সিনেমাপাড়ায় নাটক!

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০৮ জুলাই ২০১৭, ০৮:৩৬

এক.

দুজন অন্ধ লোক সিনেমা হলে গিয়েছেন। অন্ধকার ঘর। সিনেমা শুরু হয়েছে। কিন্তু দুজনে কেউ কিছু দেখতে পারছেন না।

প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে বললেন, কিছু দেখতে পাচ্ছিস?

দ্বিতীয়জন জবাব দিল, কিছুই না।

প্রথমজন আবার বলল, তাহলে?

দ্বিতীয়জন বলল, চল সামনে গিয়ে বসি।

দুই.

দুটো ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল কোনোভাবে হলিউড এলাকায় ঢুকে পড়েছে। তারা হলিউডের ঝাউজঙ্গলের ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা-ওটা খাচ্ছে। কিছু এক্সপোজ্ড ফিল্ম পাওয়া গেল। ছাগলে স্বভাব যা পায় তা-ই খায়। ছাগল দুটো ফিল্মগুলো চাবাতে শুরু করল। খাওয়া যখন মোটামুটি শেষ হলো, তখন প্রথম ছাগল দ্বিতীয় ছাগলকে প্রশ্ন করল, কেমন লাগলো বন্ধু?

দ্বিতীয়টা উত্তর দিল, খারাপ না। তবে মূল উপন্যাসটা বেশি ভালো লাগছিল।

প্রথম কৌতুকটি দর্শকের। আর দ্বিতীয়টি সমালোচকের জন্য। কৌতুকগুলো বিদেশি। ভাষান্তর হয়েছে বাংলায়। যে কারণে চরিত্রগুলোকেও চেনা মনে হতে পারে, আদতে তা নয়। বিদেশি কৌতুকে দেশি চরিত্র খুঁজতে গিয়ে কেউ আপনা থেকে কষ্ট পেলে কিছুই করার নেই।

ঢাকার আবহাওয়া আনপ্রেডিকটেবল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকালে আকাশে ঘন মেঘ দেখে ভাবলেন সারাদিন বৃষ্টি হবে। সেই মতো ছাতা, বৃষ্টির আলখেল্লা নিয়ে বের হয়েছেন, শেষে দেখা গেল ভ্যাপসা গরম। ঘেমেনেয়ে একাকার। চাঁদিফাটা গরমে দিনভর ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়েছেন। বিছানার পাশের জানালাটা পুরোপুরি খোলা রাখলেন ঠা-া বাতাস আসবে বলে। স্বপ্ন দেখছেন একটা মুখর দিন। ঝুম বৃষ্টি। অফিস ছুটি। কোথাও যাবার নেই। সারাদিন আয়েশ করে ঘুমাচ্ছেন। আহা কী স্বপ্ন! অনন্তকাল যদি এমন স্বপ্ন দেখা যেত। স্বপ্নের মধ্যেই অনুভব করছেন বৃষ্টির হালকা ঝাঁপটা এসে আপনাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। আস্তে আস্তে শরীর শীতল হয়ে আসছে। আপনি ভিজে যাচ্ছেন। মাঝরাতে উঠে দেখলেন, স্বপ্নে নয় বাস্তবেই বিছানায় শুয়ে কাক ভেজা হয়ে আছেন। বাইরে অঝরে বৃষ্টি। জানালা গলিয়ে সব ভিজিয়ে দিয়েছে।

ঢাকার আবহাওয়া নিয়ে আগবাড়িয়ে কিছু বলা না গেলেও এটা বলা যায়, সিনেমাপাড়া এখন বেশ গরম। ওখানে বৃষ্টির কোনো নাম-নিশানা নেই। সিনেমাপাড়ার এই ভ্যাপসা গরম পরিস্থিতিকে কেউ কেউ তুলনা করছেন নাটকের সঙ্গে। টেবিল থাপড়ে বলছেন, ‘সব নাটক, বুঝলেন ভাই, সবই নাটক।’ আগেপাছে কিছু না জানা আপনার শুনে মনে হতে পারে, সিনেমাপাড়ায় বোধহয় নাটক হচ্ছে। সিনেমাপাড়ায় তো নাটক নতুন কিছু নয়। বড় পর্দার অনেক অভিনয় শিল্পীই দীর্ঘদিন ধরে ছোটপর্দায় কাজ করছেন। কেউ করছেন বড়পর্দায় কদর কমে যাওয়ায়। কেউ ব্যস্ত থাকতে যুক্ত থাকছেন টিভি নাটকে। দুটোই আছে। আবার সিনেমার কলাকুশলী দিয়ে নাটকে অভিনয় করালে দর্শক ভালো পাওয়া যায়Ñ কৌশল তো আছে।

গত কয়েক যুগ ধরে ঢাকাই সিনেমাকে অনেক মেরুকরণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। বৈচিত্র্য এসেছে নির্মাণে, কাহিনিতে। নতুন হিরো-হিরোইন এসেছেন। অল্প সময়ে অনেকে বিপুল দর্শকের কাছে পৌঁছে গেছেন। এদের সবাই যে টিকে আছেন তা নয়, তবে হারিয়ে যাওয়ার সংখ্যাও বেশি নয়। এক যুগ আগেও বাংলা সিনেমা নিয়ে যারা ‘সবশেষ’ মন্তব্য করেছিলেন তাদের অনেকেরই ভাত-কাপড় হচ্ছে এই সিনেমার কল্যাণে। আমাদের পিছিয়ে থাকার কিছুটা কারণ যখন খুঁজে বের করা সম্ভব হয়েছে, তখন আশার আলো দেখা দিয়েছে। বিএফডিসি-নির্ভর চলচ্চিত্রের দিন শেষ এ কথা বলতে বোদ্ধা হতে হয় না। হলিউড, বলিউড যখন ঘোড়দৌড়ে তখন আমরা আদিম কচ্ছপের মতো মাটি কামড়ে ছিলাম। এই সুযোগে প্রতিবেশীরাও অনেকদূর এগিয়ে গেছে। খুব বেশি দূরের লোকের কথা বলছি না। যারা আমাদের মতো বাংলায় কথা বলে, টালিগঞ্জের কথা বলছি।

যত গুড় তত মিষ্টি। কথাটি তো একেবারে অমূলক নয়। বিনিয়োগের ওপর অনেক কিছু ভর করে থাকে। আপনি হেভি বাজেটে ছবি বানাবেন সেই ছবি মাঠে মারা যাবে, এটা কোনোভাবেই হতে পারে না। বিগ বাজেটে কাজ করলে আয়টাও ভালো হবে এটাই স্বাভাবিক। এদেশের নির্মাতা-প্রযোজকরা একটা সময় তেলকম মচমচা ভাজা চাইতেন। পরিচালকদের অগত্যা তাই মানতে হতো। তারা তো আর জমি বেচে নির্মাতা হতে আসেননি (অনেকে অবশ্য ঝুঁকি নিয়েছেন। সফলও হয়েছেন)। প্রযোজকের চাহিদা আর জোগানকে এক রেখায় আনতে গিয়ে পরিচালক যা প্রসব করেছেন তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধোপে টেকেনি। ছিটকে পড়েছে। ওদিকে দোষ হয়েছে কাহিনিকার আর পরিচালকের। গ্লোবাল ভিলেজ যখন সবকিছু নখের ডগায় এনে দিয়েছে, দর্শকের স্বাদ যখন মোগলাই থেকে থাই-চাইনিজের পাতে গিয়ে ঠেকেছে তখন চাইলেই অখাদ্য-কুখাদ্য দর্শকের পাতে তুলে দেয়া যায়! তরুণ নির্মাতা-প্রযোজকরা তা বুঝতে পেরেছিলেন। জেনেশুনে লোকসানের খাতে বিনিয়োগ করেছেন। তবে তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন এই বিনিয়োগ লোকসানের খাতায় নাম লেখাবে না। হয়েছেও তাই।

ততদিনে মুখ থুবড়ে পড়া সিনেমা হলগুলো পুনরুদ্ধারের চেষ্টা হয়েছে। ভেঙেচুরে নতুন করা হয়েছে। একবিংশ শতকের দর্শক যেমনটা চায় পুরোপুরি তা না হলেও কাছাকাছি কিছু দেয়ার চেষ্টা করেছেন। গর্তজীবী মানুষকেও হলে টেনেছেন। ভালো নির্মাণই নয়, ভালো উপস্থাপনা, পরিবেশ আর সেবা দিয়ে। বাণিজ্যিক ছবির দিন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা যারা করেছেন তারা যে একাই ভালো আছেন তা নয়, অভিনয় যাদের জীবিকা এমন অনেককেই টেনে তুলেছেন খাদ থেকে। কখনো কল্পনা করা না গেলেও আমাদের ছবি এখন আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হচ্ছে। বাংলা চলচ্চিত্র, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সুযোগ পেলেই পৌঁছে যাচ্ছে নাম না জানা অনেক জাতিগোষ্ঠীর কাছে। এটা কি আমাদের অর্জন নয়?

সিনেমার এসব গল্প সবাই কমবেশি জানেন। ফেরা যাক সিনেমাপাড়ায়। যেখানে চলছে তর্ক-বিতর্ক। বিষয়Ñযৌথ প্রযোজনা। টালিগঞ্জের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় বেশকিছু ছবি বানিয়েছে এদেশের নির্মাতা। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ‘নবাব’ ও ‘বস টু’ ছবি দুটো। দুটো ছবিই দেশের প্রায় সবকটি প্রেক্ষাগৃহে চলেছে। দর্শকের ভিড় ছিল। ব্যবসা সফল বলা যায় ছবি দুটোকে। এই দুটো ছবিই যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত। যেখানে ঢাকা ও কলকাতার অভিনেতা, কলা-কুশলীরা অভিনয় করেছেন। গত বছরের ঈদুল ফিতরে মুক্তি পেয়েছিল ‘শিকার’ ও ‘বাদশা’। ওই ছবি দুটোও ভালোই ব্যবসা করেছে। এখন চলচ্চিত্রপাড়ার একটি অংশ অভিযোগ করছেন, যৌথ প্রযোজনার নামে যৌথ প্রতারণা চলছে। এই প্রতারণা নীতিমালার জেরে। বর্তমান নীতিমালায় বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এদেশের সিনেমা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এদেশের নির্মাতা-শিল্পী-কলাকুশলীরা অবহেলিত হচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে বলে দাবি করেছেন বিরোধীরা।

যৌথ প্রযোজনার পক্ষের গোষ্ঠী বলছে, ‘সিনেমা হল বাঁচলে চলচ্চিত্র বাঁচবে’। দর্শকরা হলমুখী হলে সিনেমা হল বাঁচবে। দর্শকদের হলে টানতে হলে ভালো ছবি বানাতে হবে। প্রতিবেশী দেশে কদিন পর পরই বিগ বাজেটের ছবি মুক্তি পাচ্ছে। এসব ছবি ভারতের গ-ি ছাড়িয়ে এশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ব্যবসা করছে। ইউরোপেও যাচ্ছে এসব ছবি। সম্প্রতি ভারতে মুক্তি পাওয়া ‘বাহুবলি’ মুভি দেখার জন্য বাংলাদেশ থেকে তরুণরা সেদেশে ছুটে গেছেন। পত্র-পত্রিকায় এসব খবরও এসেছে। বাংলাদেশে কম নির্মাতা, প্রযোজকই আছেন যারা সত্যিকার অর্থেই বিগ বাজেটের ছবি বানাতে সক্ষম। সেক্ষেত্রে শিল্পী-কলাকুশলী বিনিময়ের পাশাপাশি যৌথ প্রযোজনায় টালিগঞ্জের সঙ্গে ছবি বানানো মন্দের কী আছে? দু দেশ একসঙ্গে কাজ করলে সেখানে বিনিয়োগ বাড়বে। ভালো ছবি নির্মাণ হবে। তাছাড়া আমাদের প্রযুক্তিগত ও নির্মাণ কৌশলে যে অদক্ষতা বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে সেটাও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

পক্ষে-বিপক্ষে দু-পক্ষই কিন্তু ঘুরেফিরে দেশের চলচ্চিত্রের মঙ্গলের কথা বলছেন। তবে দুদলের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। এদেশের রাজনীতিতেও দুটো শক্ত পক্ষ রয়েছে। দুই পক্ষই দেশের কথা বলে। এক পক্ষ দেশের মধ্যে কোনো সম্ভাবনাই দেখেন না। দীর্ঘ নিঃশ^াস ছেড়ে মন্তব্য করেন, ‘দ্যাশ শেষ। এই দেশের ভবিষ্যৎ নেই।’ জবাবে বিপরীত মন্তব্যও আছে। তীক্ষèগলায় জবাব আসে, ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আগামীতেও এগিয়ে যাবে। যারা দেশের ভালো চান না তারা দেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে।’ পক্ষ-বিপক্ষের ধারা চিরদিনই ছিল। ভবিষ্যতেও থাকবে। সবাই একই দাবিতে কথা বলবে। এই বিষয়ে দু-পক্ষ দুভাবে অবস্থান নিলেও সবারই লক্ষ্যবস্তু একটাই। চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন তারাও স্বপ্ন দেখেন এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্প আকাশ ছোঁবে। যারা সম্ভাবনার কথা বলেন, তারাও স্বপ্ন দেখেন বিশ^ চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার দিন শেষ। এখন সময় এগিয়ে যাওয়ার। এদেশের চলচ্চিত্রও যাবে অস্কারে। প্রশংসিত হবে কান উৎসবে।

দুই পক্ষের লক্ষ্যই যখন দেশের চলচ্চিত্রের মঙ্গল তখন কারো কথাই ফেলে দেয়া ঠিক হবে না। বালখিল্যতার অভিযোগে নাকচ করে দেয়া যাবে না কোনো পক্ষকেই। যারা যৌথ প্রযোজনার বিরোধিতা করছেন তাদের দাবি কতটুকু যৌক্তিক তা খতিয়ে দেখতে হবে। যৌথ প্রযোজনার নামে আমরা যদি সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকি তাহলে কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে উঠে আসা যায় সেই পথ বের করতে হবে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। মাথা ব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার মতো যৌথ প্রযোজনা একেবারে বন্ধ করে দেয়া কখনোই ঠিক হবে না। সমস্যা সমাধানের পথ বের করলেই তো হয়। প্রযুক্তি, কলাকৌশলের আদান-প্রদান তো নতুন কিছু নয়। বিশ^জুড়ে এটা হচ্ছে বাংলাদেশ করলে দোষ কোথায়? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো ভুল বলেননি,

‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে

যাবে না ফিরে,

এই ভারতের মহামানবের

সাগর তীরে।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :