কাতারি বালিকা ২৫০ ডলারের রিসিপ্ট ধরিয়ে দিলো

মনিরুল ইসলাম
 | প্রকাশিত : ১২ জুলাই ২০১৭, ০৯:৫৬

এয়ারপোর্টের অলিগলিকে বরাবরই আমার ভয়। বিদেশ বিভূঁই হলে তো কথাই নাই। দুঃখের বোঝার উপর শাঁকের আঁটি যোগ হয় যদি সাথে কেউ না থাকে। গত এপ্রিল মাসে ইরান যাওয়ার অফার পাই। যাত্রাকাল জুলাই। টেরোরিজম-কাউন্টার টেরোরিজম বিষয়ে সেমিনার। মাত্র দু'দিন-১০-১১ জুলাই। ইরান কিছুটা 'অফ দ্যা ট্র্যাক' কান্ট্রি। সচরাচর বাঙালি ইরান যায় না। সুযোগ কম আবার খুব একটা দরকারও পড়ে না। ঘোরাঘুরির জন্য ইরান-সে এক অসম্ভব ব্যাপার। প্রিয় বিষয়ের ওপর সেমিনার তাও আবার ইরান। রাজি হয়ে গেলাম।

তারপর মে চলে গেল। জুন থেকেই যাওয়ার আগ্রহ হারাতে থাকলাম। ততক্ষণে ফেরার পথ নাই। জিও, Ticket-সবই প্রস্তুত। সফরসঙ্গী এক জুনিয়র কলিগ। প্রচণ্ড অনিচ্ছা নিয়েই গভীর রাতে রওয়ানা। দোহা পৌঁছতেই রাত শেষ। দোহার হামাদ এয়ারপোর্ট আমার অচেনা নয়। বেশ কয়েকবার ট্রানজিট করেছি। সঙ্গীসাথীসহ আবার একাও। এয়ারপোর্টের বাইরে ভোরের নরম আলো। দোহা-দুবাই অনেকবার পার হয়েছি তবে এয়ারপোর্টের বাইরের জগৎ অজানা। আকাশ থেকে মরুভূমি বোঝা যায়। এয়ারপোর্টের কাচের মধ্য দিয়েই দোহা দুবাই দেখেছি। দোহা থেকে তেহরান। দু'ঘণ্টার ফ্লাইট। ছেলেবেলায় পারস্যের কত গল্প পড়েছি। মায়ের মুখে সোহরাব রুস্তমের গল্প কতবার শুনেছি। অনুপ জালোটার কণ্ঠে নজরুলের সেই বিখ্যাত গানের কলি-'সিরাজের নওরোজে, ফাল্গুন মাসে...... শুনে শুনে ইরানের একটা ছবি দেখি।

দেড় ঘণ্টার ট্রানজিট। কোথাও থামা হয়নি। দরকার ও ছিল না। মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম ভ্রমণ। কিছুটা উত্তেজনা তো আছেই। সোজা বোর্ডিং গেটে চলে গেলাম। এক বঙ্গসন্তান চিনে ফেললেন। এয়ারপোর্টের কর্মচারী। খাতির করে ইকোনমির ভিড় এড়িয়ে বিজনেস ক্লাসের গেইট। বঙ্গসন্তান কাতারি বালিকার কানে কানে কিছু বললেন। আগ্রহ নিয়ে দু'জনের পাসপোর্ট নিলেন। সঙ্গীকে পার করে দিলেন। আমার বেলায় দেরি হলো। ফ্লাইট ওভারবুকড। আমাকে নেবে না। অনেকদিন আগেই Ticket কেনা। কনফার্মড। যতই বলি কাতারি বালিকা নো নো করে। মহা বিপত্তি। সফরসঙ্গী ভেতরে ঢুকে গেছে। কাতারি বালিকা ২৫০ ডলার ক্ষতিপূরণের লোভ দেখায়। আমি উল্টো তাকে আমার Ticket আপগ্রেড করতে বলি। কোথাও কোনো সিট খালি নাই।

১০ বছরে অনেক দেশে গিয়েছি। এই অভিজ্ঞতা প্রথম। সকাল ৮টার পরিবর্তে আমাকে সন্ধ্যা ৬.৫০ এ যেতে হবে। কোনো পথ নেই। নিজেকে বড়ই অপাংক্তেয় মনে হলো। আমি অতিরিক্ত হয়ে গেছি। কাউন্টারের বালিকা আমাকে আরেক বালিকার হাতে ধরিয়ে দিল। বালিকা এক তাল থেকে হাঁটিয়ে দোতলায় নিয়ে যায়। তৃতীয় বালিকার কাছে পৌঁছে দেয়। তৃতীয় বালিকা ধীরে সুস্থে লেখালেখি করতে থাকে। একসময় তার লেখা শেষ হয়। স্যুটকেস ফেরত পাওয়া যাবে না। বলল, অন হোল্ড থাকবে, আমার ফ্লাইটে পাঠানো হবে। হোটেলের বিষয়ে চতুর্থ বালিকার কাছে সমর্পন করে। চতুর্থ বালিকা হোটেল রুম কনফার্ম করে অপেক্ষা করতে বলে। একসময় ফর্ম ধরিয়ে দেয়। তার পরামর্শমতে অনিশ্চিত যাত্রা শুরু হয়।

আরও কিছু হতভাগ্যের হাতে একই ফর্ম। তাদের পেছনে হাঁটতে থাকি। লাইনে দাঁড়াই। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা কাগজপত্র পরীক্ষা করে। বড়ই তাচ্ছিল্যের আচরণ স্পষ্ট। ছবিটবি তুলে। তারপর পাসপোর্টে সিল মারে। অন্যদের দেখাদেখি হাঁটতে থাকি। বাইরে তপ্ত হাওয়া। একজন সামনের রাস্তা দেখায়। এবার আর বালিকা নয়, বালক। পার্ক করে রাখা মিনিবাস দেখিয়ে দেয়। মিনিবাসের কাছে যেতেই দরজা খুলে যায়। ভেতরে আরও কয়েকজন। ভয়ে ভয়ে বসে পড়ি। মিনিট দশেক পরে বাস চলতে থাকে। প্রখর রোদে দোহা দেখতে থাকি। জড়তা কেটে গেছে। হ্যান্ডব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ছবি তুলতে থাকি। ছিমছাম দালানকোঠা। আরব সাগর, রোদ পড়েছে পানির উপর।

আধঘণ্টা বাস চলে। হোটেলে ঢুকি। চমৎকার লবি। রিসেপশনে কাগজ জমা দিয়ে অপেক্ষা করি। ততক্ষণে সব মেনে নিয়েছি। দোহাতে পরিচিত খুঁজতে থাকি মনে মনে। এক বঙ্গসন্তান এগিয়ে আসে। আমাকে তার পরিচিত মনে হয়। ইঞ্জিনিয়ার। দোহাতেই চাকরি করে। সপরিবারে থাকে। কাজিনকে নিতে এসেছে। আমার মতোই আটকে পড়েছে। মনে আশা জাগে। এই বুঝি আমাকেও অফার করে। খুবই সামান্য চাওয়া। দোহা শহরটা ঘুরে দেখা। রিসেপশন থেকে রুম কী দেওয়া হলো। ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চ ফ্রি। শেষবারের মতো বড় আশা করে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কাছে গেলাম। হতাশ হয়ে বিদায় নিলাম। রুমে ঢুকলাম। রাতজাগার ক্লান্তি। ঘুম দিলাম একটা।

ঘণ্টাখানেক পরে বেরুলাম। প্রখর রোদ। লু হাওয়া। তারপর ও হাঁটলাম। পকেটে কোনো লোকাল কারেন্সি নাই। ভাষাও অজানা। হারিয়ে না যাই তাই হিসেব করে পা ফেলা। বেশিক্ষণ সারভাইভ করা গেল না। গরমে অভ্যস্ত নই। হোটেলে ফিরে সময় নিয়ে শাওয়ার সারলাম। পেটে ক্ষুধা। রেস্টুরেন্টে পেট পুরে খেলাম। রুমে গিয়ে আবার রেস্ট। চারটায় বাস যাবে। আগেই নিচে নামলাম। এবার আরেক বঙ্গ সন্তান। কৌতূহল নিয়ে তাকালেন। আমেরিকায় থাকি কি না জিজ্ঞেস করলেন। আমাকে তাঁর বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে। ভদ্রলোক মেরিল্যান্ডে থাকেন। ঢাকায় থাকি শুনে কথা এগুলো না। সামনাসামনি বসে ভদ্রলোক কয়েকবার চোরাচোখে তাকালেন। কিছুটা ধাঁধার মধ্যে। আমি কিছুই বললাম না। ভদ্রলোক চলে গেলেন। বাসে উঠলাম। ড্রাইভার ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। তারপর সালাম দিল। শাহীন যাত্রাবাড়ির মানুষ। প্রথমবার চারবছর পার করে দ্বিতীয় দফায় কাতারে। হোটেলের ড্রাইভার। এয়ারপোর্ট যেতে যেতে কথা হলো। শাহীন মিয়ার সুখ দুঃখের গল্প। ট্যুর গাইডের মত আমাকে ধারাভাষ্য দিলো। শাহীনের বড় মেয়ে A- পেয়ে এসএসসি পাস করলো। কলেজে ভর্তি হয়েছে। তার কামাইয়ে দেশে ছেলেমেয়ের লেখাপড়া। পরিবারের ভরনপোষণ। তেমন কোনো সঞ্চয় নেই। চার লাখ টাকা দিয়ে একটা জমির বায়না করেছে। মালিক জমি দেয় নাই, টাকাও ফেরত দিচ্ছে না। গোয়েন্দা সংস্থার লোক, অনেক ক্ষমতা। শাহীন মিয়া রীতিমত ভয় পায়।

এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেলাম। ফোন নম্বর দিলাম। দেশে এসে শাহীন মিয়া দেখা করবে। টাকা আদায়ের আশ্বাস দিলাম। বোর্ডিং কার্ড ছিল। সরাসরি ইমিগ্রেশন করে ভেতরে ঢুকলাম। না, এবার আর সমস্যা নেই। কাতারি বালিকা ২৫০ ডলারের মানি রিসিট ধরিয়ে দিল। তেহরানে সিটি অফিস থেকে ক্ষতিপূরণ দেবে। বিমান আকাশে উড়ল। গন্তব্য তেহরান।

সংবাদটি শেয়ার করুন

প্রশাসন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

প্রশাসন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :