গাজীপুরে গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎকেন্দ্রে ‘হরিলুট’

শাহান সাহাবুদ্দিন, গাজীপুর থেকে
 | প্রকাশিত : ১০ জুলাই ২০১৭, ০৮:৩০

গাজীপুরের টঙ্গী বিসিক এলাকায় ২২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮০ মেগাওয়াট গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এখন লুটেরাদের দখলে। অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনাই এখানে কাজের নিয়ামক। হরিলুট চললেও দেখার নেই কেউ।

২০০৩ সালের ১০ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে ২০০৫ সালে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উদ্বোধন করা হয়। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অধীন এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে গত একযুগ ধরে চলমান নানা জটিলতা ও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম।

তবে গত একযুগেও এ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহ করতে সক্ষম হয়নি। ভবিষ্যতেও এ সক্ষমতা অর্জিত হবে কি না- খোদ এমন শঙ্কা দেখা দিয়েছে টঙ্গী বিসিক এলাকার বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মাঝে। অথচ টঙ্গী বিসিক এলাকার হাজারো কল কারখানায় বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আবাসিক এলাকার বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে এ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করছে।

তবে পাঁচ একর জমির ওপর নির্মিত এ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে বর্তমানে শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি লাভের মুখ দেখার কথা সেখানে বাস্তবতা হচ্ছে ‘বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটির বহু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও এর পাশেই এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যন্ত্রপাতি পাহারা দিয়েই অলস সময় পার করছে।’

এসব বিষয়ে টঙ্গী ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক আতিউর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মী আশরাফের মাধ্যমে জানান, তিনি ব্যস্ত আছেন, পরবর্তী সময়ে দেখা করতে হবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বহুবার চেষ্টার পরও তিনি কথা বলতে রাজি হননি।

শুধু তিনি একাই নন। ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোনো কর্মকর্তাই কথা বলতে রাজি হননি। এমনকি এ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কোনো কর্মকর্তার টেলিফোন এবং মোবাইল নম্বর দিতেও কেউ রাজি হয়নি।

সরেজমিনে জানা গেছে, এ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের মেশিন টাইপ গ্যাস টারবাইন। ইউনিট সংখ্যা একটি। ইউনিটের ক্ষমতা ১০৫ মেগাওয়াট, উৎপাদন বেস ১০৫ মেগাওয়াট, ইউনিট খরচ টাকা ২.০২কি.ও.ঘ (৩০% প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর), জ্বালানি-প্রাকৃতিক গ্যাস, মোট চুক্তি মূল্য ২২৬ কোটি পাঁচ লাখ ৭৯ হাজার ৩৩৮ টাকা, স্থানীয় মুদ্রা নয় কোটি ৩৮ লাখ ৩৬ হাজার ৯১৮ টাকা, বৈদেশিক মুদ্রা ২১৬ কোটি ৯৭ লাখ ৪২ হাজার ৪২০ টাকা। টার্ণকী ঠিকাদার- মেসার্স হারবিন পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কোং লিমিটেড চায়না। স্থানীয় উপদেষ্টা- মেসার্স ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কন্সালটেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করার জন্য কেন্দ্রটির পূর্ব পাশে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিসন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সিস্টেম অপারেশন বিভাগ (উত্তর) এর বিভাগীয় কার্যালয়, টঙ্গী ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর এম এস স্থাপন করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের বেশ কয়েকজন ক্ষুব্ধ শ্রমিক জানিয়েছে, গত তিন বছর ধরে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন না হলেও ওভারটাইমের নামে লাখ লাখ টাকা বিল করা হচ্ছে। সরকারি দলের নাম বিক্রি করে কিছু অসাধু হাইব্রিড শ্রমিক নেতারা কর্মস্থলে নিয়মিত অনুপস্থিত থেকেও বেতন-বোনাস ও ওভারটাইমের টাকা পাচ্ছে। তাদের দেখা দেখি অনেক শ্রমিক ফাঁকিবাজি শুরু করেছে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে চাহিদা না থাকার পরও অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অথচ নিরাপত্তাকর্মী সংকট রয়েছে। কোনো মেশিন বিকল হলে তা মেরামতের আগেই দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীর নামে টাকা আত্মসাতের ধুম পড়ে। মেশিন চলে না অথচ শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের নামেও টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। পুরাতন যন্ত্রপাতি নতুন করে রঙ করে টাকা আত্মসাতেরও ঘটনা ঘটেছে। শুধু তাই নয়। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিকদের জন্য একটি মেডিকেল শাখা করা হলেও সেখানে চিকিৎসার নামে চলে অপচিকিৎসা।

মেডিকেল শাখায় মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্বে আছেন ডা. সেলিনা আক্তার। এই চিকিৎসকের কাছে কোনো অসুস্থ শ্রমিক গেলেই তাকে আশপাশের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে। মেডিকেল অফিসার অধিকাংশ সময় কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিকদের কপালে একটা প্যারাসিটামলও জোটে না। অথচ গত প্রায় এক বছর আগে এই মেডিকেল অফিসার দুই ব্যাগ ঔষধ চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি মীমাংসা করে ফেলেন।

বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা অভিযোগ করে আরও বলেন, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিসন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সিস্টেম অপারেশন বিভাগ (উত্তর) এর বিভাগীয় কার্যালয় থেকে শুধু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করার কথা থাকলেও তারা গোপনে বিসিক এলাকায় দুটি বড় ধরনের কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের সামনের সড়কের মাটির নিচ দিয়ে মোটা পাইপে দিনরাত অবাধে গ্যাস পাচার করা হচ্ছে। ওই কারখানাগুলো বন্ধ থাকলে চাহিদা মতো গ্যাস পাওয়া যায়।

এ বিয়য়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিসন অ্যান্ড ডিষ্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সিস্টেম অপারেশন বিভাগের ব্যবস্থাপক ছিদ্দিকুর রহমানের মোবাইল ফোনে গত বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরবর্তী সময়ে এই কর্মকর্তার মোবাইল ফোনে সাংবাদিক পরিচয়ে এসএমএস করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল ঢাকাটাইমসকে বলেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি রাষ্ট্রের সম্পদ। এখানে তার কিছু করার নেই, বলার ও নেই। তিনি ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সদস্য ও নন। এটি দেখার জন্য বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ আছে। এটি তারাই দেখবে।

তবে ওই দপ্তরের সাব-অ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. নাছির উদ্দিন গ্যাস সরবরাহ হিসাবের খাতা দেখিয়ে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘গত ছয় মাসে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়েক বার গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ২ জুন দুপুর ১টা ২০ মিনিট থেকে বিকাল ৫টা ২৬ মিনিট পর্যন্ত এবং রাত ১১টা ৩৯মিনিট থেকে ১টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছিল। ওইদিন সকাল ৮টায় গ্যাসের প্রেসার ছিল ১২০পিএসআই এবং দুপুর ১২টায় ৭০। এর আগে গত ৩১ মার্চ বিকাল ৪টা ১৬ মিনিট থেকে ৪টা ২৭ মিনিট এবং রাত ১টা ৩৫ মিনিট থেকে ভোররাত ৪টা ২৪ পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ২৬ মার্চ দুপুর ১২টা ২৪ মিনিট থেকে ১২টা ৩৬ মিনিট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছিল। ওইদিন গ্যাসের প্রেসার ছিল ৬০-১১৫ পিএসআই। কিন্তু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মাত্র কয়েক মিনিট গ্যাস সরবরাহ করার পরে তা বাধ্য হয়েই বন্ধ করতে হয়।’ সাধারণত গ্যাসের প্রেসার ৬০-৭০ পিএসআই হলেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব বলেও তিনি জানান।

(ঢাকাটাইমস/১০জুলাই/প্রতিনিধি/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :