বাজেট ও জাতীয় সঞ্চয়পত্র

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
 | প্রকাশিত : ০৪ জুলাই ২০১৭, ১০:৪৫

সংসদে পাশকৃত বাজেট ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। বাজেটে জনপ্রত্যাশার বহুলাংশ পূরণ হলেও জাতীয় সঞ্চয়পত্র নিয়ে একটা ধোঁয়াশে অবস্থা বিরাজ করছে। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট কোনো বক্তব্য দেননি, তবে অর্থমন্ত্রী মহোদয় জাতীয় সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রদত্ত সুদের হার কমানোর পক্ষে; কেননা তা বাজেটের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। তার মতে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কোনো অবস্থায় ব্যাংক প্রদত্ত সুদের হারের চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। এ প্রসঙ্গে বাজারে প্রচলিত আমানতের উপর সুদের হার নিয়ে কথা এসে যায়।

বর্তমানে ব্যাংকের সঞ্চয় হিসাবে সুদের হার সর্বনিম্ন এক শতাংশের নীচে আর সর্বোচ্চ তিন চার শতাংশ। প্রথমোক্ত ব্যাংকগুলো বিদেশি আর শেষোক্তগুলো স্বদেশি। উভয় ব্যাংকের ঋণের উপর সুদের হার এখনো দুই অংকের প্রায় কাছাকাছি। ফিক্সড ডিপোজিটে সুদের সর্বোচ্চ হার হচ্ছে ৫.৫ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো এখন সর্বোচ্চ ৯.৭৫ হারে আমনত গ্রহণ করছে। তাহলে বাজারে প্রচলিত সুদের হার কোনটি? দুটো প্রান্তিক অবস্থা বিবেচনা করলে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর মতে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার হতে পারে ৬ শতাংশ কিংবা ১৩.৭৫ শতাংশ। বর্তমানে প্রচলিত সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ভিন্ন ভিন্ন।

এক. পাঁচ বছর মেয়াদী পেনশনের সঞ্চয়পত্র, যার সর্বোচ্চ সীমা ৫০ লক্ষ টাকা ও সুদের হার ১১.৭৬%। দুই, পাঁচ বছর মেয়াদী পারিবারিক সঞ্চয়পত্র যার সর্বোচ্চ ক্রয় সীমা ৪৫ লাখ টাকা এবং সুদের হার ১১.৬২%। তিন, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র যার সর্বোচ্চ ক্রয়সীমা একক নামে ৩০ লক্ষ টাকা ও যৌথ নামে ৬০ লক্ষ টাকা এবং যার মুনাফার হার ১১.০৪ শতাংশ। এটাকে মুনাফা নামকরণের কোনো রহস্য থাকতে পারে এবং বিশেষ গোষ্ঠি বা সম্প্রদায় তা লুফে নিতে পারে। চার, পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র যা যে কোনো পুরুষ বা নারী এক নামে ৩০ লক্ষ ও যৌথ নামে ৬০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ক্রয় করতে পারেন। এখানে মুনাফার হার ১১.২৮ শতাংশ। নাবালকের পক্ষেও এই সঞ্চয়পত্র ক্রয় করা যায়।

তাহলে দেখা যায় বর্তমানে প্রদত্ত মুনাফার হার হচ্ছে সর্বনিম্ন ১১.২৮ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১১.৭৬ শতাংশ। ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই হার তারও বেশি ছিল। তার প্রধান কারণ ছিল তখন ব্যাংকে সঞ্চয় হিসাব ও ফিক্সড ডিপোজিট মুনাফার হারও অনেক বেশি ছিল।

এই সঞ্চয়পত্র বহু কাজে লাগছে। প্রথমত: এটা হচ্ছে ক্ষুদ্র আমানতকারী, অবসরভোগী, চাকরিজীবি এবং প্রবীন নাগরিকদের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ। দ্বিতীয়, সরকারের বাজেট ঘাটতি মেটাতে এই ঋণ বিদেশি সংস্থা কিংবা ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে জনগণের কাছ থেকে নেয়া যায়।

এই সঞ্চয়পত্রের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। শেয়ার বাজার দু’বার ব্যাপকভাবে খাবি খাবার পর উপযুক্ত ব্যক্তিবর্গ সেদিকে তেমন যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। তাদের বিকল্প সঞ্চয়পত্র ক্রয় কিংবা মার্চেন্ট ব্যাংকে আমানত রাখা। এখন পর্যন্ত মানুষের খুব একটা আস্থা যে মার্চেন্ট ব্যাংকের উপর তৈরি হয়েছে তা বলা যায় না। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে সে সবের মধ্যে অব্যবস্থা ও জালিয়াতির কথা বলা যায়। সরকার রক্ষাকবচ দিলেও অন্তত উপযুক্ত ব্যক্তিবর্গ তাদের শেষ সম্বল বিনিয়োগ করে ফতুর হওয়ার স্মৃতি ভুলছেন না। তাদের সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছে।

প্রথমত: মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর ছুঁয়েছে। এসব মানুষের সন্তানাদি এখন নিউক্লিয়াস পরিবার মন্ত্রে দীক্ষিত, ফলত বয়োজ্যেষ্ঠরা এখন অবহেলিত ও করুণার পাত্র। সঞ্চয়পত্রের সুদ তাদের একমাত্র ভরসা। ১৯৮১ সালে যেখানে প্রবীণ জনগোষ্ঠির সংখ্যা ছিল ৪০ লাখ ৯০ হাজার; বর্তমানে তা ১ কোটি ৩০ লাখের উপর। তারা সবাই ভোটার। সামনে একটি নির্বাচন আছে। তাই তাদের কথা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।

দ্বিতীয়ত: বাজেট ঘাটতি প্রায় ১১২ লাখ কোটির বেশি। প্রকাশিত হয়েছে যে তা মেটানো হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ও বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান থেকে। সরকার চাইবে স্বল্প সুদে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে এবং সে কারণে ভ্যাট আইনে পরিবর্তন আনতে চাওয়া হয়েছিল। অবশ্য তাতে রাজস্ব আয় বাড়ার সম্ভাবনাও ছিল যদি প্রতিটি ভ্যাট দাতার কাছে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার পৌঁছিয়ে তার যথার্থ ব্যবস্থাপনা করা যেত। সেটা না হওয়াতে বরং ভ্যাট আইন রহিত আছে। সরকার বিদেশি ঋণ নিলে চূড়ান্ত বিচারে সর্বনিম্ন সুদ সুবিধা পাবে তা নিশ্চিৎ নয়। এ নিয়ে বহু কথা প্রচলিত আছে। আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তাদের অনেকের ধারণা ঋণের ব্যাপকাংশ আবার উৎসে ফিরে যায়।

দ্বিতীয় বিকল্প হচ্ছে দেশের ব্যাংকে পড়ে থাকা অঢেল টাকা থেকে সর্বোচ্চ শতকরা নয় ভাগে ঋণ গ্রহণ। তাই সঞ্চয়পত্রে সর্বোচ্চ ১১-১২% মুনাফা না দিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসবে। তারল্যের পাহাড় গড়েও তারা কিভাবে মুনাফার পাহাড় গড়ছে তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। বিদেশি অনুদান নিলে মর্যাদা বোধে আঘাত লাগে, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কিছুটা হলেও খর্বিত হবে। নতজানু বৈদেশিক নীতির সম্ভাবনা থাকে, সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট এর টাকা বিদেশি মুদ্রায় প্রচলিত হারে শোধ হয়। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন দেশে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ থাকাবস্থায় এ জাতীয় পদক্ষেপ কতটা সমীচীন।

আগেই বলেছি ২০১৭-১৮ সালের বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ১১২ লক্ষ কোটি টাকা। তার থেকে প্রায় ৪৫ লক্ষ কোটি টাকা আসবে বিদেশি ঋণ থেকে। যার সাথে প্রতিকূল শর্ত জুড়ে দেয়া থাকে। তার চেয়ে এই অর্থ জাতীয় সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সংগৃহীত হলে কি হয়?

ইতোমধ্যে সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের হিড়িক পড়ে গেছে। গত বছরের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে এই সঞ্চয়পত্রের উপর এখন মাসে ৪ কোটি টাকা মুনাফা দিতে হয়। তার উপর কর কাটা হয় ৪০ লক্ষ টাকা। সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের হিড়িকে এই অংকটা মাসিক ৮ কোটি ও ৮০ লক্ষে উন্নীত হতে পারে। এই অবস্থার পরিবর্তন হবে যদি সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের মধ্যে কোটিপতিদের বাদ দেওয়া হয়। শুনেছি বিদ্যমান ক্রেতাদের ৬৬ শতাংশ কোটিপতি। প্রাতিষ্ঠানিক ক্রেতা ভিন্নভাবে নাকি রয়েছেন। তাদের সংখ্যা কোনোভাবে কমানো সম্ভব হলে বাজেটের উপর সুদের চাপ কমবে।

তবে এক বিশাল জনগোষ্ঠি যারা অসহায় বা নিরুপায়, তারা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলবেন। বিদেশি ঋণ ও অনুদান সর্বাংশে বর্জন সম্ভব হবে, কেননা আমাদের রয়েছে অব্যবহৃত ৩৪ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ। বিষয়গুলো গভীরভাবে চিন্তা করেই সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হারে হাত না দেয়া সঙ্গত হবে। এর পক্ষে রয়েছে বহু মানুষ আর বিপক্ষে আছেন অতি বুদ্ধিমান বাস্তববাদীগণ। আমার ধারণা বেসরকারি খাতে পেনশন সুবিধা প্রবর্তন ও তা কার্যকর করার পূর্ব পর্যন্ত এই সঞ্চয়পত্রই হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অবসরভোগীদের একমাত্র পাথেয়। সরকার পেনশন ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে, তাতেও কিছু সুখবর রয়েছে, তবে তা কার্যকর হবার আগে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার অপরিবর্তিত থাকলে দেশের টাকা দেশের মানুষ থেকে পাওয়া যাবে। তার বৈষয়িক দিকটিও কম উজ্জ্বল নয়। আমাদের মানসম্মান, স্বনির্ভরতার জন্যও তা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার ধারণা বাজেটের ঘাটতির পরিমাণ আরও অন্তত: ২৩ হাজার কোটি টাকা বাড়বে। কেননা ভ্যাট আইন বাতিলের প্রতিফল তাই হবে। আমার ধারণা ভিন্ন, ভ্যাটের জালে বর্তমান আট লক্ষাধিক ও ভ্যাট দিতে সমর্থ ৫০ লক্ষাধিক জালে আনা হলে এবং তাদের বিশালাংশকে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার সরবরাহ করা হলে রাজস্ব আহরণ ও বাজেট অর্থায়নে এতটা চিন্তিত হতে হবে না। ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন বিশেষত দুর্নীতি কমলে অনেক সমস্যার আশু সমাধান মিলবে। পুঁজিবাজার গঠনের নির্দেশনা ও টাকা সংগ্রহের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো।

শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা, উপাচর্য ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :