ঢাকাইয়াদের যাত্রাপালা: বর্ণিল জীবনের উপাখ্যান

মাহবুব রেজা
 | প্রকাশিত : ০৯ জুলাই ২০১৭, ১১:১৭

কেমন ছিল শত শত বছরের পুরনো আদি ঢাকাইয়াদের সংস্কৃতি? যাত্রাপালা? গান-বাজনা?

এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহল রয়েই গেছে। এ নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্কও আছে। কখনো সখনো মতান্তরও কম নয়। নানা পটপরিবর্তনের ভেতর দিয়ে ঢাকাইয়া সংস্কৃতি তার নিজস্ব রীতিতে প্রবহমান। ধাবমান। তবে দেশভাগের পর জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত মানুষজনের সমন্বয়ে ঢাকায় এক নতুন শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে। এই শ্রেণির বিকাশ সামাজিকভাবে নানা পরিবর্তনের বিকাশ যেমন ঘটিয়েছে তেমনি নানারকম রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ঢাকার শত বছরের প্রাচীন সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্য এসেছে। পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। দেশ বিভাগ-উত্তর সময়ে ঢাকায় তৈরি হয়েছিল বিচিত্র এক মিশ্র সংস্কৃতির। সেই মিশ্র সংস্কৃতির প্রাবল্যে ঢাকার প্রাচীন সংস্কৃতি আলাদা স্বাতন্ত্র্যে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। ঢাকাবাসী বংশ পরম্পরায় তাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস আর ঐতিহ্য নিয়ে গর্ববোধ করেন।

তবে সেসময়ে এক শ্রেণির অর্বাচীন যারা বিদ্যা শিক্ষায় নিজেদের কেউকেটা হিসেবে জাহির করে ঢাকাবাসীর গৌরবান্বিত ঐতিহ্যকে পাশ কাটিয়ে একে অস্বীকার করার পাঁয়তারায় নেমেছিল। কিন্তু তাতে তারা সফল হতে পারেননি। তখন নব্য ঢাকাবাসীর কেউ কেউ আদি ঢাকাইয়াদের ঐতিহ্যময় এই প্রবহমান সংস্কৃতি ও এর চর্চাকে খাটো করে দেখার অপচেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তা টেকেনি। টেকেনি এ কারণে যে, সেসব অর্বাচীন শিক্ষিতরা তাদের বক্তব্যকে মজবুত করার ক্ষেত্রে কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি দেখাতে পারেননি। ঢাকাইয়ারা যুক্তি আর ব্যাখ্যা দিয়ে বেশ ভালো করেই তাদের বুঝিয়ে দিয়েছে কথার পিঠে কথা বলা আর যুক্তিতর্কের নিরিখে বিশ্লেষণ ভিন্ন কথা।

ঢাকা নিয়ে অসামান্য দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ ‘তাওয়ারিখে ঢাকা’ লিখে মুনশী রহমান আলী তায়েশ নিজের জায়গা করে নিয়েছেন বেশ আগেই। তিনি তার বইয়ে আদি ঢাকাইয়াদের কথা লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘প্রায় ১০০ বছর ঢাকা ছিল বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা এই তিন প্রদেশের রাজধানী। এ সময় যত সুবেদার দিল্লি থেকে এখানে এসেছেন, সবাই সব শ্রেণির লোকজন নিজেদের সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। বিদ্বান, কেরানি, যোদ্ধা, কারিগর, শিল্পী, ব্যবসায়ী, দর্জি, স্বর্ণকার, শালকর, আমুদে, রুটি প্রস্তুতকারক, ময়রা সবাই দিল্লি থেকে এসেছেন। এ শহর বিস্তৃতি, জনবসতি, জ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যা তখন দিল্লির অনুরূপ ছিল। বইটি ১৯১০ সালে তিনি লিখেছিলেন।

তৎকালীন ঢাকায় বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এসে বসতি গড়ে তুলেছিলেন। প্রধানত দিল্লি অঞ্চল থেকে আগত ভারতীয়দের ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি ঢাকাইয়াদের অনুরূপ ছিল। ঢাকাইয়াদের এই সংস্কৃতির সঙ্গে খুব সুন্দরভাবে সংমিশ্রণ ঘটে এ দেশে আগত অভারতীয় বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর শিক্ষা ও সংস্কৃতির। ফলে ঢাকাইয়াদের শিক্ষা, সংস্কৃতিতে নানামুখী প্রভাব এসে পড়ে। মুঘলপূর্ব যুগে আদি ঢাকাইয়ারা পুঁথি ও কিচ্ছা পাঠ, মুর্শিদী গান, বিয়ের গান, কীর্তন, বন্দনা সংগীত, শোক ও বিচ্ছেদের গান, ধর্মীয় সামাজিক উৎসবে পালাগান ও জারিগান প্রভৃতির মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতিচর্চা চালিয়ে যেত। এসবের মধ্য দিয়ে ঢাকাইয়া সংস্কৃতির সঙ্গে চিরায়ত বাংলার সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটত। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাইয়া সংস্কৃতিতে নগর সভ্যতার ধাক্কা এসে লাগল। আর এর ফলে যাত্রাপালা বাঈজি ও হিজড়াদের নৃত্যগীত, ছন্দ, পিটাজি গান আর থিয়েটার যুক্ত হলো।

স্বাধীনতা সংগ্রামী ও কমিউনিস্ট নেতা বঙ্গেশ্বর রায় বিশ শতকের শুরুতে ঢাকাইয়াদের যাত্রাপালার চমকপ্রদ বর্ণনা দিয়েছেন তার ‘ঢাকা আমার ঢাকা’ বইয়ে। সে সময় ঢাকায় দুটো যাত্রাদলের নামডাক বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল। এর একটি হলো নবাবপুর যাত্রাদল ও অন্যটি হলো শাঁখারীবাজার অপেরা পার্টি। এর বাইরেও আরও বেশ কয়েকটি যাত্রাদল ছিল। তবে এই দুই যাত্রাদল একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। নবাবপুর যাত্রাদল ও শাঁখারীবাজার অপেরা পার্টির যাত্রায় অভিনেতা-অভিনেত্রী দুই ভূমিকায়ই অভিনয় করত পুরুষরা। নিয়ম অনুযায়ী যাত্রা শুরু হওয়ার আগে সখীদের নাচ ও গান পরিবেশিত হয়। এসব গান বেশিরভাগই প্রেম-ভালোবাসাকে উপজীব্য করে লেখা। বঙ্গেশ্বর রায় তার বইয়ে যাত্রাপালার সখীদের পরিবেশিত গানের কয়েকটি চরণ তুলে ধরেছেন ‘যাও হে চলিয়া প্রাণভোমরা বাসি ফুলে মধু মিলবে না।’ আরও একটি গানে দেখা যায় নায়িকা নায়কের উদ্দেশ্যে বিরহকাতর কণ্ঠে গাইছেন ‘আমার ভরা কলসি বধূ

খালি করো না, খালি করো না

আহা খালি করো না।

ওপারে তুফান চলে

শাঁ শাঁ শাঁ এপারে বধূয়া চলে

ঢেউ দিও না, ঢেউ দিও না

আহা ঢেউ দিও না।’

অন্য এক গানে দেখি,

‘যারে যারে মন সপিলে কি হয়

যো তোমকো চাহে তোম উস্কো চাহো।’

তখনকার দিনে যাত্রাপালা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ঢাকাইয়াদের মধ্যে। ঢাকাইয়াদের জীবনে এসব যাত্রাপালার ভূমিকা ছিল টনিকের মতো। যাত্রাপালার মধ্যে আনন্দ- বেদনা, দুঃখ-কষ্ট প্রকাশ পেত। যাত্রাপালার সংলাপগুলো শুদ্ধ বাংলায় রচিত হলেও ঢাকাইয়া পাত্র-পাত্রীরা নিজেদের সুবিধার্থে শুদ্ধ বাংলায় রচিত সংলাপকে আঞ্চলিক ভাষায় পরিবর্তিত করে দিত। এর ফলে দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে যাত্রাপালার আবেদন আরও বেড়ে যেত। বিষয়টা একটু পরিষ্কার করে উপস্থাপন করলে এর অন্তর্নিহিত মজাটা উপলব্ধি করা যাবে। যেমন একটি যাত্রাপালায় নায়কের নাম সূর্য সিংহ আর নায়িকার নাম সংযুক্তা। যাত্রাপালার মূল পাণ্ডুলিপিতে সংলাপ ছিল

‘সংযুক্তা

সূর্য সিংহ! সূর্য সিংহ!

কি হেতু প্রেরিয়াছ

সাক্ষাতের গোপন বারতা?

নহে এসবে মোরা বালক-বালিকা,

নহে শোভে নির্জন নিভৃতে

এহেন গোপন আলাপন?’

মূল পাণ্ডুলিপিতে শুদ্ধ বাংলায় ওই রকম সংলাপ থাকলেও তখনকার ঢাকাইয়া যাত্রাপালার পাত্র-পাত্রীরা তাদের সুবিধামতো সংলাপগুলোকে আঞ্চলিক ভাষায় রূপান্তরিত করে নিত। আর সংলাপের এই রূপান্তরের ফলে যাত্রাপালা দেখতে আসা স্থানীয় মানুষ নির্মল আনন্দ লাভ করত। শুদ্ধ বাংলায় রচিত সংলাপগুলোকে নিজেদের সুবিধার জন্য ঢাকাইয়া ভাষায় পরিবর্তিত করা হতো।

পরিবর্তিত সংলাপগুলো কেমন রূপ ধারণ করত?

উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে।

‘সংযুক্তা

সূর্য সিংহ! সূর্য সিংহ!

ক্যালাইগা বোলাইছস?

আমরা তো আর

ছ্যাড়া ছ্যাড়ি নাই

মাঠে ময়দানে ঘোপে ঘাপে

বাৎচিত করুম?’

চল্লিশ-পঞ্চাশ এমনকি ষাট-সত্তরের দশকের পুরান ঢাকার মানুষজনের মুখে মুখে ফিরত ঢাকার বিভিন্ন মঞ্চে অভিনীত যাত্রাপালার এ ধরনের প্রাঞ্জল গান আর জনপ্রিয় সংলাপ। এসব গান আর সংলাপের ভেতর দিয়ে ঢাকার মানুষ নিজেদের না বলা কথাবার্তাকে প্রকাশ করতেন।

মাহবুব রেজা: কথাসাহিত্যিক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিনোদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :