একটি বিচারহীন হত্যাযজ্ঞ

দিলরুবা শরমিন
| আপডেট : ২৯ জুন ২০১৭, ১৫:০৪ | প্রকাশিত : ২৯ জুন ২০১৭, ১৫:০০

জুলাই ১, ২০১৬ রাত ৯টা ৪০ নাগাদ দেশের বাইরে থেকে আমার ফোনে একটা কল এল। “বাংলাদেশের গুলশান এলাকায় কিছুক্ষণ আগে ভয়াবহ কিছু একটা ঘটেছে। একথা শোনার পর বিস্মিত এবং লজ্জিত হয়েছিলাম। দেশে বসে যে খবর জানিনা বাংলাদেশের ঠিক অপর প্রান্তে বসে একজন মানুষ দেশের এক ভয়ানক ও নৃশংস ঘটনা জেনে দেশের মানুষের জন্য উৎকণ্ঠিত হয়ে, উদ্বিগ্ন হয়ে কল দিয়েছে- অথচ আমি বা আমরা অনেকেই নির্লিপ্তভাবে ঠিক ঘটনাস্থলের কাছাকাছিই একটি রেস্তোরাঁয় একটি কাজের কন্ট্রাক্ট সাইন শেষে ডিনার করছি।

কি অদ্ভুত ঢাকা শহর ও তার বাসিন্দারা। পাশেই ঘটেছিল সেই ভয়ানক ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। হলি আর্টিজান বেকারি গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর রোডের এই ঘটনা আমরা জানি না? অথচ দূরদেশে বসে থাকা দেশপ্রেমিক নাগরিক গণমাধ্যমে নজর রাখায় ঠিকই জেনেছেন। এরা প্রবাসী? আমার মেয়ের কথাই মনে পড়ে গেল- “মা দেশে বাস করা মানেই দেশকে ভালোবাসা না।’

আকর্ষণীয়, নামিদামি এই হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় যে কেউ ইচ্ছা করলেই প্রবেশ করতে পারতেন না। রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া। উচ্চবিত্তের সান্ধ্যকালীন চা-পানাহারের নিরাপদ স্থান। গুলশান ২ এর ৭৯ নং সড়কে আমার জানা মতে সব উঁচু শ্রেণির নামিদামি মানুষজন থাকেন। নব্য ধনীদের সড়ক নয় ওটা। সৌভাগ্যবশত বেশ আগে আমার যাবার সুযোগ হয়েছিল হলি আর্টিজান বেকারিতে। সেখানে প্রবেশাধিকার যে কতটা জটিল, যারা আগে গিয়েছিল তারা জানেন।

অসংখ্য গোলাগুলির আওয়াজ যে আমাদের কানে আসেনি সেটা নয়। ভেবেছিলাম হোটেল রেডিসনের কাছেই প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের মহড়া চলছে। আমার সঙ্গীয় তিন আমেরিকান কিছুটা ভীত চোখে তাকাচ্ছিল, যাদের সঙ্গে সেদিনই কাজ করার চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। ‘পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা’ বিষয়ে। এর মাঝে দূর দেশ থেকে ফোন এবং আমার ফোনালাপ তারা না বুঝলেও তাদেরকে কিছুটা চিন্তিত করে দিল। আমার গলার স্বর তাদেরকে কিছু কি বুঝতে সাহায্য করল?

দূরদেশী সেই পরিচিত জনকে আমি ফোনে মিথ্যা বলেছিলাম যে আমি অন্য এলাকায় আছি। আসলে আমি অতি নিকটেই ছিলাম। কিন্তু কাউকেই আমি ভীত সন্ত্রস্ত্র করতে চাইনি। কাউকেই না। শুধু বাসায় ফোন করে বলেছিলাম, কেউ টেলিভিশন দেখবে না। আমি সময় মত ফিরে আসব। আসলে তখনো জানি না আসলেই আর বাসায় ফিরে যেতে পারবো কি না। আর কাউকে কিছুই বলিনি। এর মাঝেই একে একে দুঃসংবাদ আসতে শুরু করেছে। এরই মাঝে ইউ এস এ অ্যাম্বাসি আমার নব্য তিন পার্টনারকে সতর্ক করেছে এবং তাদের অবস্থান জানতে চেয়ে সেখানেই থাকতে বলেছে। আর তাদেরকে নিতে আসার কথাও জানিয়েছে। তারা তখন আমাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন, যা আমি মোটেও না। তার প্রথম কারণ হলো পুরো ঘটনা আমি জানি না। তারপর যা শুনছি সেটা ভয়াবহ তবে রেডিসনের কাছেই আমার অফিস। সুতরাং আমি চলে যেতে পারবো কিন্তু আমি যেটা কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না সেটা হলো, কি এমন হলো যে এই স্বল্প সময়ের মাঝে রোজা রমজানের দিনে এমন একটা জায়াগায় ম্যাস্যাকার হয়ে যাচ্ছে। রক্তাক্ত হলি আর্টিজান।

বিদেশিদের দফারফা তাদের দূতাবাসই করল। রেডিসনের রুফ টপ ফাঁকা। নীচে নেমে দেখি দ্রুত সব ফ্লোরই ফাঁকা হয়েছে মনে হয়। ইউ এস এ দূতাবাস প্রতিনিধি আমাকেও বাসায় ফিরতে সাহায্য করার কথা জানালো। আমি সবিনয়ে জানালাম আমি বারিধারাতেই থাকব। যে কোনো দুঃসময়ে আমি খুব ঠাণ্ডা হয়ে যাই। অনেকটা অনুভূতিহীন। বললাম কিন্তু আসলে আমি বারিধাতে এলাম না ।ততক্ষণে আমার মন ছুটে গিয়েছে ৭৯নং রোডের হলি আর্টিজানে এবং তার আশপাশে বাস করা আমার ২/৪ জন পরিচিত বা নিকটজনের কাছে। আমি বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত আমার পরিচিত জনদের কল দিয়ে অনিশ্চিত সংবাদের মাঝ দিয়ে নিশ্চিত মনে হোটেল রেডিসনের সামনের পথ ধরে বাসায় ফিরে এলাম। কি ঘটে যাচ্ছে সেই নরকপুরিতে? আমাদের এতগুলো বাহিনী আসলে কি কাজে লাগে এইসব আবোল তাবোল ভাবনা আমাকে কখন বাসায় এনে দিলো বুঝতেও পারলাম না।

বাসার সকলে তখনো তেমন কিছু জানে না। আমি টেলিভিশন সুইচটা অন করতেই সব খবর হুড়মুড় করে ওদের কানে এলো। নিদ্রাহীন ফোনাফুনির বিভীষিকাময় রাত।

১ জুলাই ২০১৬ সালের রাত ৯টা ২০ মিনিটের এই নির্মম, বর্বর ও নৃশংস ঘটনা শুরু থেকে শেষ অব্দি রহস্যাব্রতই থেকে গেল। কেনই বা পুলিশ নিজেই খুব যোগ্য মনে করল আবার কেনই বা পরে অন্যান্য বাহিনী যোগ দেবার পর ও এতগুলো মানুষকে নৃশংসভাবে প্রাণ হারালো।

অনেকদিন থেকে বিশেষজ্ঞরা বলেই যাচ্ছেন দেশে আইএস আছে, জঙ্গি আছে। নানা বেশে নানা ছলে কিন্তু আমাদের প্রশাসন কি সেই সব কানে তুলছি? সব কিছুর মাঝেই শুধু ষড়যন্ত্র খুঁজেছি। মাঝখানে কিছুদিন নর্থ সাউথ নিয়ে খুব নাড়াচাড়া দেখলাম তারপর আবার যা তাই। এতগুলো মানুষের প্রাণ একদল সন্ত্রাসী অবলীলায় কেড়ে নিল তার জন্য দেশ, জাতি বা প্রশাসনের কোনো দায়াবদ্ধতা নাই? আজ অব্দি এই সংক্রান্ত কোনো মামলার তদন্তের অগ্রগতি বা বিচারের অগ্রগতি হয়েছে বলে আমি জানি না। বিচার প্রক্রিয়া শুরু বা এই নিয়ে খুব মাথাব্যাথা কারো আছে বলে মনে হয় না। উৎসাহ ভরে কারো কাছে কিছু জানতে চাইলে মনে হয় নাক বাড়িয়ে সিঁদূর নিচ্ছি। কেউ কেউ আবার বিরক্তিতে উত্তর দেয়। কেউবা উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধই করে না। সবই রহস্যমতায় পরিপূর্ণ।

আরও বিস্মিত হই শিল্পপতি লতিফুর রহমান সাহেবের আচরণে। তার ঘরের একের পর এক সম্ভাবনাময় আগামীরা চলে যাচ্ছে আর তিনি আইন ও আদালতের দিকে নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছেন। আর বিদেশে গিয়ে কেবল ফারাবীকে কিভাবে স্মরণ করছে বা কি খেতাব বা উপাধি দিচ্ছে তাই নিচ্ছেন।

সন্ত্রাসী যেই হোক তার পরিচয় আমরা জানতে চাই। যাক সে মারা তারপরও। জানতে চাই যারা সেদিন নৃশংসভাবে নিহত হলেন তাদের হত্যার বিচার প্রক্রিয়া কিভাবে হবে? কবে? কিভাবে সেদিনের ঘটনার সন্দেহজনক নায়করা জামিন পায়? অথবা সাজাপ্রাপ্ত আসামি কিভাবে দেশে ঢোকে আর নম্বরবিহীন পাজেরো গাড়ি ব্যবহার করে? বা তার কি কাজ ছিল হলি আর্টিজানে, যে এই হত্যাকাণ্ডের আগ দিয়ে তাকে সেখানে প্রতিদিন যেতে হয়েছে? নিবন্ধনহীন সিম ব্যবহার করার দুঃসাহসই বা পায় কোথা থেকে? এমনকি দ্যা ওয়েস্টিনে সাত দিন থাকলো সকলেই তাকে দেখছে কেবল পুলিশই তাকে পেল না? হলি আর্টিজানের ঘটনার পরপরই কোথায় হাওয়া হয়ে গেল সে ? এই সবই প্রশ্ন। উত্তর পাওয়া যাবে না যার কোনদিন।

গভীর ভালোবাসা, বিনম্র শ্রদ্ধা সেদিন সন্ত্রাসীদের নির্মমতার শিকার প্রিয় স্বজন এবং অতিথিদের প্রতি। রাষ্ট্রের এই ব্যর্থতা, লজ্জা আর দায়ভার আমরা রাখবো কোথায়?

দিলরুবা শরমিন

আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :