বৈষম্যভরা বাংলাদেশে কেমন কাটল সকলের ঈদ?

শেখ আদনান ফাহাদ
| আপডেট : ২৯ জুন ২০১৭, ২২:৪৫ | প্রকাশিত : ২৯ জুন ২০১৭, ২২:৩৩

কেমন কাটল এবারের ঈদ? এক কথায় এর উত্তর দেয়া যাবে না, দেয়া উচিতও নয়। শুধু নিজের অবস্থান দিয়ে বিবেচনা করলে প্রকৃত চিত্র অনুধাবন করা যাবে না। মন্ত্রী-এমপিরা যদিও নিজেদের অবস্থান এবং রাজনৈতিক স্বার্থ দিয়েই সবকিছু ‘মূল্যায়ন’ করেন, আম আদমির বাস্তবতা ভিন্ন। সংখ্যায় খুব কম হলেও, দেশের সম্পদের বেশির ভাগই যে শ্রেণির দখলে, তাদের ঈদ একরকম হয়, আবার উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তের ঈদ হয় যারযার হাকিকত অনুযায়ী। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং অব্যবস্থাপনা এতই প্রবল এবং প্রকট যে, মোটামুটি শান্তি ও স্বস্তি নিয়ে সাধারণ মানুষের পক্ষে কোনো কিছু ঠিকঠাক এনজয় করা খুব কঠিন।

স্বাধীনতার পরে, বিশেষ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য বেড়েছে। পুঁজিপতি আর বিশেষ শ্রেণির কিছু আমলার জীবনের সব সুবিধা-নিশ্চিত হয়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবন যেন গাছে দুর্বল বোটায় কোনোমত আটকে থাকা ফলের মতো, যেকোনো সময় খসে পড়তে পারে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হবে সমাজতান্ত্রিক, কিন্তু রাজনৈতিক ব্যবস্থা হবে গণতান্ত্রিক। এর মিশেলে তিনি আওয়ামের জন্য একটি সমান সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন রাষ্ট্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন। পুঁজিপতি ও আমলাদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে, সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। বিশ্লেষকরা সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মিশেলে বঙ্গবন্ধুর এই রাজনৈতিক আদর্শকে নাম দিয়েছেন ‘মুজিববাদ’ হিসেবে।

এই মুজিববাদের বাস্তবায়ন করতেই বঙ্গবন্ধু বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগ) সরকার প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ২৫ বিঘার উপর কারও জমি থাকলে বাড়তি জমি কেড়ে নিয়ে ভূমিহীন কৃষকের মাঝে বণ্টন করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি পর্যন্ত কৃষকের খাজনা মওকুফ করে দিয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে তাই শুধু স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক অপশক্তিই লাভবান হয়নি, আজীবনের জন্য লাভবান হয়েছে এদেশের পুঁজিপতি আর দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ ও আমলারা।

অনিয়ন্ত্রিত মুনাফা অর্জনের বিরোধী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা লোন নিয়ে ফেরত না দেয়া, খাস জমি দখল করা, ঘুষের টাকার পাহার গড়ে তোলাসহ নানা অবৈধ উপায়ে যারা আজ সমাজে বিত্তের অধিকারী তাদের একনম্বর শত্রু ছিলেন বঙ্গবন্ধু। শিক্ষিত ঘুষখোর এবং চোরাকারবারিদের বঙ্গবন্ধু বলতেন ‘ভুঁড়িওয়ালা’। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের দুশমন মাত্র পাঁচ শতাংশ লোক।

এই পাঁচ শতাংশ মানুষ যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা শিক্ষিত সমাজের প্রতিনিধি সেটিও বহু ভাষণ-বক্তৃতায় ক্লিয়ার করে জাতির জনক বলে গেছেন। এদেশের কৃষক-শ্রমিক তখনো দুর্নীতি করতেন না, এখনো করেন না। অনিয়ন্ত্রিত মুনাফা করাও যে একশ্রেণির দুর্নীতি এটা দেশের কোনো পুঁজিপতি আর রাজনীতিবিদকে এখন বোঝানো যাবে না। এক কথায় বলা যায়, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আজকের বাংলাদেশ এত বৈষম্যপূর্ণ হতো না। জামাত-বিএনপির কথা বাদ দিলাম, খোদ আওয়ামী লীগের ভেতরেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কতখানি বাস্তবায়িত হয় সবাই নিজেকে জিজ্ঞেস করুন। সামান্য একটা ছাত্রলীগ নেতা কিংবা ওয়ার্ড কমিশনারের যে পরিমাণ অর্থ-বিত্ত, গাড়ির বাহার তাতে জাতির জনকের আদর্শ এদের ভেতরে আছে বলে মনে হয় না। গ্রাম থেকে শুরু করে রাজধানী, প্রতিটি পর্যায়ে ‘আওয়ামী লীগ’-এর পরিচয়ে কিছু মানুষ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে। দলে পদ পাওয়ার আগের পরিস্থিতি আর কয়েক বছর পরের অবস্থা তুলনা করলে চোখ কপালে উঠে যায়। আগে ঠিকমতো রিকশাভাড়া থাকত না, এখন হেলিকপ্টার নিয়ে এলাকায় যান ইনারা।

এত দুর্নীতি, ভোগ-বিলাস, বৈষম্য থাকার পরেও বাংলাদেশ টিকে আছে। শুধু টিকে আছে বললে অন্যায় হবে, বলা যায়, ধীরে হলেও উন্নতি করছে। অর্থনীতির হিসেবে এদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ‘১৯৭২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪৪ বছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। অতিদ্ররিদ্রতা প্রায় শেষ হতে চলেছে। দরিদ্রের হারও পর্যায়ক্রমে কমে আসছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবছর ৩০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৬৫ মার্কিন ডলার। আর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল মাত্র ১২৯ মার্কিন ডলার। সে হিসাবে গত ৪৪ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় প্রায় ১১ গুণ বেড়েছে। এটি উন্নয়ন হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা’। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে যে কোনো সময়ের চাইতে অনেক বেশি চাঙ্গা এটা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়া লাগে না।

এবার গ্রামের বাজারে ঈদ শপিং যা দেখলাম তাতে অবাক হয়েছি। মানুষ এখন টাউনের বদলে গ্রামের বাজারই বেছে নিচ্ছে। কারণ টাউনের ব্যবসায়ীরা নাকি একই জিনিসে তিন-চার গুণ দাম বেশি রাখে। পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি মানদণ্ডে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩২তম বৃহৎ অর্থনীতি। ‘ইনক্লোসিভ ইকনমিক গ্রোথ’ এর হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারত থেকে ২৪ ধাপ এগিয়ে আছে বলে জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম। বিশেষ করে গত আট বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে অতি দরিদ্রের হার ১২ শতাংশ কমেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ১০,০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে।

এত উন্নয়নের পরেও এদেশে মানুষের জীবন-যাত্রায় বিস্তর ফারাক রয়েছে। কিছু লোক বহু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে, অধিকাংশ মানুষ সামান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। ঈদ আসলেই বৈষম্য প্রকট হয়। কয়জন আছে যারা বিমানে, ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা ভাড়া করা গাড়িতে করে ‘দেশের’ বাড়িতে ঈদ করতে যায়? প্রায় সবাই বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে যাতায়াত করে। এদেশের মানুষ এখনো বাসের ছাদে, ট্রেনের ছাদে, জানালা, দরজায় ঝুলে ঢাকা থেকে বাড়িতে আসা-যাওয়া করে। সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকে করে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের দিকে রওয়ানা দেয় এবং ১৭ জন মানুষ মারা যায়। রাষ্ট্র পারেনি এদের জন্য কম টাকায় চলনসই পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এর ব্যবস্থা করতে। জীবন হাতে নিয়ে এভাবে খুব কম দেশের মানুষই ট্রেনে, বাসে, ট্রাকে চড়ে জীবন-মরণ খেলা করতে করতে যাতায়াত করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মহাসড়কে যানজটে আটকে থাকে। এই কোটি কোটি মানুষের জীবনের মূল্য নেই। মূল্য আছে শুধু এদেশের পুঁজিপতি আর কতিপয় আমলার। রাজনীতিবিদরা এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারতেন, কিন্তু এরাও সিস্টেমের সাথে যোগসাজশ করে টিকে আছেন।

যমুনা টেলিভিশন এর সাংবাদিক নাজমুল হোসেন এর পোস্ট করা এক ছবিতে দেখলাম, বিচারব্যবস্থার সাথে জড়িত এক শীর্ষব্যক্তির জন্য দিনাজপুরগামী ট্রেনের একটি বগির দরজায় আলগা সিঁড়ি লাগিয়ে রাখা হয়েছে। পাশের বগিতেই মানুষ দরজা, জানালা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করছে। এক মধ্যবয়সী দম্পতি জানাল দিয়ে উঠতে পারছেন না, দরজা দিয়ে প্রবেশের কোনো কায়দা নেই। জানালা দিয়ে উঠতে গেলে যে পরিমাণ শারীরিক দক্ষতা থাকা দরকার, সেটি তাদের নেই। সাহায্য করতে এগিয়ে আসলেন এক ভিক্ষুক। ভিক্ষুকের ক্র্যাচে ভর করে সেই দম্পতি শেষ পর্যন্ত ট্রেনে উঠলেন, জানাল দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশে এমন বিপরীত চিত্র কেন হবে? বঙ্গবন্ধু এমন বাংলাদেশ দেখতে চাননি, এ কথা হলফ করে বলা যায়। আমাদের ট্রেনগুলো প্লাটফর্ম থেকে অনেক উঁচু। প্লাটফর্ম থেকে উঠতে গেলে বেশ কষ্ট হয়, এমনকি জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এখনো বগি বাড়িয়ে আমাদের দেশের রেলকর্মকর্তারা রেলের আধুনিকায়ন দাবি করেন। সময়মত ট্রেন ছাড়তে পারাই আমাদের রেলকর্মকর্তাদের বিশাল সাফল্য! আধুনিক মিনিমাম সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন রেল ব্যবস্থা থাকলে একজন আলগা সিঁড়ি দিয়ে রাজার মত, আরেকজন ফকিরের ক্র্যাচে ভর করে জানাল দিয়ে একই ট্রেনের ভেতরে উঠতেনা।

রেলের ছাদে চড়া এতটাই অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে যে, ছাদে উঠানো-নামানো এখন কিছু মানুষের কাছে ব্যবসার অবলম্বন হয়ে উঠেছে। জাহিদ বিন আজিজ নামে এক ফেসবুক বন্ধুর পোস্ট থেকে দেখলাম, দেশের একটি রেল স্টেশনে ট্রেন থামলে কিছু মানুষ মই নিয়ে ছাদের সাথে ফিট করে দিচ্ছে, উঠানামায় ১০-২০ টাকা নেয়া হচ্ছে! অথচ এদেশের বাজেট লাখো কোটি টাকা ছাড়িয়েছে কয়েক বছর হল। সম্পদের তুলনায় এদেশে উন্নয়ন কম হচ্ছে, এ কথা স্বীকার করার সময় এসেছে।

লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :