বাজেট নিয়ে কথামালা

মাসুদ কামাল
 | প্রকাশিত : ০৬ জুলাই ২০১৭, ১৭:৩৯

বাজেট ঘোষণার প্রায় এক মাস পর সেটি পাস হলো জাতীয় সংসদে। বরাবর এ রকমই হয়, অর্থমন্ত্রী পার্লামেন্টে বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন, মাসব্যাপী তা নিয়ে আলোচনা হয়। সংসদে আলোচনা হয়, সংসদের বাইরে আলোচনা হয়। আলোচনা হয় বাজেট প্রস্তাবের ভালো-মন্দ নিয়ে। তত্ত্বগতভাবে এই আলোচনাগুলো জরুরি। কারণ এই আলোচনার ওপর ভিত্তি করেই বাজেট প্রস্তাবের পরিবর্তন করার কথা। তবে আমরা প্রায়ই সে রকম দৃশ্য দেখি না। দেখা যায়, আলোচনা-সমালোচনা যা কিছুই হোক না কেন, বাজেট প্রস্তাবে তেমন কোনো পরিবর্তন শেষ পর্যন্ত হয় না। অর্থমন্ত্রী শুরুতে যা প্রস্তাব করেন, মাসজুড়ে সরকারি দলের সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীরা সেই প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়ে যান। তাই বিরোধী দলগুলো যত সমালোচনাই করুক না কেন, সেগুলো বিশেষ পাত্তা পায় না।

কিন্তু এবার যেন কিছুটা ভিন্ন দৃশ্য দেখা গেল। কেবল বিরোধী দলই নয়, সরকারি দলের অনেক বড় নেতাও অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবনার সমালোচনা করলেন। সমালোচনাগুলো প্রধানত এলো তিনটা পয়েন্টে। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন, ব্যাংকে জমাকৃত অর্থের ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি এবং সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানো। এর মধ্যে তৃতীয়টি অবশ্য বাজেট প্রস্তাবনায় ছিল না, ছিল কেবল প্রথম দুটি। কিন্তু তবুও কেন যেন আলোচনায় তিনটি বিষয়ই একসঙ্গে চলতে থাকল। মন্ত্রী-এমপিরা বাজেট প্রস্তাবের সমালোচনার পাশাপাশি তীব্রভাবে সমালোচনা করলেন অর্থমন্ত্রীরও। এটি নতুন। অন্তত গত কয়েক বছরে এ রকম দেখেছি বলে মনে করতে পারি না। মন্ত্রী-এমপিদের ওই সমালোচনা যখন চলছিল, তখন অনেকেই বলছিলেন যে, এগুলো আসলে শীর্ষ পর্যায় থেকে গ্রীন সিগন্যাল থাকার কারণেই সম্ভব হচ্ছে। আর যেহেতু সিগন্যালটা উচ্চ পর্যায় থেকেই এসেছে, তাহলে আশা করা যায় চূড়ান্ত বাজেটে কিছু পরিবর্তন আসছে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেই পরিবর্তন দেখা গেছে। যে বিষয়গুলো নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছিল, সেগুলোতেই এসেছে পরিবর্তন। নতুন ভ্যাট আইন চালুর যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, সেটা বাদ দেয়া হয়েছে। আর ব্যাংকে রাখা টাকার উপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছিল, সেটাও বাতিল হয়েছে।

তবে আমার আজকের এই লেখা বাজেট নিয়ে বিশ্লেষণ নয়, আসলে সে বিশ্লেষণের ক্ষমতাও হয়তো আমার নেই। আমি অর্থনীতিবিদ নই, অর্থনীতির অনেক সহজ সূত্রও বুঝি না। আমার উপলব্ধি আমজনতার মত। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে মনে করি বাজেট ভালো হয়নি, বেতনের টাকায় সংসার চালাতে আগের চেয়ে বেশি কষ্ট হলে মনে করি- এই বাজেট আমার জন্য নয়। আমি বরং আজ লিখতে বসেছি বাজেট নিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদরা যে বিচিত্র সব আলোচনা করেছেন, তা নিয়ে। এসব আলোচনা দেখে মাঝেমধ্যে আমার মনে এমন সন্দেহ জন্ম নিয়েছেÑ ওনারা আসলে কি চান, দেশের ভালো, মানুষের ভালো নাকি নিজের ভালো?

বাজেট প্রস্তাবের সমালোচনা প্রথমে জোরালো এবং কার্যকরভাবে কে শুরু করেছে? এ নিয়ে হয়তো নানাজন নানা কথা বলতে পারেন। তবে আমি বলবো- ফেসবুক। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি বর্তমানে এতটাই শক্তিশালী হয়েছে যে, মাঝেমধ্যে মনে হয়Ñ এরাই বুঝি দেশের একমাত্র বিরোধী দল। বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি নামের যে দুটো বিরোধী দল আছে, সেগুলোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রায়ই আমাদেরকে হতাশ করে। চলমান সেই হতাশার মধ্যেই এবারও প্রথম প্রশ্নটি তুললো সেই ফেসবুক। প্রশ্নের যৌক্তিকতার কারণেই সম্ভবত সেটা ভাইরাল হতে শুরু করলো। তারপর তারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের কণ্ঠে।

তবে আজ আমরা আমাদের আলোচনা কেবল জাতীয় সংসদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবো। সংসদে অনেকেই কথা বলেছেন, সমালোচনা করেছেন। গৃহপালিত বিরোধী দল হিসাবে পরিচিত জাতীয় পার্টির কিছু নেতাকেও এসময় দেখা গেছে বিপ্লবী ভূমিকায়। প্রথমেই বলা যায় জাতীয় পার্টির নেতা জিয়াউদ্দিন বাবলুর কথা। তিনি ব্যাংকিং খাতের ঘাটতি পূরণের জন্য বাজেটে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার সমালোচনা করে বলেনÑ ‘লুটের টাকার ঘাটতি পূরণে করদাতাদের দেওয়া অর্থ খরচের অধিকার অর্থমন্ত্রীর নেই।’ বাবলুর এই বক্তব্যকে আমি খুবই সমর্থন করি। আসলেই তো দেশের ব্যাংকগুলোতে অবাধ লুটপাট চলছে। এদেশে ঋণ এবং খেলাপি ঋণ যেন সমার্থক হয়ে গেছে। ব্যাংক থেকে যারা বড় অঙ্কের ঋণ নেয়, তারা অবধারিতভাবেই তা পরিশোধ না করার মতলবেই নেয়। যার এক টাকাও শোধ করার ক্ষমতা নেই, তাকেও ব্যাংক হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়ে দেয়। এ নিয়ে হইচই হলেও কোনো প্রতিকার হয় না। ঋণগ্রহীতা টাকা পরিশোধ করে না, দিন কয়েক লোক দেখানো জেল খেটে একসময় নীরবে বের হয়ে যায়। অবৈধভাবে যে ব্যাংক কর্মকর্তা ঋণ বরাদ্দ দেয়, তারও তেমন কিছু হয় না। আর এসব নিয়ে প্রশ্ন করল নির্বিকার অর্থমন্ত্রী উচ্চারণ করেন, ‘চার হাজার কোটি টাকা তেমন বেশি কিছু নয়!’ মুখে ‘বেশি কিছু নয়’ বললেও, পরে গিয়ে কিন্তু বাজেটে আবার ব্যাংকিং খাতের ঘাটতি পূরণের অজুহাতে ওই টাকাটা জনগণের কাছ থেকে ঠিকই নিয়ে নেন।

এসব বিবেচনায় জাপা নেতা বাবলুর বক্তৃতা খুবই যুক্তিযুক্ত। তিনি বক্তৃতা ভালোই দেন, সেই ছাত্রজীবনে যখন বাম রাজনীতি করতেন, তখন থেকেই ভালো বক্তৃতা করেন। ছাত্রজীবনে উনি যে দলের নেতা ছিলেন, আমি সেই দলের কর্মী ছিলাম। ওনার কথা তখন মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। কিন্তু কথা আর কাজের মধ্যে মিল থাকা না থাকারও একটা বিষয় তো থেকেই যায়। বিপ্লবী বাবলু সাহেব যখন এক রাতে ডিগবাজি দিয়ে স্বৈরাচার এরশাদের কোলে গিয়ে ঢুকলেন, তখন থেকে আমার সেই মুগ্ধতা ঘৃণায় পরিণত হয়। সেই হিপোক্রেসির নমুনা এখনও দেখে চলেছি। এই যে এত বিপ্লবী বাবলু, উনি নিজে কি? উনি নিজেও কিন্তু একটা বেসরকারি ব্যাংকের মালিকানার সঙ্গে জড়িত। আর লুটপাটের কাহিনি সরকারি ব্যাংকের চেয়ে বেসরকারি ব্যাংকে বরং এখন আরও বেশি। ওনার ব্যাংকও কি খেলাপি ঋণের মহামারি থেকে মুক্ত?

বলতে বলতে বাবলু সাহেব অবশ্য একটু বেশি আবেগপ্রবণও হয়ে পড়েছিলেন। তিনি অর্থমন্ত্রীকে সরাসরি আক্রমণ করেছেন। বলেছেন, অর্থমন্ত্রী অনৈতিক কাজ করছেন, আইনবিরোধী প্রস্তাব করেছেন। তাই ওনাকে আইনের আওতায় আনতে হবে, আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল চার্জ আনা উচিত বলে মন্তব্য করেই তিনি থামেন শেষ পর্যন্ত। অনেক দিন পর বাবলুভাইয়ের এমন বিপ্লবী ভাষণে আমি রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, সংসদ থেকে বের হয়েই বুঝিবা তিনি অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল চার্জ আনতে আদালতে যাবেন। কিন্তু বাস্তবে তা যাননি। আর এই না যাওয়াটাই যে ওনার বর্তমান চরিত্রের জন্য স্বাভাবিক, সেটি তিনি আবারও প্রমাণ করলেন।

জাতীয় পার্টির আর এক নেতা কাজী ফিরোজ রশীদও বললেন অনেক বিপ্লবী কথা। এক পর্যায়ে তিনি অর্থমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন- মাফ করে দিন, আপনার কাছে আর বাজেট চাই না। তিনি ব্যাংকে রাখা টাকার উপর আবগারি শুল্ক আরোপের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বাজেটকে অভিহিত করেন তিনি জনগণের জন্য ‘শ্রেষ্ঠ তামাশা’ হিসাবে। এক পর্যায়ে তিনি সরকারকে কিছু পরামর্শও দেন। বলেন- এই বাজেটের কারণে সরকারের নাকি ভোট নষ্ট হবে। তার ভাষায়, ‘আপনি কী বাজেট দিয়েছেন? আগামী বছর তো ভোট। এটা কী ভোটের বাজেট দিলেন, না ভোট নষ্ট করার বাজেট দিলেন? ভোটারদের উপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করলেন আর তারপর তাদের কাছে ভোট চান, দেশের মানুষ কি এতই পাগল!’ তার এই কথায় সরকারের প্রতি তার দরদের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে। আসলে এই ভদ্রলোকের অনেক দুঃখ। এই দেশে কারও জন্ম গোপালগঞ্জে হওয়াটা একটা ভাগ্যের বিষয়। কাজী ফিরোজ রশীদের বাড়ি গোপালগঞ্জে। অথচ গোপালগঞ্জে জন্ম হওয়ার কারণে দুঃখিত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি সম্ভবত শীর্ষস্থানীয়। এক সময় তিনি ছাত্রলীগ করতেন, পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগ করতেন, অথচ মন্ত্রী হওয়ার জন্য তাকে যেতে হলো জাতীয় পার্টিতে। দেয়া-নেয়ার এই সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি থেকে একাধিক ব্যক্তি মন্ত্রিত্ব পেলেও তিনি পেলেন না, এমনকি বিরোধী দলীয় উপনেতাও হতে পারলেন না- এই দুঃখ তিনি কোথায় রাখবেন? তারপরও উনি দরদ দেখিয়ে যাচ্ছেন সরকারি দলের প্রতি। তিনি এমনভাবে কথা বললেন, যেন এই সরকার জনগণের ভোট পাওয়ার জন্য খুবই উদগ্রীব।

সরকারি দলের মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর কথা। তিনি ব্যাংকে রাখা আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, বাড়তি আবগারি শুল্ক থেকে সরকার পেতে পারে বড়জোর ২০০ কোটি টাকার মতো। কিন্তু বিপরীতে এর জন্য বিপুল সংখ্যক মানুষের আয় কমে যাবে। তিনি বলেন, ‘পুরো প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিলে ক্ষতি হবে ৩৫৫ কোটি টাকা। এটা অর্থমন্ত্রীর জন্য, আমাদের বাজেটের জন্য পিনাট। সেখানে কেন উনি (অর্থমন্ত্রী) হাত দিচ্ছেন?’ খুবই যৌক্তিক কথা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি মন্ত্রীর এই কথার পূর্ণ প্রতিফলন দেখা গেছে? বাড়তি আবগারি শুল্কের প্রস্তাব অবশ্য প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে, তবে পুরোটা প্রত্যাহার করা হয়নি। আবগারি শুল্কটা রয়েই গেছে। অর্থনীতিবিদরা অবশ্য ব্যাংকে জমা রাখা টাকার ওপর আবগারি শুল্ক আরোপের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের মতে, আবগারি শুল্ক ধরা হয় মদ গাঁজা আফিম ভাং বিড়ি সিগারেট তামাকের ওপর। অর্থাৎ যে সকল পণ্যের ব্যবহারকে সরকার নিরুৎসাহিত করতে চায়, সেসবের ওপরই এই শুল্ক আরোপ করা হয়। এখন যদি ব্যাংকে রাখা আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক ধরা হয়, তাহলে কি এটাই প্রমাণিত হয় না যে, সরকার চায় না- কেউ ব্যাংকে টাকা রাখুক? মতিয়া চৌধুরী হয়তো এই নৈতিক প্রশ্নটির কথাই চিন্তা করে থাকবেন। শেষ পর্যন্ত সেই নৈতিকতার প্রতিফলন পাস হওয়া বাজেটে দেখা যায়নি। বাড়তিটা থেমেছে, পুরোটা প্রত্যাহার হয়নি। ফলে নৈতিকতার প্রশ্নটি থেকেই যাচ্ছে।

সরকারি দলের আর এক উচ্চকিত কণ্ঠ ছিলেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম। ইনি মন্ত্রী নন। তবে সবাই জানেন, খুবই ক্ষমতাবান নেতা উনি। কথা যখন বলেন, দায়িত্ব নিয়েই বলেন। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি সরাসরি সমালোচনা করলেন অর্থমন্ত্রীর। তাকে একগুঁয়ে, বৃদ্ধ, বাচালÑ ইত্যাদি বিশেষণেও অভিহিত করলেন। সাবেক তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বললেন, এই বাজেট দিয়ে নাকি অর্থমন্ত্রী জনগণকে বিভ্রান্ত করেছেন। আর এক দায়িত্ববান নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফও বললেন অনেক কথা। হানিফ সাহেব ভ্যাট নিয়ে একটা দুর্দান্ত কথা বললেন। তার ভাষায়, ‘অর্থমন্ত্রী ভ্যাট আরোপ করেছেন গণহারে। পৃথিবীর ইতিহাসে এক বছরে ৩০ শতাংশ বাড়তি ভ্যাট আহরণের নজির নেই। এটা যৌক্তিক নয়।’ তার এই বক্তব্যকে যদি সঠিক ধরি, তাহলে তো ভ্যাট আইনটিকে বাতিলই করা উচিত ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো তা হয়নি, সেটিকে মাত্র দু’বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। তাহলে দু’বছর পর যখন আবার চালু করা হবে তখন কি বলবেন হানিফ সাহেব?

এভাবে জাতীয় পার্টি এবং সরকারি দলের নেতারা যখন বাজেট এবং অর্থমন্ত্রীর সমালোচনায় সংসদকে গরম করে তুলছিলেন, তখনই তাতে পানি ঢেলে দিলেন দুই সিনিয়র মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং আমীর হোসেন আমু। তারা অর্থমন্ত্রীর প্রশংসা শুরু করলেন। সবাই মেসেজ পেয়ে গেলো, বুঝলো- অনেক হয়েছে এবার থামাতে হবে সমালোচনার নাটক। শুরু হলো প্রশংসার ফুলঝুড়ি।

এই পর্বে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বললেন, অর্থমন্ত্রীকে অনেকে ব্যক্তিগতভাবে কটাক্ষ করেছেন, যা দুঃখজনক ও অনাকাক্সিক্ষত। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের মতে, এই অর্থমন্ত্রীই দেশের উন্নয়নের পথ নকশাকারী। বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মুহা. ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক বলেন, অর্থমন্ত্রীকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হবে। আবার তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, অর্থনীতি সফল হলে অর্থমন্ত্রীও সফল, প্রধানমন্ত্রীও সফল। এক মুখে সফল অর্থনীতি বলে আরেক মুখে ব্যর্থ অর্থমন্ত্রী বলবেন, এটা হয় না। সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বললেন, অর্থমন্ত্রী একজন দক্ষ ব্যক্তিত্ব এবং তাকে নিয়ে আমরা গৌরববোধ করি। মন্ত্রী এবং নেতাদের দ্বিতীয় পর্বের কথাবার্তা থেকে আমরা আমজনতা কি বুঝবো?

এই পর্যায়ে শিল্পমন্ত্রী একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুললেন। বললেন- এই বাজেট তো মন্ত্রিসভায় পাস হয়েছে, তাহলে মন্ত্রীরাই আবার কিভাবে এর সমালোচনা করেন? কৃষিমন্ত্রী কিংবা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী এই প্রশ্নের কি জবাব দেবেন, তা হয়তো তারাই বলতে পারবেন। তবে জনগণের কাছে এই প্রশ্নের একটা সম্পূরক প্রশ্নও কিন্তু আছে। সেটি আবার খোদ শিল্পমন্ত্রীর কাছেই। আচ্ছা বাজেট তো উপস্থাপনের আগে মন্ত্রিসভায় পাস হয়েছে। মন্ত্রীরা যদি এই বাজেটের সমালোচনা না করতে পারে, তাহলে চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীই বা সেই পাস হওয়া বাজেট থেকে ভ্যাট ও আবগারি শুল্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি ইস্যুকে বাদ দিলেন কি করে? মন্ত্রিসভায় তো প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন। আসলে এসব নিছকই কুতর্ক। তবে এটাও ঠিক, কুতর্কের শুরুটা কিন্তু সরকারের মন্ত্রীগণই করে দিয়েছেন।

তবে বাজেট নিয়ে আলোচনায় কৌতুকপ্রদ পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছেন জাতীয় পার্টির শীর্ষ দুই ব্যক্তি- দলের চেয়ারম্যান এরশাদ এবং সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ। এই স্বামী-স্ত্রী দু’জন বলেছেন সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী কথা। এরশাদ বলেছেন এটা নিকৃষ্টতম বাজেট, আর তার স্ত্রী রওশন এরশাদ ধন্যবাদ জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রীকে এমন বাজেট দেয়ার জন্য। এরশাদ বিড়ির ওপর ট্যাক্স কমানোর প্রস্তাব দিয়েছেন আর রওশন দাবি জানিয়েছেন বিড়ি কারখানা বন্ধ করে দেয়ার! রওশন যখন এমন কথা বলছিলেন, তখন তার পাশে বসা এরশাদ হাসছিলেন, পুরো সংসদে হাসির রোল পড়ে গিয়েছিল।

আর সংসদে যখন মাসজুড়ে বাজেট নিয়ে এহেন আলোচনা, সমালোচনা, পাল্টা সমালোচনার নাটক চলছিল; সাংসদরা যখন নিজেরা নিজেরা আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের খেলা খেলছিলেন, সাধারণ জনগণও কি এসব দেখে কৌতুক অনুভব করছিল?

মাসুদ কামাল: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :