বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর নাম হলি আর্টিজান

ছানোয়ার হোসেন
| আপডেট : ০১ জুলাই ২০১৭, ২১:৫৩ | প্রকাশিত : ০১ জুলাই ২০১৭, ১৮:৫৮

ইফতার শেষ করে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ ফোনের দিকে তাকাতেই আঁৎকে উঠলাম। পুলিশ কমিশনার স্যার কল করেছেন। একটুর জন্য কলটা মিস হয়ে গেল। ভাইব্রেশন মোডে থাকায় বুঝতে পারিনি। ডিসপ্লে লাইটটা তখনও জ্বলছিল। মনে হচ্ছিল যেন তিন তিনটি মিসকল কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি খুব একটা ফোন করেন না। এর আগে তার সাথে মাত্র একদিন কথা হয়েছে। তাই ছুটির দিন তার আচমকা কল দেয়াটা আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলল।

ফলে, দ্রুত কল ব্যাক করলাম-

- স্যার, কল দিয়েছিলেন। খেয়াল করিনি। সরি, স্যার।

-তুমি কোথায়? খুব দ্রুত গুলশান চলে যাও।

-এখনই আসছি, স্যার।

বিস্তারিত আর কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। খুব দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। ছুটির দিনেও চারিদিকে বেশ ট্রাফিক জ্যাম। মনে হচ্ছিল পৃথিবীটা থমকে গেছে। কোনো গাড়িই এগুচ্ছে না। সিটে বসেই মনে মনে দৌড়াতে লাগলাম।

এবার খোঁজ খবর নেয়া শুরু করলাম। স্নেহভাজন ছোট ভাই আহাদ (এডিসি, গুলশান)-কে কল দিলাম,

- আহাদ, কী হয়েছেরে গুলশানে?

- ভাই, কিছু ইয়াং পোলাপাইন একটা ক্লিনিকে ঢুকেছে। একটু আগে ভেতর থেকে কয়েকটা গুলির শব্দও পেলাম। এখন অবশ্য আর কোনো সাড়া-শব্দ পাচ্ছি না। ক্লিনিকের পাশেই নাকি একটা রেস্টুরেন্টও আছে। সেখানেও ঢুকে যেতে পারে। যাহোক, তোমরা কদ্দুর?

- আমি রাস্তায়। আসতেছি। তুই কংক্রিটের আড়ালে থাক, আর কর্ডনটা ভালোভাবে কর। আমরা না আসা পর্যন্ত সেইফ ডিস্টেন্সে থাকবি ভাই।

-ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি আসো।

সিটি চিফ, মনিরুল ইসলাম স্যারকে ফোন দিলাম। তিনি বিষয়টি অবগত আছেন বলে জানালেন। সোয়াট টিমকে যেতে বলেছেন এবং বোম্ব টিম নিয়ে আমাকেও দ্রুত সেখানে যেতে বললেন।

আমি তখন নেভি হেডকোয়ার্টারের সামনে জ্যামে আটকা পড়ে আছি। এমন সময় একটা অপিরিচিত নাম্বার থেকে কল আসল,

-সানী ভাই বলছেন?

-জ্বি বলছি

-আহাদ কোথায়?

-আপনি কে বলছেন?

-ওহ ভাই, আমি আহাদের ওয়াইফ বলছি।

-আহাদের সাথে কিছুক্ষণ আগেই তো কথা হল। ও ভালো আছে। টেনশন নিয়েন না। আমি ওকে সাবধানে থাকতে বলেছি।

-ভাই, অনেক পুলিশ আহত হইছে। টিভিতে লাইভ দেখলাম। সেখানে আহাদকেও গাড়িতে উঠানো হচ্ছে। আমি নিজের চোখে দেখলাম।

- ভাবী, প্রশ্নই উঠে না। আমি ওকে নিরাপদে থাকতে বলেছি।

-ভাই, আমি ওর পাঞ্জাবিটা চিনি। ও আজ ওই পাঞ্জাবিটাই পরে গেছে।

ভাবী কাঁদছেন। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ফোনটা কানে নিয়ে বসে রইলাম। অতঃপর মোবাইলে টিভি দেখার একটা অ্যাপ্স ডাউনলোড করলাম। টিভি দেখে আঁৎকে উঠলাম - এ কী করে সম্ভব! অসংখ্য মানুষ রক্তাক্ত। তাদের নিয়ে শত শত মানুষ ছোটাছুটি করছে। টিভি স্ক্রলে লেখা উঠছে ২/৩ জনের অবস্থা নাকি গুরুতর।

আমি নিথর হয়ে গেলাম। আহাদকে ফোন দিলাম, কিন্তু আহাদ ফোন ধরছে না। তখন ভাবীর কথাটাই সত্য বলে মনে হতে লাগল। খুবই বিমর্ষ হয়ে গেলাম।

এমন সময় ডিসি গুলশান স্যারের ফোন আসে

-তুমি কোথায়?

-স্যার, আমি কাছাকাছি চলে এসেছি।

ফোনটা ডিসি গুলশান স্যারের হলেও কথা বলল কমিশনার স্যার। এবার উপায়ন্তর না পেয়ে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলাম।

রিকশায়, হেঁটে, দৌড়ে ইউনাইটেড হসপিটালের সামনে গিয়ে শুনি এসি রবিউল এবং ওসি সালাহউদ্দিন আর নেই। আহাদ গুরুতর আহত তবে শঙ্কামুক্ত। রবিউল ছেলেটা কিছুদিন আগে ডিবিতে জয়েন করেছিল। একদিন আমার রুমে এসে সে খুব গর্ব নিয়ে বলল,

-স্যার, আমি আপনার ভার্সিটির ছোট ভাই। আমার নাম রবিউল। আপনার কথা অনেক শুনেছি, স্যার। আমি এখানে ভালো কাজ করতে চাই। আপনার পরামর্শ এবং দোয়া চাই, স্যার।

কানের কাছে কথাগুলো খুব বাজতে লাগলো।

ওসি সালাহউদ্দিনের সাথেও অনেক জানাশোনা ছিল। প্রায়ই তার সাথে নানা বিষয়ে কথা হতো।

কয়েক মিনিটের ব্যবধানে দু'জন সহকর্মীর মৃত্যু শোকটা আমাকে খুব অসহায় করে দিল। তবে, পরক্ষণেই শোক আর ক্রোধ এক হয়ে এক অসীম শক্তি অর্জন। দৌড়ে চলে গেলাম মূল ঘটনাস্থলের দিকে।

সবাই খুব ব্যস্ত। মনিরুল ইসলাম স্যার ফোনে কাউকে আরও অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে আসতে বলছেন। স্যারের সামনে দাঁড়াতেই তিনি কমিশনার স্যারের সাথে দেখা করার ইঙ্গিত দিলেন।

কমিশনার স্যার আমাকে দেখেই বললেন,

-তুমি তোমার কাজ শুরু করে দাও। যাও, যাও তাড়াতাড়ি কর।

কাগজ-কলম নিয়ে ১০ মিনিটে স্কেচ আর ১৫ মিনিটের মধ্যে একটা ঝটিকা রেকী করার পর অপারেশন প্ল্যানটা মনিরুল ইসলাম স্যারের কাছে জমা দিলাম। তখন সঙ্গে ছিল সোয়াটের এডিসি আশিকুর রহমান। মনির স্যার সেটা কমিশনার এবং ডিজি-র‌্যাব স্যারকে ব্রিফ করতে বলেন। ডিজি স্যার পাশেই একটি বাসার ভেতর নিয়ে উপস্থিত সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ তিনি সেটা শুনেন এবং সম্মতি প্রদান করেন। পরবর্তী সময়ে আইজিপি স্যার এসেও সম্মতি দেন।

এরপর হলি আর্টিজানের মালিক সাদত ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নেই।

যাহোক, পরবর্তী সময়ে অভিযানটি প্যারা-কমান্ডো খুব সাহসিকতা এবং পেশাদারিত্বের সাথে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সমাপ্ত করে। আমাদের মাঝেও স্বস্তি ফিরে আসে।

সেদিন বোঝা গেল পুলিশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থা অত্যন্ত সুসংগঠিত। যেকোনো ঘটনা একজন পুলিশ সদস্য জানতে পেলেই মুহূর্তের মধ্যে তা সংশ্লিষ্ট জায়গায়গুলোতে পৌঁছে যায়। সন্ধ্যা-রাত থেকে ধীরে ধীরে ছুটে আসা সব পুলিশ সদস্য তখন বাড়ি ফিরতে শুরু করে। আমিও একগাদা দুঃসহ স্মৃতি আর ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে বাড়ি ফিরি। মানসিকভাবে দু'সপ্তাহ লেগেছিল হলি আর্টিজান থেকে বাসায় ফিরতে। গত কিছুদিন আগে মনে মনে আবার ফিরে গেছি সেই হলি আর্টিজানে। এখন আর এই হলি আর্টিজান শুধু একটি শোক নয়, এটা একটি চেতনা। এটা এখন ঘুরে দাঁড়ানোর, রূখে দেবার, সচেতন হবার, আত্মসমালোচনার, ঐক্যবদ্ধ হবার, দেশপ্রেমের এবং মানবিকতার একটি বড় চেতনার উদাহরণও বটে।

আমরা আমাদের দেশকে আর কোনো কালো হায়েনার ছোবলে ক্ষতবিক্ষত হতে দেবো না.... এটাই হোক 'হলি আর্টিজান'-এর চেতনা।

লেখক: কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের এডিসি

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :