তরুণদের মাঝে উদ্ভাবনী চিন্তা ছড়িয়ে দিতে চাই

আসাদুজ্জামান
 | প্রকাশিত : ০৭ জুলাই ২০১৭, ০৮:২৮

ছিলেন তরুণ উদ্ভাবক ও ক্রীড়ামোদী। সেখান থেকে হয়ে উঠলেন তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা। তরুণদের উদ্ভাবন বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার স্বপ্ন নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরাম। দেশে এটিই প্রথম সংগঠন যারা তরুণ উদ্ভাবকদের নিয়ে কাজ করছে। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আরিফুল হাসান অপুর উদ্ভাবনী চিন্তা ও সংগঠক হয়ে ওঠার কাহিনি উঠে এসেছে ঢাকাটাইমসের সঙ্গে তার এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে। আলাচারিতায় ছিলেন ঢাকাটাইমসের বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিবেদক আসাদুজ্জামান।

আপনার বেশ কিছু উদ্ভাবন আছে। বিজ্ঞান নিয়ে অনেক দিন ধরে কাজ করছেন। পেয়েছেন স্বীকৃতিও। সেগুলো একটু শুনতে চাই।

আমি জাতীয় বিজ্ঞান মেলায় অংশ নিয়ে সাতবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। এর বাইরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সব মিলিয়ে

৩২ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি।

আপনার উদ্ভাবনগুলো কী কী?

আমার নিজের বেশ কিছু উদ্ভাবন আছে। যেমন আমি একটি সার্কিট বানিয়েছিলাম, যেটা দিয়ে ১০ ধরনের কাজ করা যায়। যেমন মাউন্টেন রোড সিকিউরিটি, শ্যালো মেশিন বন্ধসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করা যেত।

এই যন্ত্রের প্যাটেন্ট নিয়েছিলেন?

না, আমি এটার প্যাটেন্ট নেইনি। আসলে তখন জানতামই না নিজস্ব উদ্ভাবনের জন্য প্যাটেন্ট নিতে হয়। আমাকে গাইড করার জন্য সে সময় কেউ ছিল না।

আমার আরেকটি উদ্ভাবন ছিল স্বয়ংক্রিয় পানির কল। বেসিনে পানির কলের নিচে হাত নিয়ে গেলেই পানি পড়তে শুরু করবে। এখন বাজারে কলটি পাওয়া যাচ্ছে। অথচ আমি ২০ বছর আগে উদ্ভাবন করেছিলাম। এই উদ্ভাবনের জন্যও প্যাটেন্ট নেয়া হয়নি।

বিজ্ঞানের প্রতি আপনার ঝোঁক কীভাবে হলো?

ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ আমার। বিভিন্ন যন্ত্র ভেঙে দেখতাম তার মধ্যে কী আছে। বাসার পুরনো রেডিও খুলে দেখতাম এগুলো কীভাবে চলে, কীভাবে কাজ করে। সব মিলিয়ে ছোটবেলা থেকেই আমার কৌতূহলী মন। স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় অংশ নিতাম। মার্শাল আর্ট আর বিজ্ঞানচর্চা আমার জীবনে পাশাপাশি ছিল। এগুলোতেই বেশি সময় দিতাম। ফলে আমার খুব বেশি একটা বন্ধু ছিল না।

আপনি তো মাশাল আর্টে ব্ল্যাক বেল্টধারী।

আমি মার্শাল আর্টে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ব্রুসলির স্টাইল ‘জিৎ কুনে দো’ শিখে ব্ল্যাক বেল্ট পাই ১৯৯৫ সালে।

‘দ্য স্কুল অব চাইনিজ কুংফু’ নামে আমার একটা স্কুলও ছিল। এটা বাংলাদেশ উশু অ্যাসোসিয়েশন অনুমোদিত ক্লাব।

আমি বাংলাদেশ উশু অ্যাসোসিয়েশনের জাতীয় বিচারক। উশুর সাউথ এশিয়ান বিচারক হিসেবে কাজ করার জন্যও আমার নাম মনোনীত হয়েছিল। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সেবার অংশ নিতে পারিনি। আগামী বছর ইচ্ছা আছে অংশ নেয়ার।

২০০২ সাল থেকে আমি উশু অ্যাসোসিয়েশনের জাতীয় বিচারক হিসেবে কাজ করছি। এই পর্যন্ত দেড় শর বেশি খেলা পরিচালনা করেছি।

আপনার জন্ম ও বেড়ে ওঠা কোথায়?

আমার জন্ম ফেনীতে। সেখানেই আমার ছেলেবেলা ও কৈশোর কেটেছে।

আইসিটি ব্যবসায় কীভাবে এলেন?

ছেলেবেলায় যেহেতু বিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁক ছিল, সেই ঝোঁক থেকেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসা শুরু করা। টেকনোলজির ডাইভারসিফিকেশন হয়েই তো ইনফরমেশন টেকনোলজি হয়েছে। টেকনোলজি নিয়ে কাজ করতে করতে ইনফরমেশন টেকনোলজি নিয়ে কাজ শুরু করা।

বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরামের জন্মকথা শুনতে চাই।

আমাদের একটা বিজ্ঞান ক্লাব ছিল। নাম ছায়াপথ বিজ্ঞান ক্লাব। ২০০২ সালে জন্ম নেয়া ক্লাবটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলাম আমি। এর ৫৫টির মতো ইউনিট ছিল।

২০০৪ সালে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের সঙ্গে যৌথভাবে আমরা একটি কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলাম। ওই সময়ে সায়েন্স ক্লাব পরিচালনা করতে গিয়ে তরুণদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে ও তাদের নিয়ে কাজ করার আগ্রহ প্রবল হয়।

বলা যায়, আজকের ইনোভেশন ফোরাম দাঁড়িয়ে আছে ছায়াপথ সায়েন্স ক্লাবের ভিত নিয়ে। যেসব তরুণ উদ্ভাবনী চিন্তা করে তাদের নিয়েই কাজ করছে ইনোভেশন ফোরাম। বেসিসের হয়েও তো আপনি কাজ করছেন।

ছাত্রদের নিয়ে বাংলাদেশের বড় একটি সংগঠন বেসিস স্টুডেন্ট ফোরাম। বেসিস স্টুডেন্ট ফোরামের আহ্বায়ক ছিলাম আমি। এ ছাড়া ২০১৪-১৬ সালে আমি বেসিসের পরিচালক ছিলাম।

বেসিসের সঙ্গে কি এখনো যুক্ত আছেন?

বেসিস পরিচালক হওয়ার আগে দীর্ঘ নয় বছর আমি বিভিন্ন কমিটিতে ছিলাম। এরপর প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হই। এখন আমি বেসিসের ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে কাজ করছি।

ফিরে আসি ইনোভেশন ফোরামের কথায়।

হ্যাঁ। যেহেতু আমি ছাত্র ও তরুণ উদ্ভাবকদের নিয়ে কাজ করেছি, তাই উদ্ভাবনী চিন্তা থেকেই বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরামের যাত্রা শুরু হয়। আমাদের দেশের অনেক তরুণেরই ভালো আইডিয়া আছে। কিন্তু এটা ম্যাচিউরিটি স্টেজে যেতে পারে না। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আজ থেকে ২০ বছর আগে যদি বাংলাদেশে ইনোভেশন ফোরামের মতো কোনো সংগঠন থাকত তবে আমার উদ্ভাবনগুলোও পরিপক্বতা পেত।

বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরামের কাজটি কী?

আমরা মূলত তিনটি কাজকে ফোকাস করছি। প্রথমটা হলো গুড মেন্টরিং সাপোর্ট। আমাদের এখানে প্রায় ১৪০ জনের মেন্টর আছেন। তাদের মধ্যে হাইস্কিলডরা আছেন, যারা বাংলাদেশের বাইরেও কাজ করেন-ডেল, আইবিএম এবং গুগলে।

উদ্ভাবন কমার্শিয়ালাইজেশন করতে গেলে প্যাটেন্ট কিংবা কপিরাইট করতে হয়। এসবের সাপোর্ট আমরা দিব। এ ছাড়া এটি বাজারে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া হবে। এ জন্য আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পার্টনারশিপ করছি। ইতোমধ্যে এটুআই, ডেটা সফট এবং লিডস-এর সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো তরুণদের ইনোভেশন বাস্তবায়ন করতে সমর্থন দেবে।

আপনি তো নাসায় গিয়েছিলেন।

হ্যাঁ। তবে বিজ্ঞানী হিসেবে নয়, সংগঠক হিসেবে। বাংলাদেশ থেকে প্রথমবার অফিসিয়ালি নাসা থেকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

আমি নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতায় পরপর তিনবার আহ্বায়ক ছিলাম। সেই সুবাদেই সেখানে গিয়েছিলাম। আমরা তিনজনের একটি টিম নিয়ে গিয়েছিলাম। ওখানকার অভিজ্ঞতা চমৎকার। আমরা নাসার চিফ টেকনিক্যাল অফিসারের সঙ্গে দেখা করি। কথা হয় চিফ ইনোভেশন অফিসার ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে। এ ছাড়া নাসার চিফ লিয়াজোঁ অফিসারের সঙ্গে দেখা হয়। তাদের আমরা বাংলাদেশের তরুণদের সক্ষমতার কথা বলি। দেশের তরুণ বিজ্ঞানীদের নাসায় কাজ করার আগ্রহ জানাই। নাসার পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়।

বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরাম ৫ আগস্ট ঢাকায় ইনোভেশন সামিটের আয়োজন করছে। এই সামিটের উদ্দেশ্য কী?

শুধু প্রযুক্তি নয় যেকোনো নতুন চিন্তা ও ধারণাকে স্বাগত জানানোর জন্য এই আয়োজন। আমরা এই সামিটে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে সভা-সেমিনারের আয়োজন করছি। আইটি, নন- আইটি সবার জন্য উন্মুক্ত এই সামিটে দুটি গ্রুপকে টার্গেট করেছি। একটা হলো যারা এন্টারপ্রেনার হতে চায়। আরেকটা হলো যারা করপোরেট ওয়ার্ল্ডে ভালো জব চায়। যারা ভালো প্রফেশনাল হতে চায়। কীভাবে তরুণরা জব পেতে পারেন, কীভাবে তারা ইন্টারভিউতে নিজেদের উপস্থাপন করবেন তা জানাতেও সামিটে আয়োজন থাকবে। এ ছাড়া ভালো এন্টারপ্রেনার হতে গেলে তাকে কী কী করতে হবে তাও জানিয়ে দেয়া হবে। বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে আলোচনা করবেন।

আপনারা স্মার্ট সিটির কথা বলছেন। কেমন হবে সেই সিটি?

স্মার্ট সিটি নানাভাবে কানেকটেড থাকবে। যে সিটি হবে ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত। যেখানকার সবকিছু হবে সুনিয়ন্ত্রিত ও সংযু্ক্ত। এতে করে নাগরিক পরিষেবা পাওয়া যাবে সহজেই। মানুষের জীবনযাত্রাও হবে অনেক সহজ।

আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

আমরা চাইছি বাংলাদেশে নতুন নতুন চিন্তা করার সংস্কৃতি তৈরি হোক। নতুন নতুন উদ্ভাবন বের হয়ে আসুক। কেননা, উদ্ভাবনী চিন্তা ও কাজের সমন্বয় হলেই কেবল যেকোনো কাজের সফলতা আসে।

আমাদের মূল পরিকল্পনা হলো সারা বাংলাদেশে তরুণদের মাঝে উদ্ভাবনী চিন্তার বার্তা ছড়িয়ে দেয়া। প্রতিটি ভালো কাছের পেছনে ইনোভেশন জড়িত। আমাদের তরুণদের একটা ইনোভেশন যদি ক্লিক করে তবে আমাদের দেশ হয়তো সেটাতেই সুনাম অর্জন করতে পারে।

আমরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইনোভেশন কালচার ছড়িয়ে দিতে পরিকল্পনা নিয়েছি। আমাদের সঙ্গে এখন যে তরুণরা কাজ করছে তারাই পরবর্তী সময়ে মেন্টর হচ্ছে। এই মেন্টররা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে তরুণদের উদ্ভাবনী আইডিয়া জাগ্রত করতে কাজ করবে।

ঢাকাটাইমসকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আপনাকে ও ঢাকাটাইমসকে বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরামের পক্ষ থেকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

(ঢাকাটাইমস/৭জুলাই/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :