কাটেনি ঈদের আমেজ, পর্যটকে মুখর মহাস্থানগর

প্রতীক ওমর, বগুড়া থেকে
 | প্রকাশিত : ০১ জুলাই ২০১৭, ১৮:৪৩

ঈদের ছুটি শেষ হলেও বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে দর্শনার্থীদের ভিড় কমেনি। উত্তরাঞ্চলের সব চেয়ে বড় পর্যটনকেন্দ্র মহাস্থানগড় এখন পর্যটকদের পদচারণায় মুখোর হয়ে উঠেছে। ছুটির দিনগুলো পরিবারের সাথে আনন্দময় করে তুলতে ছুটে এসেছেন ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়ে।

স্থানীয়দের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা প্রতিদিন এখানে বেড়াতে আসছেন।

ইতিহাস কথা বলে, ইতিহাস অনুপ্রেরণা যোগায়। ইতিহাসের কাছে গিয়ে ছুঁয়ে দেখতে কর না ভালোলাগে ? মন, প্রাণ ভরে যায়। চোখ জুড়ায়। ইতিহাসপ্রেমী ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য বগুড়া একটি লোভনীয় জেলা। কাছ থেকে হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসের সাথে পরিচিত হওয়ার অবারিত সুযোগ আছে এই জেলায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ভ্রমণকারীদের পাশাপাশি দেশের বাইরের পর্যটকদের দর্শনীয়স্থানের তালিকায় বগুড়া থাকেই। মহাস্থানগড়ের ইতিহাসের চেতনা বগুড়াকে দেশে খ্যাতির শীর্ষে তুলেছে। পাশাপাশি দেশের বাইরের বোদ্ধাজনরাও বগুড়াকে চেনেন মহাস্থানের কল্যাণেই।

বর্তমানে দেশে চলছে পর্যটন মৌসুম। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং পরিবারিকভাবে দর্শনীয় স্থানগুলোতে ঘুরতে বের হচ্ছেন ভ্রমণপ্রেমীরা মানুষরা। আবহাওয়া মানুষের অনুকূলে থাকায় এই সময়কে বেছে নেয় অনেকেই ভ্রমণের জন্য। প্রতিদিন বগুড়ার মহাস্থানগড়ে কয়েক হাজার মানুষ বেড়াতে আসছেন। বিশেষ করে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের টিম বেশি আসছে।

কথা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘুড়তে আসা নাফিজা, তাবাসসুম, জান্নাতি, কেয়া, আরিফ, সুজন আব্দুর রহীমের সাথে।

তারা ঢাকাটাইমসকে জানান, প্রতি বছর ডিপার্টমেন্ট থেকে দেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ভ্রমণের জন্য যাওয়া হয়। এবার মহাস্থানগড় দেখার জন্য তারা এসেছেন। মহাস্থানগড় দেখতে এসেছেন সিলেটের সুনামগঞ্জের কাওছার। তিনি জানান, এর আগেও বেশ কয়েকবার মহাস্থান দেখতে এসেছিলেন। ঐতিহাসিক স্থান হওয়ায় সময় পেলেই তিনি এখানে ঘুরতে আসেন।

মহাস্থান ছাড়াও বগুড়া জেলায় দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। বিশ্বের প্রথম ও সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ভাসু বিহার যা গৌতম বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত, সান্তাহারে কালের স্বাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম মসজিদ যা প্রায় ২৫০ বছরের পুরনো, পবিত্র সতি পিঠ ভবানি মন্দির, সুলতানি আমলের খেরুয়া মসজিদসহ অসংখ্য ঐতিহাসিক মন্দির ও তীর্থস্থান এবং প্রকৃতির এক অপরুপ মহিমায় সৃষ্ট সারিয়াকান্দির যমুনার চর। বগুড়ার ইতিহাস, ঐতিহ্য সমৃদ্ধ ৬০টির মত স্থান পর্যটকদের দেখার মতো আছে। এর মধ্যে বগুড়ার মহাস্থানগড়ের টানেই মূলত বেশি পর্যটক বগুড়ার মাটিতে পা রাখেন। এক সময় মহাস্থানগড় পু-্রনগরের রাজধানী ছিল। মহাস্থান প্রাচীন বাংলার অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি। পূর্বে এর নাম ছিল পু-্রবর্ধন বা পু-্রনগর। এখানে মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন সা¤্রাজ্যের প্রচুর নিদর্শন পাওয়া গেছে।

এর অবস্থান বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায়। বগুড়া শহর থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। যিশু খ্রিষ্টের জন্মেরও আগে এখানে সভ্য জনপদ গড়ে উঠেছিল প্রতœতাত্ত্বিকভাবেই তার প্রমাণ মিলেছে।

জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টীয় ১৫ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে এই নগর এক সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে বিস্তার লাভ করে। বেশ কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এখানে অসংখ্য হিন্দু রাজা ও অন্যান্য ধর্মের রাজারা রাজত্ব করেন। এর মধ্যে রয়েছেন মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সামন্ত রাজবংশের শাসকরা। এরপর এখানে ধর্মীয় সংস্কার করতে আসেন ইসলাম ধর্ম প্রচারকরা। প্রতœতাত্ত্বিকরা মহাস্থানগড়কে হারিয়ে যাওয়া কিংবদন্তির নগরী পুন্ড্রবর্ধন বলে উল্লেখ করেছেন। বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬৩৯ থেকে ৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে পুন্ড্রনগরে এসেছিলেন।

ভ্রমণের ধারাবিবরণীতে তিনি তখনকার প্রকৃতি ও জীবনযাত্রার উল্লেখ করে বর্ণনা করেন। দশম শতকের মধ্যবর্তী সময়ে এখানে রাজত্ব করেন রাজা নরসিংহ বা পরশুরাম। রাজা পরশুরাম ছিলেন অত্যাচারী। তাকে উচ্ছেদ করে ইসলাম ধর্মের শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে আসেন হযরত শাহ্ সুলতান বলখী র. মাহী সওয়ার। কথিত আছে তিনি প্রাচীন পুন্ড্রনগরে প্রবেশ করেন করতোয়া নদী দিয়ে একটা বিশাল আকৃতির মাছের পিঠে চড়ে। এ জন্য তার নামের শেষে উল্লেখ করা হয় মাহী সওয়ার বা ‘মাছের পিঠে আরোহণকরী’।

অপর দিকে বাস্তববাদীরা বলেন, তিনি নদী পার হয়েছিলেন ঠিক কিন্তু মাছের পিঠে চড়ে নয়। আসলে তিনি মাছের আকৃতিতে তৈরি করা একটি নৌকার পিঠে চড়ে আসেন। মহাস্থান বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছু পশ্চিমে হজরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখির র. মাজার শরীফ অবস্থিত। লোক মুখে প্রচলিত আছে, মীর বোরহান নামক একজন মুসলমান গরু কোরবানি দেয়ার অপরাধে রাজা পরশুরাম তাকে বলির আদেশ দেন। সেই সংবাদ পেয়ে তাকে উদ্ধার করতেই মাহী সওয়ারের আগমন ঘটে।

গড়ের পশ্চিম অংশে রয়েছে ঐতিহাসিক কালীদহ সাগর এবং পদ্মাদেবীর বাসভবন। গড়ের পূর্বপাশে রয়েছে করতোয়া নদী এর তীরে ‘শীলাদেবীর ঘাট’। শীলাদেবী ছিলেন পরশুরামের বোন। এখানে প্রতি বছর হিন্দুদের স্নান এবং একদিনের একটি মেলা বসে। এই ঘাটের পশ্চিমে জিউৎকু- নামে একটি বড় কূপ আছে। কথিত আছে এই কূপের পানি পান করে পরশুরামের আহত সৈন্যরা সুস্থ হয়ে যেতো। মহাস্থানগড় খননের সময় মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন যুগের অনেক দেব-দেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে। এগুলো মহাস্থান জাদুঘরে এখনো সংরক্ষিত আছে।

মহাস্থান বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় ২ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি বৌদ্ধ স্তম্ভ রয়েছে যা স¤্রাট অশোক নির্মাণ করেছিলেন বলে মনে করা হয়। স্তম্ভের উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। এটি বেহুলার বাসর ঘর নামেই বেশি পরিচিত। ঢাকা থেকে মাত্র সাড়ে পাঁচ ঘণ্টায় পৌঁছানো যাবে। মহাস্থানগড়ে থাকার মতো ভালো হোটেল না থাকলেও বগুড়া শহরে ভালো মানের অনেক হোটেল আছে। মান অনুযায়ী ওই হোটেলগুলোতে ৪০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকায় রাত্রীযাপন করা যায়। আছে থ্রিস্টার মানের হোটেলও।

সম্প্রতি মহাস্থানে পর্যটকদের জন্য সাউথ এশিয়া ট্যুরিজম ইনফ্রাসট্রাকচার ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টের অধিনে সংস্কার এবং সৌন্দর্য বদ্ধনের কাজ শেষ হয়েছে।

মহাস্থান যাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মুজিবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, মহাস্থানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং পর্যটকদের নানামুখী সহযোগিতার জন্য এখানে নতুন করে তৈরি হয়েছে ভিজিটর কক্ষ, ডরমেটরি, ফুট কর্ণার, পার্কিং স্পট, পিকনিক স্পট এবং ভিআইপি টয়লেট। এসব কাজ হওয়াতে পর্যটকরা তাদের ভ্রমণকে আরো বেশি উপভোগ করতে পারছেন।

(ঢাকাটাইমস/০১জুলাই/প্রতিনিধি/ইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :