আর্টিজান হামলা থেকে আমরা কি শিক্ষা নিতে পেরেছি?

সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান
| আপডেট : ০১ জুলাই ২০১৭, ১১:২৯ | প্রকাশিত : ০১ জুলাই ২০১৭, ০৯:২৫

হলি আর্টিজান হামলার এক বছর পূর্ণ হলো। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের মাত্রা কোন পর্যায়ে রয়েছে তা জানার জন্য হলি আর্টিজানের ঘটনা একটি বড় উদাহরণ। তবে হলি আর্টিজান ঘটনার আগে ৪০টির বেশি গুপ্তহত্যা বা টার্গেট কিলিং দেখা যায়। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ব্লগার, ধর্মান্তরিত ব্যক্তি, পুরোহিত, বৌদ্ধ ভিক্ষু, মাজারের খাদেম কেউই রেহাই পায়নি। এই হত্যার দায় স্বীকার করেছে ভারতীয় উপমহাদেশের আল-কায়েদার বাংলাদেশ শাখা আনসার আল ইসলাম কিংবা সিরিয়া-ইরাকভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট।

হলি আর্টিজানে হামলার চার মাস আগে, ২০১৬ সালের এপ্রিলে আইএসের ই-ম্যাগাজিন দাবিকের চতুর্দশতম সংখ্যায় বাংলাদেশে আইএসের তথাকথিত আমির শায়খ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ বাংলাদেশকে ঘিরে তাদের পরিকল্পনা স¤পর্কে জানান দেন। কিন্তু আমাদের নীতি নির্ধারণী কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই সময়কার পত্রিকা-টিভি ফুটেজ তার প্রমাণ। তবে দেরিতে হলেও হলি আর্টিজানে হামলার পর সরকার-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গিবাদকে গুরুত্ব দিয়ে দেখে কাজ করতে শুরু করে। একই সাথে হলি আর্টিজান হামলা বাংলাদেশের সামনে আরো কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। যার সমাধান না হলে জঙ্গিবাদের ঘটনা সামনের দিনে নতুন নতুন উপাদান নিয়ে হাজির হবে।

জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা পুলিশের। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট এখন দেশজুড়ে অভিযান পরিচালনা করছে। পুলিশের বাজেটও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে পুলিশ বাহিনীর বার্ষিক বাজেট ছিল দুই হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। সেই বাজেট ছয় গুণ বেড়ে ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে হয়েছে প্রায় ১২ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। পুলিশের বাজেট বাড়ছে, কিন্তু কর্মদক্ষতা কি বাড়ছে? পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াট থাকার পরেও সাহায্য নিতে হয়েছে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো কিংবা নৌবাহিনীর কমান্ডো ইউনিট সোয়াডসের। জঙ্গিবাদ দমনের কাজে তৈরি করা র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সমন্বয় এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে। মাঝে মাঝে এই দুটি ইউনিটের মধ্যে জঙ্গিবাদ বিষয়ক তথ্যের গরমিল সাধারণের মধ্যে দ্বিধা-সংশয় তৈরি করে।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিচারে মন্থর গতি দেখতে পাওয়া যায়। হলি আর্টিজানের এক বছর পরেও চার্জশিট দাখিল করা যায়নি। টার্গেট কিলিংয়ের অনেক মামলায় বিচারকাজই এখনো শেষ হয়নি। তবে এই মন্থরগতি কাটানো সম্ভব যখন জঙ্গিবাদের বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সেখানে বিচারকাজ করা গেলে। দেশে বিচার শেষ হয়নি বা রায়ের অপেক্ষায় আছে এমন মামলার সংখ্যা ২৫ লাখের বেশি। সেখানে জঙ্গিবাদের বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা সময়ের দাবি।

জঙ্গিবাদের মতাদর্শের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় লড়াই হলো পাল্টা মতাদর্শ দিয়ে লড়াই করা। যে জায়গায় গত এক বছরে সাফল্য নেই বললেই চলে। জঙ্গি দমন একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে অবস্থান সন্ত্রাসবিরোধী কৌশলপত্র বা কাউন্টার টেররিজম স্ট্রাটেজির এবং তাকে ঘিরেই আবর্তিত হবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যান্য পক্ষ। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্যি, বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের লড়াই করছে কোনো ধরনের নীতিমালা বা কাউন্টার টেররিজম স্ট্রাটেজি ছাড়াই। জঙ্গিবাদবিরোধী সামাজিক আন্দোলন তৈরির ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা এখানে কী হবে তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই।

গত এক বছরে জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াইয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাফল্য অনেক। সরকারের দিক থেকেও নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। কিন্তু এই উদ্যোগকে একই ছাতার নিচে নিয়ে আসতে পারলে জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচেষ্টায় দীর্ঘমেয়াদে সাফল্য আশা করা যায়।

একটি সংবাদ দিয়ে শেষ করি। সিরিয়ায় আইএসের সবশেষ ঘাঁটি মসুলের বড় অংশের দখল নিয়েছে ইরাকি বাহিনী। আইএসের পক্ষে লড়াই করতে যাওয়া বিদেশি যোদ্ধারা এখন পালিয়ে নিজেদের দেশে ফেরত আসবে। যুদ্ধ শেষ হলেও তাদের জেহাদি চেতনা তো আর মারা যাবে না। দেশে ফেরত এসে নতুনভাবে সংগঠিত হয়ে তাদের মরণকামড়ের আশঙ্কা তাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জঙ্গিবাদবিরোধী একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্মই পারে ভবিষ্যতের জঙ্গিবাদের ঝুঁকির হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে। তা না হলে স্বল্পমেয়াদে নানা অভিযানে সাফল্য আসবে হয়তো, কিন্তু কিছুদিন পর পর নানাভাবে এসে হাজির হবে জঙ্গিবাদের ভূত।

লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জঙ্গিবাদবিষয়ক গবেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :