অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের কথা-৩১

আলম রায়হান
 | প্রকাশিত : ০১ জুলাই ২০১৭, ১৬:৫২

সাপ্তাহিক সুগন্ধার অগ্রগতি ছিল বিস্ময়কর। যার সূচনা হয়েছিল মোজাম্মেল ভাইয়ের নেতৃত্বে। আমাদের সাফল্যের দিক হচ্ছে, সেই অগ্রগতির ধারায় আরও গতি সঞ্চার করা। তবে এ অগ্রগতি কেবল মেধাবী ও সক্রিয় এক দল নিজস্ব জনশক্তির ওপর ভর করে হয়নি; এর পেছনে আরও একটি কৌশল কাজ করেছে। সেটি হচ্ছে, পরিচিত ও স্বল্প পরিচিত; প্রতিষ্ঠিত এবং সে সময় অপ্রতিষ্ঠিত অনেক সাংবাদিককে সুগন্ধার সঙ্গে যুক্ত করা। এর ফলে পাঠক নানান ধরনের স্বাদ পেতো। পাশাপাশি নিজস্ব জনবলের ওপরও এক ধরনের মনসতাত্ত্বিক চাপ থাকতো।

বিভিন্ন পত্রিকায় কর্মরত এবং বেকার সাংবাদিকদের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল সাপ্তাহিক সুগন্ধা; অনেকটা মুক্ত মঞ্চের মতো। আবার লেখার জন্য সম্মানী দেয়া হতো। অনেক আইটেমের চাপে রিপোর্ট ছাপা না হলেও দেয়া হতো লেখার বিল। এ কথা এখনো স্মরণ করে রাশিদুল ইসলাম; অনেক হাউজ ঘুরে দিগন্ত টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদকের পর ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার মতো’ রাশিদুল আবার গেছে নাঈম ভাইয়ের আমাদের সময় ডটকম-এ। আমরা দৈনিক সকালের খবর ও দৈনিক আমাদের সময়-এ একত্রে কাজ করেছি।

সুগন্ধায় প্রতি সংখ্যায় কলাম লিখতেন নাজিম উদ্দিন মোস্তান, আবেদ খান, নঈম নিজাম, মতিউর রহমান চৌধুরী, আলতাফ মাহমুদ, শাজাহান সর্দার, আজিজুল হক বান্না, ওবায়দুল কাদের প্রমুখ। নিয়মিত রিপোর্ট দিতেন রাশিদুল ইসলাম, কাজী আবদুল হান্নান, পারভেজ আলম চৌধুরী, আবু দারদা যোবায়েরসহ অনেকে। তরুণদের রিপোর্টের জন্য দেয়া হতো দুইশ থেকে তিনশ টাকা। আর সিনিয়রদের জন্য বরাদ্দ ছিল প্রতি লেখায় পাঁচশ টাকা। তবে নঈম নিজামের সম্মানীর বিষয়ে ছিল আলাদা বিবেচনা। এ নিয়ে মাসুদ কামালের মৃদু আপত্তি থাকলেও সিদ্ধান্ত অমান্য করার চেষ্টা করেনি। মাসুদ কামালের এই এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য; পছন্দ না হলে বিরোধিতা করতো প্রকাশ্যে; কিন্তু অমান্য করার প্রবণতা তার ছিল না। আর পেছনে গুসুরগুসুর-ফুসুরফুসুর করা তো অনেক দূরের বিষয়।

বলে রাখা ভালো, নঈম নিজামের লেখার সন্মানির বিষয়ে আলাদা গুরুত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে তার প্রতি আমার ব্যক্তিগত কোনো পক্ষপাতিত্ব ছিল না। এমন নয় যে, তার বাড়ি বরিশাল; অথবা সেই সময়ের আগে তার দ্বারা আমি কোনো রকম উপকৃত হয়েছি। আর পরবর্তী সময়ে আমি তার দ্বারা যে সীমাহীন উপকৃত হয়েছি তাও তো সেসময় আমার জানার কথা নয়। অর্থ হচ্ছে এই, অনেকের মধ্যে তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেবার কারণ ছিল সে নিজেই। তার লেখার মধ্যে নানান ধরনের ডাইমেনশন থাকতো; তার লেখায় বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ সম্পৃক্ত হতো পত্রিকার সঙ্গে। এ ধরনের লেখায় পাঠক বৃদ্ধির পাশাপাশি পত্রিকার ফাউন্ডেশন সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। যা কেবল গভীরভাবে বিবেচনা করলে অনুধাবন করা সম্ভব। যা আমি সঠিকভাবে করতে পেরেছি বলে মনে হয়।

নিরপেক্ষ লোক হিসেবে মাসুদ কামালের স্বচ্ছ একটি ইমেজ ছিল। তবে আমার মনে হয়েছে, পারভেজ আলম চৌধুরী ও আবুদারদা যোবায়েরের প্রতি সে বেশ দুর্বল ছিল। যোবায়েরের প্রতি দুর্বলতার কারণ হয়তো সূচনালগ্নে প্রচণ্ড আগ্রহী এক তরুণকে সহায়তা করতে চেয়েছে সে। আমার ধারণা, তার এ সহায়তা সফল হয়েছে। আর যে প্রসঙ্গ আবু দারদা যোবায়ের মনে রেখেছে বলে মনে হচ্ছে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির প্রকাশনা রিপোর্টার্স ভয়েস-এ ২০১৬ সালের এপ্রিল সংখ্যায় আবু দারদা যোবায়ের লিখেছে, ‘নিউজপ্রিন্ট কাগজে লিখে ফেললাম বিনা পয়সায় লাশ দাফন ও ইউপি নির্বাচনের দুটি খবর। লিখেই ছুটলাম সুগন্ধা অফিসে। কেন ছুটলাম সুগন্ধায়? রাজনৈতিক রিপোর্টের কারণে এরশাদ আমলে সাপ্তাহিক সুগন্ধার পরিচিতি ও সার্কুলেশন ছিল আকাশচুম্বী। সুগন্ধা অফিসে নিউজ দুটি জমা দেয়ার পর অপেক্ষা করছিলাম পরবর্তী সংখ্যার। পরের সপ্তাহে পত্রিকাটির একটি কপি সংগ্রহ করে উল্টে দেখলাম। প্রথমে নিজের চোখ বিশ্বাস করতে পারিনি। আমার দুটি নিউজই ছাপা হয়েছে এক স্লিপ আকারে। আমি তো খুশিতে আত্মহারা। আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবদের সুযোগ পেলেই দেখাই সুগন্ধায় প্রকাশিত সে নিউজ। এভাবেই জড়িয়ে গেলাম সাংবাদিকতায়।’

এই যোবায়ের টেলিভিশন সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত; বহু বছর ধরে আছে এটিএন বাংলায়, সম্ভবত শুরু থেকে। তাকে শুরুতেই চিনতে পেরেছিল মাসুদ কামাল। যে কারণে তার প্রতি আলাদা টান থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু পারভেজ আলম চৌধুরীর প্রতি মাসুদ কামালের স্বভাব বিরুদ্ধ পক্ষপাতিত্বের কারণ আমার কাছে পরিষ্কার ছিল না ২৭ বছর ধরে; ২০১৪ সাল পর্যন্ত। যা কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে ২০১৪ সালের ১৩ জুন সাপ্তাহিক এই সময়-এর ঈদ সংখ্যায় মাসুদ কামালের ‘এ জীবন সাংবাদিকের’ শিরোনামে স্মৃতি কথা পড়ে। দৈনিক নব অভিযানে থাকাকালে আমার রেফারেন্সে সাপ্তাহিক সন্দ্বীপে পারভেজ আলম চৌধুরীর কাছে গিয়ে যে তিক্ত আচরণ পেয়েছে তার উল্টো আচরণ করেছে যখন পারভেজ আলম চৌধুরী বেকার হয়ে সুগন্ধায় এসেছে মাসুদ কামালের কাছে। নিজের তিক্ত অভিজ্ঞার বিপরীতে দাঁড়িয়ে অতি সহানুভূতিশীল হওয়া সহজ কথা নয়। অবশ্য মাসুদ কামালের যেসব গুণাবলী রয়েছে তার মধ্যে অনেকগুলোই অর্জন বা ধরে রাখা খুব সহজ নয়।

কন্ট্রিবিউটরদের লেখা বাছাই ও লেখার বিল করার দায়িত্ব ছিল মাসুদ কামালের। লেখার বিল নিয়ে সবাই সন্তষ্ট ছিলেন। কেবল একবার আপত্তি তুলেছিলেন নাজিম উদ্দিন মোস্তান। অন্যরকম আপত্তি। তার বক্তব্য ছিল, একটি নতুন সাপ্তাহিক পত্রিকায় জন্য প্রতি লেখায় পাঁচশ টাকা অনেক বেশি হয়ে যায়। উত্তরে বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলাম, আপনারা যে উচ্চতার সাংবাদিক তাতে আরও বেশি দেয়া উচিত। তিনি বললেন, সব সময়তো আমার লেখার মান একরকম হয় না, লেখার মান তো নামেও; কিন্তু টাকা তো আমি একই নিচ্ছি!

আমি জানতাম এ ছিল আপাদমস্তক চিন্তা-চেতনা-অনুশীলনে সৎ সাংবাদিকের প্রতীক নাজিমউদ্দিন মোস্তানের বিনয়। নিজের লেখার মান নিয়ে মতিউর রহমান চৌধুরীও একবার বিনয় প্রকাশ করেছিলেন। নানামুখী ব্যস্ততার কারণে মতিউর রহমান চৌধুরী মাঝে মধ্যে সুগন্ধা অফিসে বসেও লিখতেন। অন্যেরা লেখে নিয়ে আসতেন। একমাত্র আবেদ খানের লেখা তার বাসা থেকে আনা হতো; আর এ দায়িত্ব নিজের আবেগে পালন করতো শহিদুল আজম। এদিকে মতি ভাই সুগন্ধা অফিসে বসে যতবার লিখেছেন ততবারই লেখার সাইজ ছোট হতো। আমরা সিনিয়রদের কাছ থেকে এক পৃষ্ঠা লেখা আশা করতাম। পোনে এক পৃষ্ঠা হলেও তেমন অসুবিধা হতো না। কিন্তু এর নিচে নামলেই মিলাতে ঝামেলা হতো। আর মতি ভাই সুগন্ধা অফিসে বসে লিখলেই তা হাফ পৃষ্ঠার বেশি হতো না। একবার অফিসে বসে লিখে তিনি বলেছিলেন, লেখাটা এবার ভালো হলো না। আমি বলেছিলাম, আপনার লেখা আর কত খারাপ হবে, চাইলেও খারাপ লিখতে পারবেন না; মান নিয়ে আমার চিন্তা নেই! আসলেই তার লেখার মান নিয়ে চিন্তা ছিল না; থাকার কোনো কারণও নেই। আমার দুঃশ্চিন্তা হচ্ছিল, তার লেখা আধা পৃষ্ঠার কম না হয়ে যায়! সেদিন আসলে তাই হয়েছিল।

সুগন্ধার এক মিটিং-এ কোনো কোনো সিনিয়রের লেখা নিয়ে প্রশ্ন উঠলো। কিন্তু আলোচনা আমি আগাতে দিইনি। বলেছিলাম, এই পয়েন্টে কোনো আলোচনা হবে না! কারণ সুগন্ধার জন্য সিনিয়রদের লেখা নয়, তাদের নাম জরুরি। তাদের নাম ছাপার জন্যই তাদের লেখা ছাপি। আর কারো যদি মনে হয় সিনিয়রদের মধ্যে কারো লেখার মান খারাপ, তা হলে ধরে নিতে হবে সমস্যা তার নিজের; সিনিয়রের না!

আমার কথা সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এ ‘ভাষণ’ই আবার পরের আমার জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়ালো। পরের এক মিটিং-এ প্রশ্ন তোলা হলো ওবায়দুল কাদেরের লেখা নিয়ে। বলা হলো, তার লেখায় না আছে মান, না আছে সাংবাদিক হিসেবে তার নাম। এদিকে আগে থেকেই ওবায়দুল কাদেরের লেখা ছাপা নিয়ে মাসুদ কামালের ঘোর আপত্তি ছিল। নীরব থেকে তাকে সামলানো গেলেও মিটিং-এ নীরব থাকার উপায় ছিল না। আমি বড় রকমের বেকায়দায় পড়লাম। মানের ব্যাপারে আপস করা যাবে না- সুগন্ধার এ নীতিমালার আওতায় মাসুদ কামাল প্রায়ই ওবায়দুল কাদেরের লেখা নিয়ে আপত্তি তুলতো। এ আপত্তির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার উপায় ছিল না। এরপরও ওবায়দুল কাদেরের লেখা ছাপতাম। কারণ, আজিজুল হক বান্না অতি কৌশলে আওয়ামী লীগকে খুবই নিদারুণভাবে তুলোধুনো করতেন। তার লেখায় বিশেষ মুন্সিয়ানা ছিল, যা অনেক পাঠক পছন্দ করতো। এর বিপরীত ধারার লেখা প্রয়োজন ছিল পত্রিকা ব্যালেন্স করার জন্য। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী সাংবাদিকে দেশ সয়লাব হয়ে গেলেও তখন আওয়ামী লীগের পক্ষে শক্তভাবে লেখার মতো লোক খুব বেশি ছিল না। কাজেই হাতের নাগালে মন্দের ভালো হিসেবে বাছাই করতে হয়েছিল সে সময় বাংলার বাণীতে প্রায় বিনা বেতনে চাকরিরত সহকারী সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে। তার সঙ্গে আমার পরিচয় সাপ্তাহিক সন্দ্বীপে। আমি স্টাফ রিপোর্টার, আর ওবায়দুল কাদের ছিলেনে কলাম লেখক। তিনি ‘বিদেশ’ নামে আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে নিয়মিত কলাম লিখেতেন সাপ্তাহিক সন্দ্বীপে।

এ পত্রিকায় ১৯৮৭ সালের ৬ এপ্রিল প্রকাশিত ‘কংগ্রেস হেরেছে জ্যোতি যাদুর কাছে’ তার লেখাটি বেশ আলোচিত হয়েছিল। এ সাপ্তাহিক সন্দ্বীপে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আমার পরিচয়; তার সঙ্গে বাংলার বাণীতেও কিছু দিন কাজ করেছি সুগন্ধা অধ্যায় প্রথম দফা চুকে যাবার পর। তবে এর আগেই এক পর্যায়ে তিনি সুগন্ধায় লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন অভিমান করে। তার বক্তব্য ছিল, তার নামের আগে আজিজুল হক বান্নার নাম যেতে পারে না। আর এ বিষয়ে মাসুদ কামালের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, মানের হিসেবে বান্না ভাইর লেখা অনেক উপরে; তা ছাড়া তিনি আওয়ামী লীগের যে সমালোচনা করেন তারই এক রকমের জবাব হিসেবেই তো আমরা কাদের ভাইর লেখা ছাপি। অভিযোগের আগে জবাব ছাপলে সেটি খাপছাড়া হবে। মাসুদ কামালের যুক্তি ছিল অকাট্য। ফলে তার সিদ্ধান্ত আমি আর উল্টে দিইনি।

তবে তা কেবল যুক্তির নিরিখে নয়, টিম সচল রাখার বিষয়টিও বিবেচ্য ছিল। টিম স্প্রিট বজায় রাখার জন্য কেবল যৌক্তি নয়, অযৌক্তিক কথাও রাখতে হয়েছে আমাকে দুই-একবার। কাজী আবদুর হান্নানের একটি লেখা একবার না ছাপার জন্য সুপারিশ করলো মোস্তফা কামাল। আমি মোস্তফা কামালের আবদার রাখলাম। কিন্তু পত্রিকা প্রকাশ হবার পর মহা ক্ষিপ্ত হলেন কাজী আবদুল হান্নান। সে জেনে গিয়েছিল, মোস্তফা কামালের বিরোধিতার কারণেই তার লেখা ছাপা হয়নি। কাজী হান্নান আমাকে বললো, ‘একটা লেখা দিয়েছিলাম; ছাপা হলে দেশ কাঁপতো, কিন্তু মোস্তফা কামাল ছাপলো না।’ আমি বললাম, দ্যাশ কাঁপার ভয়তেই সম্ভবত ছাপে নাই; বাদ দেন। পোলাপান, বোঝে নাই!

লেখক: জেষ্ঠ্য সাংবাদিক; ই-মেইল: [email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :