন। সেটি আছে একটি পুরাতন তালগাছের চরণ বেষ্টন ক’রে। তাই তার নাম হয়েছে তালধ্বজ।
ঘাসের কাঁপা লাগে,
পাতার দোলা,
শরতে কাশবনে
তুফান-তোলা,
তাহার শিয়রেতে
তালের গাছে
বিরল পাতাকটি
আলোর নাচে,
সমুখে খোলা মাঠ
করিছে ধু ধু,
দাঁড়ায়ে দূরে দূরে
খেজুর শুধু।
মাঙ্গলিক
রবীন্দ্রের কণ্ঠ হতে এ সংগীত তোমার মঙ্গলে
মিলিল মেঘের মন্দ্রে, মিলিল কদম্বপরিমলে।