ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রাজনৈতিক মূল্যায়ন

অনলাইন ডেস্ক
 | প্রকাশিত : ০১ জুলাই ২০১৭, ২২:১১

আর চার বছর পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স হবে ১০০ বছর। বয়সের হিসেবে পৃথিবীর অন্যান্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নবীনতর হলেও একাডেমিক এবং রাজনৈতিক অর্জনের দিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হবে, এ কথা বলা যায় নির্দ্বিধায়।

বস্তুত, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায়। শিক্ষার শক্তিতে একটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল এই প্রতিষ্ঠান। গত ৯৬ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রতিষ্ঠার প্রতিদান দিয়েছে কড়ায়-গণ্ডায়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তি হিসেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান যেমন অগ্রগণ্য, প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তেমনি প্রাতঃস্মরণীয়। ইতিহাসের গ্যাঁড়াকলে দুর্দশায় নিপতিত বাঙালি জাতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলা ভাষাভাষী একটি জনগোষ্ঠীকে জাতিতে পরিণত করার প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাসের বিস্ময়।

ইতিহাস যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি বিতর্ক জাগানিয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে আমাদের রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জনে প্রতিষ্ঠান হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছে সেটি অনুধাবন করতে হলে আমাদের ইতিহাসের একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতক রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ আর মীরজাফরদের অসহযোগিতার ফলে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব মির্জা মুহাম্মাদ সিরাজ-উদ-দৌলা (জন্ম: ১৭৩২ - মৃত্যু: ১৭৫৭) ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাজিত হলে ভারতবর্ষে প্রায় ২০০ বছরের ইংরেজ-শাসনের সূচনা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শাসন কাঠামোর এই পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষেরা এবং এর পেছনে সাম্প্রদায়িক এবং রাজনৈতিক কারণ ছিল। বিশেষ করে ১৮৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে সিপাহী-জনতার সম্মিলিত স্বাধীনতার যুদ্ধ ব্যর্থ হলে মুসলমানদের ওপর জুলুম-অত্যাচার আরও বেড়ে যায়।

ইংরেজদের কাছে ক্ষমতা হারিয়ে মুসলমানরা ক্ষুব্ধ হয়ে বিদেশি শক্তির সাথে যোগাযোগ রাখা বন্ধ করে দেয়, অন্যদিকে হিন্দু জমিদার শ্রেণি ইংরেজ আনুকূল্যে কলকাতাকেন্দ্রিক পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়। মুসলিম শাসন থেকে মুক্ত হওয়া গেছে ভেবে হিন্দুদের একটা অংশ ইংরেজদের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করে প্রশাসনিক কর্তৃত্বে এগিয়ে যায়। তাছাড়া পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের মধ্যেও উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সংখ্যা কম থাকায়, সব মিলে পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ দীর্ঘকালীন অর্থনৈতিক দূরবস্থায় নিপতিত হয়। অর্থনৈতিক দূরবস্থা কাটিয়ে উঠতে এক পর্যায়ে পূর্ববঙ্গের মানুষ বঙ্গভঙ্গের দাবিতে আন্দোলনে নামে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ করা হয়। কিন্তু এই বঙ্গভঙ্গ মেনে নিতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গের এলিটরা। কারণ ছিল মূলত অর্থনৈতিক, যদিও সাংস্কৃতিক কারণকে কোনো কোনো ইতিহাসবিদ হাইলাইট করেছেন। বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা নগরীকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির দ্বার উন্মুক্ত হলেও পশ্চিমবঙ্গের জমিদার শ্রেণির মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এর ফলে কংগ্রেস এর নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ রদের দাবিতে আন্দোলন হলে ইংরেজ শাসকরা ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করে। ১৯০৬ সালে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার নিমিত্তে মুসলিম লীগ গঠিত হলেও কংগ্রেসের সাথে দেন-দরবার করে স্বার্থ আদায়ের প্রক্রিয়ায় তখনো সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। পূর্ববঙ্গের মানুষের ভেঙে যাওয়া মন জোড়া দিতে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ঢাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ওয়াদা করে ব্রিটিশরা। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। লর্ড লিটন যাকে বলেছিলেন স্পেল্নডিড ইম্পিরিয়াল কমপেনসেশন। পূর্ববঙ্গ শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল। বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর এ অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন হয়েছিল, বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে’।

১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এর মাত্র তিন দিন পূর্বে ভাইসরয় এর সাথে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়েছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।

২৭ মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব করেন ব্যারিস্টার আর. নাথানের নেতৃত্বে ডি আর কুলচার, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, নবাব সিরাজুল ইসলাম, ঢাকার প্রভাবশালী নাগরিক আনন্দচন্দ্র রায়, জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)-এর অধ্যক্ষ ললিত মোহন চট্টোপাধ্যায়, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ডব্লিউ.এ.টি. আচির্বল্ড, ঢাকা মাদ্রাসার (বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজ) তত্ত্বাবধায়ক শামসুল উলামা আবু নসর মুহম্মদ ওয়াহেদ, মোহাম্মদ আলী (আলীগড়), প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ এইচ. এইচ. আর. জেমস, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সি.ডব্লিউ. পিক, এবং সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ সতীশ্চন্দ্র আচার্য।

১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় নাথান কমিটির ইতিবাচক রিপোর্ট এবং সে বছরই ডিসেম্বর মাসে সেটি অনুমোদিত হয়। ঢাকায় যেন বিশ্ববিদ্যালয় না হয় সে জন্যও তৎপর ছিল পশ্চিমবঙ্গের কিছু ‘শিক্ষিত’ মানুষ। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় কেন দরকার, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হলে এটি ‘মাদ্রাসা’ ছাড়া আর কী হবে, ইত্যাদি বলে অনেকে তখন হাসি-তামাশা করেছে। যাইহোক, ১৯২১ সালের ১ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। সেই থেকে শুরু। অনেক কঠিন সময় গেছে। ১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গের মানুষদের আবারো ঠকিয়ে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা হলে, সে সময়কার বিখ্যাত সব শিক্ষক, বিজ্ঞানী ভারত চলে যান। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাতে পথ হারায়নি। পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের প্রতিটি অন্যায় কাজের প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অসীম সাহস দেখিয়ে জাতিকে পথ নির্দেশ করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে নানা সংকটে জাতিকে সঠিক রাস্তা দেখানোর কাজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অব্যাহত আছে। ১৯৯০ সালের তৎকালীন স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন আন্দোলনেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে যে অগণতান্ত্রিক শাসন চেপে বসেছিল তার অবসানেও এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান ভূমিকা রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মান নিয়ে সমাজে অনেক প্রশ্ন। পুরো শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ সেখানে দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে এর বাইরে থাকতে পারে? মান যাই হোক, ঢাকা এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে আসা ছেলে-মেয়েরাই বাংলাদেশ পরিচালনা করছে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, আমলাতন্ত্র, সাংবাদিকতা সর্বত্র আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছেলে-মেয়েদের অগ্রণী ভূমিকা। এরাই দেশকে পরিচালনা করছে, এরাই ব্যর্থ হতে দিচ্ছেনা বাংলাদেশকে। হ্যাঁ, দেশে দুর্নীতি আছে, আছে অনিয়ম-অব্যস্থাপনা।

কিন্তু সাফল্যও তো কম নয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এদেশের নীতিনির্ধারকদের বড় একটা অংশকে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যা করা হয়। ৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন জাতীয় চার নেতা। এতবড় শূন্যতা পূরণে স্বাধীন বাংলাদেশে দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করছে। তবে বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অবদান, তার গৌরব দেশের আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :