হাওরপারে এখন কেবল দীর্ঘশ্বাস, বাঁচার আকুতি

জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া, সুনামগঞ্জ
| আপডেট : ৩০ জুন ২০১৭, ০৭:৪৮ | প্রকাশিত : ৩০ জুন ২০১৭, ০৭:৪২

এখন ভরা বর্ষা চলছে। এই সময়ে হাওরপারের গ্রামগুলোতে সন্ধ্যা নামলেই বসার কথা গানের আসর। সদ্য বুরো ধান কেটে গোলা ভরে তোলার পর একটু আয়েস করার সময় এটা। কান পাতলেই বর্ষার নতুন পানি ছুয়ে ভেসে আসার কথা জারি-বাউলসহ নানা গানের সুর।

আর এ সময়টা হাওরবাসীর কিছু বাড়তি উপার্জনও এনে দিত। অনেকে এ সময় মাছ ধরে নির্বাহ করত জীবিকা। কিন্তু এবার এই সুখ-আনন্দ ধুয়ে নিয়ে গেছে ওপার থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল। অকাল বন্যায় ফসল গেছে, মাছ গেছে। দুবেলা খাবার জোটে না এমনকি সম্পন্ন গেরস্থেরও। সামনে আরো দুর্দশার দুশ্চিন্তা ভর করে আছে। তাই কেবলই দীর্ঘশ্বাস হাওরপারের মানুষের। এই দীর্ঘশ্বাসের মধ্য দিয়েই পার হয়েছে রোজা আর ঈদুল ফিতর।

সুনামগঞ্জের জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার দ্বীপসদৃশ গ্রামগুলোতে বিকল্প কাজের ব্যবস্থা না থাকায় বর্ষার ছয় মাস অনেকটা বেকার থাকে হাওরবাসী। অকাল বন্যায় ধান-মাছ হারিয়ে এই অনুন্নত হাওরবাসীর কণ্ঠে এখন কেবলই বাঁচার আকুতি।

এবার জেলার দিরাই, শাল্লা, জগন্নাথপুর, ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ, দোয়ারা বাজার, বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলার হাওরগুলোতে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ে পড়েছে কৃষক পরিবারগুলো। এদিকে সরকারি ন্যায্যমূল্য ও টিসিবির পণ্য বন্ধ, ভিজিএফ কার্ডে অনিয়ম ও ওএমএস চাল সঠিকভাবে পায়নি হাওরবাসী। এ অবস্থায় নিজের ও পরিবারের জন্য দুমুঠো খাবার জোগাড় করা দায় হয়ে পড়েছে তাদের জন্য। বেশির ভাগ হাওরবাসী অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।

জেলার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, জেলা ও উপজেলা সদরসহ প্রতিটি বাজারেই চালের দোকানগুলোতে চাল নেই। অনেকে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বেশি দামে বিক্রি করছে চাল।

হাওর ডুবে যাওয়ার পর থেকে সরকারি সহযোগিতা পেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দ্বীপসদৃশ গ্রামগুলোতে টাকার অভাবে অনেকে বাজার-সদাই করতে পারছে না। ফসলহারা মানুষগুলোর এখন দিন কাটছে ভিজিএফ কার্ড ও খোলা বাজারে কম মূলে চালের আশায়। দূর-দূরান্ত থেকে চাল নিতে আসা মানুষজন সকাল থেকে সারা দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ডিলারদের কাছ থেকে চাল পাচ্ছে না।

সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, সদ্য শেষ হওয়া রমজান মাসে সেহেরি ও ইফতারে পানিভাত, কখনো রুটি আর শাকপাতা, এ রকম যা জোগাড় করতে পেরেছে তা-ই দিয়ে কে নো রকমে রোজা রেখেছে। এর মধ্যেই নিরানন্দ কেটেছে ঈদ।

সারা বছরের খোরাকি একমাত্র বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় হাওরপারের লাখ লাখ কৃষক পরিবারে এখন বুকভরা দীর্ঘশ্বাস।

বোরো ধানের ওপর নির্ভরশীল কৃষক পরিবারগুলোর গোয়াল আর গোলা (ধান রাখার আধার) এখন শূন্য। ঘরে নেই নগদ টাকা কিংবা খাবার। এমনকি বিশুদ্ধ পানির অভাবে বহু পরিবার হাওরের পানি ব্যবহার করছে। ফলে নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।

সাদেক আলী, রফিকুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম, জমির উদ্দিন, সাজন মিয়া, করিমসহ জেলার বিভিন্ন হাওরপাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের সঙ্গে। তারা জানান, হাওর ডুবে যাওয়ায় তারা চোখের পলকে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। খাদ্যশস্যে ভরবাড়ন্ত ছিল যেসব পরিবার, তাদের এখন দুবেলা ভাতও জোটে না।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাদেক আলী বলেন, ‘কি কইমু ভাই, একবারেই নিঃস্ব¦ হইয়া গেছি। পানিভাত, শাক-পাতা, রুটি যা জোগাড় করতা পারি তাই খাইয়া রোজা এইবার রাখছি। অন্য বছর রমজান মাসে বাজার থেইকা ভালা জিনিস আনতাম, পরিবার তৈয়ার কইরা দিত, সাহরি-ইফতারিতে খাইতাম। এইবার ত জান যায়, ভালা খাইমু কই থ্যাইকা।’

সাজন মিয়া জানান, প্রতিবার ঈদে ছেলেমেয়েদের নতুন জামা-জুতা কিনে দিয়েছেন। কিন্তু এবার ঈদের জামা কী দেবেন, পরনের জামাই কিনতে পারছেন না। বলেন, ‘হাতে টাকা নাই। পোলা-মাইয়ারে ঈদে কিছুই দিতে পারি নাই। কেমনে নতুন কাপড় কিনা দিমু, জীবনই চালাইতে পারতাছি না।’

হাওর এলাকার মানুষের জন্য বিকল্প আয়ের সংস্থানের জন্য সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে এমন খবর পেয়েছেন, কিন্তু তার এলাকায় এর কোনো নিশানা না পেয়ে হতাশ জমির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘শুনি সরকার নাকি হাওর উন্নয়নের লাগি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা, মিল-কলকারখানা, বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করে। কিন্তুক সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের ব্যাপারে উদাসীন কেরে। আমরার অভাব-অনটন লাইগাই আছে। বোরো ধান চাষ ছাড়া অন্য কোনো কাজের ব্যবস্থা ত আমরার নাই।’

জমির উদ্দিন আরো বলেন, ‘আমরা হাওরপাড়ের মানুষ ছয় মাস হাওরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করি। এবার হাওরে কোনো মাছ নাই। সরকারিভাবে মাছের পোনা হাওরে ছাড়ার কথা থাকলেও ছাড়া হয়েছে দায়সারাভাবে।’ কিন্তু সরকার এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অনুযোগ করেন তিনি।

পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক পীযূষ পুরকায়স্থ টিটুসহ জেলার সচেতন মহল মনে করেন, হাওরের বেকার জনগোষ্ঠীকে সম্পদে পরিণত করার জন্য বোরো ধান চাষাবাদের পরিবর্তে বিকল্প কাজের জন্য মিল-কারখানা ও কুটির শিল্প স্থাপন জরুরি হয়ে উঠেছে। হস্তশিল্পে পারদর্শী এবং প্রশিক্ষণরে মাধ্যমে হাঁস ও মুরগি লালন-পালনের সঙ্গে যুক্ত করা হলে হাওরের নারীসমাজ পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি তাগিদ দিয়ে তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, না হলে এই অসহায় হাওরবাসীর দুঃখের শেষ থাকবে না। হাওরবাসীর দিকে সুদৃষ্টি দিয়ে প্রয়োজনীয় কার্যকর প্রদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি।

(ঢাকাটাইমস/৩০জুন/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :