ভুক্তভোগীর বয়ানে মালয়েশিয়া বিমানবন্দরে বাংলাদেশি নির্যাতন

হাবিবুর রহমান মিছবাহ
| আপডেট : ১২ জুলাই ২০১৭, ১৬:২০ | প্রকাশিত : ১২ জুলাই ২০১৭, ১১:৩২

গত ২৮ জুন থেকে ৬ জুলাই পর্যন্ত এক সপ্তাহের সফর ছিল মালয়েশিয়ায়। কিছু ইসলামিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ ও ভ্রমণ উদ্দেশ্যই ছিলো এ সফরের। ২৮ জুন সন্ধ্যায় বের হই বাসা থেকে। যখন বিমানবন্দরে পৌঁছি, তখন সময় রাত আটটা। বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করে ইমিগ্রেশনে প্রবেশ করি আনুমানিক সাড়ে আটটার সময়।

ইমিগ্রেশনে অফিসারদের কাজের ধরণে ছিল ধীরগতি। অন্যান্য সময় এমন দেরি হতে দেখিনি। হয়তো কোনো সমস্যা ছিলো। আমার ফ্লাইট রাত ১০টায়। ইউ এস বাংলা কর্তৃপক্ষ বার বার তাগিদ দিচ্ছিল দ্রুত কাজ শেষ করার। তবে বোর্ডিং পাস পেয়ে যাওয়ায় ফ্লাইট মিস করার তেমন টেনশন ছিলো না আমার।

বিমান ছাড়ার ঠিক ১৫ মিনিট আগে ইমিগ্রেশন পার হই। এ সময় মালয়েশিয়ায় থাকা আমার খুব কাছের তিন বন্ধু আহমাদ আবদুল্লাহ, মোহাম্মদ মোস্তফা এবং প্রিন্স মাহমুদ মনির ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ হয় এবং ফ্লাইটে ওঠা নিশ্চিত করি। আমার জানামতে, মনির ভাই ততোক্ষণে কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে রওয়ানা দিয়ে দিয়েছেন, আর আহমাদ আব্দুল্লাহ ভাইও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

কোনো ধরণের অসুবিধা ছাড়াই স্থানীয় সময় ভোর চারটায় কুয়ালালামপুর পৌঁছি। ইমিগ্রেশনে তেমন কোনো ভিড় ছিল না। অন্য দেশের ফ্লাইটের যাত্রীও চোখে পড়ল বেশ। আমার সামনে থাকা চারজন বাঙালি ট্যুরিস্টকে ইমিগ্রেশন পার হতে না দিয়ে, কর্তব্যরত একজন নারী পুলিশ ইমিগ্রেশন অফিসে পাঠিয়ে দিল। তিনি জন্মসূত্রে নিশ্চয়ই মালাই নয়, তা তখনই বুঝতে পেরেছিলাম। পরে জানতে পারি ওখানের ৯০ শতাংশ কর্মকর্তা ইন্ডিয়ার কেরালা ও তামিলনাড়ুর লোক। এরপর একজন বাঙালি ট্যুর ইমিগ্রেশন পার হলো।

এবার আমার পালা। হোটেল বুকিং, পাসপোর্ট ও আপডাউন টিকিট দেখে প্রশ্ন করলো মালয়েশিয়া কেনো এসেছি? বললাম ট্যুর। এক মিনিট কি যেন ভাবলেন তিনি। এরপর আমাকেও ইমিগ্রেশন অফিসে পাঠিয়ে দেয়া হলো। এখনো জানি না কী হতে যাচ্ছে আমার সাথে।

অফিসে ঢুকলাম। বসতে বলল। বসলাম। কিন্তু দায়িত্বরত পুলিশটি আমার দিকে বিরক্তের সাথে বার বার তাকাচ্ছিলেন। তিনিও একই ধরণের প্রশ্ন করলেন, কেনো মালয়েশিয়া এসেছি। বললাম, ট্যুর। এরপরের প্রশ্নটি আদৌ বুঝিনি। বললাম, সরি! প্লিজ এগেইন? কিন্তু উনি আর কিছুই বলললেন না।

আমাকে পাশের অন্য একটি সিটে বসিয়ে রাখলেন। কিছুক্ষণ পর একটি ছেলে এসে বলল, ‘ওস্তাদ চলেন’। আনন্দ লেগেছিলো এই ভেবে যে, ছেলেটি সম্ভবত বাঙালি। ও এখানে চাকরি করে, আর আমি হয়ত ইংরেজি জানি না, তাই বাঙালি পুলিশ কর্তৃক আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করাবে। আমিও মন খুলে সব কথা বলতে পারবো। কিন্তু পরে দেখলাম ছেলেটি বাঙালি নয়, হয়ত বাঙালিদের নিয়ে ওর কাজ, তাই দুই একটি বাংলা বলতে পারে।

একটি রুমে ঢুকানো হলো আমাকে। যেখানে ঢুকতেই কয়েকজন বাঙালি দেখতে পাই যাদেরকে কান ধরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। দেশি ভাইদের এ অবস্থা দেখে মনে কত বড় আঘাত পেয়েছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। কিন্তু তখনো বুঝিনি কার সাথে কী হচ্ছে। আর আমার মনেও তেমন কোনা সংশয় ছিল না। কেননা, আমার পাসপোর্ট ভারী। চারটি দেশের ভিসা লাগানো রয়েছে। আমার কাছে ডলারও আছে। হোটেল বুকিং ও আপডাউন টিকিট থাকায় ওরা আমাকে সন্দেহ করার প্রশ্নই আসে না।

আমাকে চেক করা হলো। পাশেই আরেক বাঙালিকে একজন নারী চেক করছিলেন। তিনি লোকটির প্যান্ট খুলে গোপনাঙ্গ ধরে নাড়াচাড়া করছিলেন এবং তা সবার সামনেই। আর অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীরা হো হো করে হেসে উঠলেন তা দেখে। তখন কিছুটা আতঙ্ক তৈরি হয় আমার মনে। ফেঁসে যাচ্ছি না তো? এ তো দেখছি যথারীতি জাহেলী যুগের প্রত্যাবর্তন। তবে তখনো আমি জানি না যে, আমাকে বন্দী করা হচ্ছে।

চেকিংকালে আমাকে ওভাবে লাঞ্ছিত করা হয়নি। আমার হাতে র‌্যাডো কোম্পানির ঘড়ি ছিল। ওটা দেখে হাসাহাসি করছিলো ওরা এ বলে যে, বাঙালিরা র‌্যাডোও ব্যবহার করে? মনে মনে বলছিলাম, বাঙালিরা তোদের মতো জানোয়ারদের কামলাও রাখে না।

মোবাইল চাইল, পকেট থেকে বের করে দিয়ে দিলাম। আমার মোবাইলটি আইফোন সিক্স এস প্লাস। অফিসারটি আমার দিকে তাকিয়ে শয়তানের মতো হাসছিলেন। হয়ত এবার ভাবছিলো বাঙালিদের আইফোনও থাকে! ওরা জানে না বাঙালিরা কতটা সৌখিন ও ভদ্র। জানলে বাঙালিদের দূর হতেই সালাম করত ওরা।

চেকিং শেষে মোবাইলসহ যাবতীয় জিনিসপত্র রেখে পাশেই আরেকটি রুমে ঢুকান হলো আমাকে। সেখানে অনেক বাঙালি বসেছিলেন। বেশ কজন আমাকে চিনেও ফেলে। খুব আফসোস করে একে অপরকে বলছিল, ‘দেখ হুজুরের মতো লোকটাকে এখানে আনল ওরা। ওরা কি মানুষ?’।

আমি তখনো বুঝিনি কী হচ্ছে এসব। আমি তখনো এটিই ভেবেছিলাম যে, এখানে কোনো কাজ আছে হয়ত। এখানকার আনুষ্ঠানিকতা সেরে তবেই আমাকে বের হতে দেবে।

সেই কক্ষে একজন নারী ও একজন পুরুষ কর্মরত ছিলেন। একেক করে বাঙালি ডাকছে আর টাকা চাচ্ছে। কেউ বলছে নেই। কেউ বলছে কম নিন। কেউ বলছে আমার সব হারিয়ে গেছে ইত্যাদি। আমি ভেবেছিলাম এ দুইজন পুলিশ সম্ভবত বাঙালি। চেহারায়ও তেমনটিই মনে হয়েছিলো। দুইজনই নিজ নিজ পোশাকে ছিল। রাষ্ট্রীয় বা দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কোনো পোশাক ছিল না ওদের গায়ে। তবে ওদের ব্যবহার ছিলো খারাপ।

ওরা বাংলা ভাষায় টাকা চায়, অথচ কোনো বাঙালি যদি বাংলায় বলে আমার কাছে নেই, তখন ওরা ইংরেজিতে বলতে হুকুম করে এবং তা ক্রোধের সাথে। আমার জীবনেও আমি এমন অসভ্য, ইতর ও অমানুষিক পরিবেশের সম্মুখীন হইনি। আমি তখনো জানি না যে, এসব বাঙালি জেল খেটে বাড়ি যাচ্ছে এবং ওদের কাছ থেকে খানার টাকা আদায় করা হচ্ছে।

সবশেষে আমাকে ডাকা হলো। বললো ১০০ ডলার দাও। আমি জানতে চাইলাম এটি কীসের টাকা। আমার সমস্যাটা কোথায়? আমাকে যদি সমস্যাই পোহাতে হয়, তাহলে মালাই দূতাবাস আমাকে ভিসা দিয়েছে কেন? আমাকে এভাবে হয়রানি করার মানেটা কি? কথাগুলো হিন্দিতেই বলছিলাম। কেননা, এতোক্ষণে আমি জেনে গিয়েছি যে, ওরা মূলত ইন্ডিয়ার কেরালার লোক। তা ছাড়াও ওরা ফুল ভলিউমে তখন হিন্দি গান শুনছিল।

ওটাকে কোনো অফিসই মনে হয়নি। কখনো মনে হয়েছে বখাটে ছেলে-মেয়েদের গানের আড্ডাখানা, কখনো মনে হয়েছে হিংস্র জানোয়ারের আখড়া। কেননা, ওরা কাজ রেখে কখনো সেলফি তুলছে, কখনো গান ছেড়ে হাত-পা ছুড়ে নাচছে, কখনও শুধু শুধু বাঙালি কাউকে লাথি মেরে আনন্দ করছে, আবার কখনো কখনও মেয়েটি চেয়ার ছেড়ে উঠে ছেলেটিকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। বাঙালিদের ওরা মানুষই মনে করে না। প্রত্যেক কথায় কথায় বাঙালিদের অপমান করে কথা বলছে ওরা। সাথে গালাগালি তো আছেই।

‘হেই বাঙালি স্টুপিড কাম হেয়ার’, এভাবেই বাঙালিদের ডাকে ওরা। যদিও ইমিগ্রেশনের অফসিারদের এমন অভদ্র মনে হয়নি।

আমি কেন হিন্দি বললাম, এজন্য ছেলেটি আমাকে প্রচুর গালাগালি করল। আমি বললাম আমি ইংরেজি জানি না। কিন্তু আমার জানার অধিকার আছে আমি কেন টাকা দেবো এবং কেনো আমাকে এত হয়রানি করা হচ্ছে। এবার নারীটিও ক্ষেপে গেল আমার উপর। ভাবলাম, অধিকার আদায়ের চেয়ে ইজ্জত রক্ষা করা দরকার। টাকা যা চায় দিয়ে বের হয়ে যাই।

আমি ভেবেছিলাম এ টাকা দিলে আমাকে ইমিগ্রেশন পার হতে দেয়া হবে। আসলে ওরা টাকা চাচ্ছিলো আমি যে জেলে খাব, তার বিল। যাই হোক, সরি বলে ১০০ ডলার পেশ করলাম। কিন্তু ওরা তা না নিয়ে মালাই ভাষায় কী যেন বলাবলি করল আর হাসল। এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে নারীটি চেয়ার থেকে উঠে অফিসার ছেলেটিকে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করল। আসলে কীভাবে উপস্থাপন করব বুঝতে পারছিলাম না।

আমার উপর রেগে নারীটি কোথায় যেন চলে গেলো। মিনিট দুয়েক পর একটি ছেলেকে নিয়ে এসে আমার ব্যাগটা নিতে বলে। ছেলেটি ইতস্তত করছিল। আমার দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে ছিল। আমি ভেবেছি ছেলেটি সম্ভবত এখানেরই কোনো দায়িত্বরত কর্মচারী এবং বাঙালি। ও চাইছে না আমি বিপদে পড়ি। ওকে ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে যেতে বলা হলো। সাথে আমাকেও।

ছেলেটি আমাকে ডাকল। সাথে সাথে আমিও গেলাম। ভেবেছিলাম, সম্ভবত ওরা আমার থেকে ঘুষ না পেয়ে রাগ হয়ে ঘুষ না নিয়েই ওকে দিয়ে আমাকে ইমিগ্রেশন পার করে দেবে। আমি তখনো বুঝিনি কী হতে যাচ্ছে আমার সাথে। কেননা, আমি ভাবতেও পারিনি বিনা কারণে আমার জেল হতে পারে।

ছোট একটি রুমের মধ্যে নিয়ে আমার ব্যাগে ট্যাগ লাগানো হলে আমি অনুমান করি আমাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে না তো! এরপর আমাকে জুতা খুলতে বলা হয়। এবার ভেবেছি আমাকে কোনো শাস্তি দেয়া হচ্ছে সম্ভবত। অফিসারটিকে বার বার অনুরোধ করলাম, বললাম আমার সাথে আপনারা এমনটি করতে পারেন না। কিন্তু ব্যাগ বহনকারী ছেলেটি আমাকে অনুরোধ করতে নিষেধ করে।

তখন আবার ভাবলাম হয়তো আমাকে ভয় দেখানো হচ্ছে। টাকা নিয়ে ছেড়ে দেবে আমাকে। এবার রুম থেকে বের করে আমাকে আরেকটি রুমের দিকে নেয়া হয়। রুমটির দরজা খোলা হলো। ভেতরে তাকাতেই কলিজা শুকিয়ে গেলো। ভোর রাত। অসংখ্য মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। কেউ কাঁদছে, কেউ ঘুমোচ্ছে আর কেউ কেউ আমাকে দেখছে।

ভেতরে প্রবেশ করলাম। আমি তখনো বুঝিনি এটি জেল। ভেবেছি, এখানে কিছুক্ষণ রেখে বের করে দেবে। ব্যাগ বহনকারী ছেলেটিকে প্রশ্ন করলাম আপনি কতো বছর চাকরি করেন এখানে? এবং আমাদের এখানে কেনো আনা হলো? ছেলেটি আমাকে বললো, এদিকে আসুন! একটি চেয়ারে বসিয়ে বললো, আমি এখানের কর্মচারী নই। আমাকেও বন্দী করা হয়েছে। ওর চেহারায় আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।

তখন ছেলেটির উপর খুব রাগ হয়েছিল আমার। কেননা, ও আমাকে অফিসারের কাছে অনুরোধ করতে নিষেধ করেছিলো। আমি ভেবেছিলাম অনুরোধ করবো এবং বেশি টাকার অফার দিয়ে বের হয়ে যাব।

ছেলেটি বলল, হুজুর ভুল বুঝবেন না! ওখানে টাকা দিলে ছেড়ে দেয় না। মূলত খানার টাকা রাখে। তবে সরকারিভাবে যতোটুকু বিল আছে, ওরা তার চেয়ে বেশি দাবি করে। বেশিটা ওদের ঘুষ। আর কোনো বিষয় অনুরোধ করলে ওরা মারধর করে। অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে ওরা। আমি চাইনি আপনার মতো লোক ওদের হাতে হেনস্থার স্বীকার হন।

আটক করার কারণ জানতে চাইলে ছেলেটি বলল, আমিও কিছুক্ষণ আগে এসেছি, কিছুই জানি না। আমার প্রফেশনাল ভিসা। চার বছর পর দুই মাসের ছুটিতে দেশে গিয়েছিলাম। ছুটি শেষে এসেছি, কিন্তু আমাকে আটকে দিয়েছে।

আমি অজু করতে চলে গেলাম। অজু শেষে বের হতেই একজন ফিলিস্তিনি এগিয়ে আসেন আমার দিকে। বললেন, শায়খ সালাতুল ফজর। আমি আজান দিলাম। নামাজের ইমামতিও করলাম আমিই। খুব কান্না পাচ্ছিল আমার। ওরা আমার সাথে এমন আচরণ করল? এতোগুলো মানুষকে এভাবে আটক করে রাখল? আমি বাঙালি বলে বাঙালিরা চাচ্ছিলো যেনো নামাজের পর একটু মোনাজাত করি। কিন্তু নামাজে যখন কেরাত পড়ছিলাম, তখন নামাজের মধ্যেই বাঙালিরা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল।

তাই ইচ্ছা করেই নামাজ শেষে আর মোনাজাত করিনি। কেননা, মোনাজাতকালীন পরিবেশটা আমি সহ্য করতে পারতাম না। নামাজ শেষে সাবইকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করি, যাতে দৈর্যধারণ করে সবাই।

ইতিমধ্যে আরও সাতজন বাঙালিকে ঢুকানো হয় জেলখানায়। আমি নামাজের বিছানায়ই বসা ছিলাম দীর্ঘক্ষণ। চুপচাপ বসে আছি। ভাবতে পারছিলাম না কী করব। আর ভাবলেই বা কি? বাহিরের সাথে যোগাযোগের কোনো সুযোগ নেই।

ফিলিস্তিনি লোকটি পাশে এসে বসল। বয়স আনুমানিক ৬০/৬৫ বছর। শারীরিক গঠন খুবই সুন্দর। কথা বার্তায় মনে হলো, লোকটি বড় মাপের আলেম হবেন নিশ্চয়ই। আমার আজান ও তিলাওয়াতের খুব প্রশংসা করলেন। আমি জানতে চাইলাম, কতদিন ধরে এখানে?

তিনি বললেন, ২৭ দিন। বললেন, এ দেশের পুলিশকে মানুষ বলা যায় না। আমার কোটি কোটি টাকার বিজনেস। অথচ, আমি এ দেশে অবৈধভাবে থেকে যাব সন্দেহে আমাকে আটক করে রাখা হলো। সত্যি কথা বলতে আমি তখনো বুঝিনি সেটি জেলখানা এবং আমাকে দেশে ফিরে যেতে হবে। এরপর আস্তে আস্তে জানতে পারি এটি জেলখানা এবং কে কোনদিন ছাড়া পাবে তার কোনো গ্যারান্টিও নেই।

কিছুক্ষণ পর পাশের একটি কক্ষে নারী ও বাচ্চাদের আওয়াজ পাই। বাচ্চাগুলো খুব কাঁদছিল। জানতে পারলাম ওটি নারী লকআপ। বাচ্চাগুলো নাকি এভাবে সারাদিন ক্ষুধায় কান্নাকাটি করে। এ কথা শুনে আমার বাচ্চাদের কথা স্মরণ করে খুব কেঁদেছিলাম আমি। বাস্তবতা কেবল তখনই উপলব্ধি করতে পারি এবং বুঝতে পারি, আমার আর কিছুই করার নেই। আমি জেলখানায় বন্দি আছি। ভেবেছি কীভাবে খবর জানবে বাড়ির মানুষ? স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবা ও প্রিয়জন যখন খোঁজ-খবর না পাবে তখন তাদের কতোটা পেরেশানি হবে? এদিকে মনির ভাই, আব্দুল্লাহ ভাই ও মোস্তফা ভাই না জানি কতোটা দু:শ্চিন্তা করছেন। ওই সময় তাদের কথা ভেবেই বেশি কষ্ট পাচ্ছিলাম আমি। মানুষগুলো কতো কষ্টই না করেছে আমার জন্য।

কেউ এক মাস, কেউ ২০দিন, ১৫দিন, ১০দিন ধরে আটক রয়েছে সেখানে। এক সপ্তার নিচে কেউ ছাড়া পায় না। অবশ্য ভাগ্য ভালো হলে কেউ কেউ এক/দুই দিনেও ছাড়া পেয়ে যায়। তবে তার উপর আশা করা যায় না। আর আমার তো মোটেই না। কেননা, সবাই বলছিল আপনি তাদের সাথে তর্ক করতে গেলেন কেন? ওদের সাথে কেউ তর্ক করলে তাকে একমাসেও ছাড়ে না। আর আপনি আজ যেভাবে তর্ক করলেন, তা অন্য কেউ করলে প্রচুর মারও খেতে হতো। ওরা পান থেকে চুন খসলেই প্রচুর মারধর করে। এই যে আপনি দাড়িয়ে আছেন, এসেই মারধর শুরু করবে আর বলবে এখানে দাড়িয়ে আছ কেন? বসে থাকতে পার না? বসে থাকবেন, বলবে সারাদিন বসে থাক কেন? হাঁটাচলা করতে পারো না? ঘুমাবেন, বলবে এত ঘুম কীসের? এরকম যখন মন চায় ওরা এসে আমাদের এভাবে মারধর করে। আমাদেরকে ওরা মানুষই মনে করে না এবং কথায় কথায় গালাগালি করে।

তবে পুরনো আটককৃত একজন বলেছিলেন, আপনার যেহেতু রিটার্ন টিকিট করা আছে, সেহেতু সপ্তাহ খানিকের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যাব। যাদের রিটার্ন টিকিট নেই, তাদের দু:খের সীমা নেই। কেননা, টিকিট ছাড়া আপনি যাবেন কীভাবে? আর ওরা যে দেশের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেবে, বিষয়টি এমনও নয়। বলবে টিকিট কর, কিন্তু যদি বলি যোগাযোগ করিয়ে দাও, তা দেবে না। ওরা যখন যা মন চায় তাই করে। কোনোভাবে নিজের কেউ খবর পেয়ে যদি টিকিট করে পাঠায়, তবেই ছাড়া পাওয়া সম্ভব। সুইপার মোবাইল নিয়ে আসে, এক মিনিট কথা বলতে বাংলাদেশি ১০০ টাকা নেয়। আবার কারো কাছে বেশি টাকা দেখলে তা জোড় করে নিয়ে যায়। অফিসাররা ভেতরে ঢুকে সিগারেট টানে। নারী-পুরুষ নষ্টামী করে। এমন কি নেশাও করে। আর আমাদের কেউ সেদিকে তাকালেও তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে।

একজন পাকিস্তানি তাবলীগের মুরুব্বিকে আটক করে ওরা, যার ছেলে মালয়েশিয়ান বড় একটি কোম্পানির মালিক। প্রফেশনাল ভিসাধারী বেশ কয়েকজন বাঙালি ছিল, যারা ৪-৫ বছর ধরে মালয়েশিয়া কাজ করছে। ছুটি কাটিয়ে কেবল বাংলাদেশ থেকে ফিরেছে। কিন্তু তাদেরকে বিমান থেকে নামতেই গ্রেপ্তার করেছে। পাশের রুমে আটক থাকা নারী ও শিশুদের কান্নাকাটিতে হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল।

নিয়ত করে ফেললাম, মানসিকভাবে একটু স্বাভাবিক হলে সাংবাদিকের ভূমিকা পালন করব। যতোদিনই বন্দী থাকি না কেনো, এখানের সব অনিয়মগুলো নোট করব আমি। যাতে বিশ্ব দরবারে ওদের গাদ্দার তুলে ধরতে পারি। এরমধ্যে চারজন বাঙালিকে নিশ্চিত করা হলো, তাদেরকে আজকের ফ্লাইটেই বাংলাদেশে পাঠানো হবে।

একজন ১১ দিন ও আরেকজন পাঁচদিন পর ছাড়া পাচ্ছে। আর বাকি দুইজনেরটা সঠিক খেয়াল নেই। তারা খুব খুশি এবং অন্যরা তাদের কাছে প্রিয়জনদের নম্বার দিচ্ছিল যাতে মুক্তির ব্যবস্থা নেয়। ওখানে ঢুকালে আপনার প্রিয়জনের জানার সুযোগ নেই যে, আপনি কোথায় আছেন। বিষয়টি এমন নয় যে, আপনাকে গ্রেপ্তার করে আপনার পরিচিত কাউকে জানানো হয়।

একেক করে চারজনের নাম ধরে ডাকলে নতুন এক নারী পুলিশ। কাকতালীয়ভাবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমার নামটিও উচ্চারণ করলেন। সাংবাদিকতা আর করা হলো না। তবে যতোটুকু ঘটেছে বা দেখেছি, ততোটুকু তো পৃথিবীকে জানাবই। ২৯ জুন স্থানীয় সময় বিকাল পাঁচটার ইউ এস বাংলা এয়ারলাইন্সে আমাকেসহ আরো চারজনকে ফেরত পাঠানো হয় বাংলাদেশে।

ওরা যাকে তাকে সন্দেহ করে, তবে বাংলাদেশিদের একেবারেই ছোট নজরে দেখে ওরা। বর্তমানে নাকি মালয়েশয়িায় যতো অবৈধ লোক আছে, তাদেরকে সুযোগ দেয়া হয়েছে বৈধ হওয়ার। ফলে এই সুযোগে বাঙালিরা ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে ব্যাপকহারে মালয়েশিয়া ঢুকছে। আমার কথা হচ্ছে, যদি বিষয়টি এমনই হয়, তাহলে তো দুই মাসের জন্য বাঙালিদের জন্য মালয়েশিয় ভিসা বন্ধ করে দিলেই হতো! ভিসা দিয়ে এগুলো কোন ধরণের ফাজলামো?

হাজার হাজার মানুষ টাকা খরচ করে সেখানে কি তাদের ফাজলামো দেখতে যায়? এরপরও প্রয়োজনে সন্দেহজনক ব্যক্তির পেছনে গোয়েন্দা নজরদারি করা যেতে পারে! পাইকারি হারে এমন হয়রানির মানে কি? শুনেছি এর আগে নাকি বাংলাদশের সচিব পর্যায়ের একজন ব্যক্তিকেও তিনদিন আটক করে রাখা হয়েছিলো।

আমাদের সাথে এমন এমন ব্যবসায়ী ছিলেন, যাদের মালয়েশিয়াতেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। একজন তো মালাই ভাষাও জানেন, বিয়ে করেছেন মালয়েশিয়ায়, পাসপোর্টে অনেকগুলো দেশের ভিসা লাগানো, তবুও তাকে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এরকম অসংখ্য সম্মানি লোকদের ওরা বন্দী করে রেখেছে। যতো মানুষ আটক করেছে, কারোরই ভিসা পাসপোর্ট বা অন্য কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা ওরা সন্দেহ করেছে। আচ্ছা কাউকে সন্দেহ করলে তো তাকে যাচাই করা যায়! যাচাইতেও সন্দেহ থেকে গেলে তখন না হয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

কিন্তু যাচাই ছাড়া কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে এভাবেই হেনস্থা করা হচ্ছে বাঙালি নাগরিকদের। তাদের সন্দেহ দূর করতে আপনি যে কিছু বলবেন, সে সুযোগও দিচ্ছে না ওরা। শুধুমাত্র সন্দেহর উপর ভিত্তি করে প্রমাণ ছাড়া এভাবে হেনস্থা করার অধিকার আছে তাদের?

শুনেছি একদিনে ৯০০ বাঙালিকে আটক করা হয়েছে শুধু এই সন্দেহর ভিত্তিতে। অনেককে এমন পেয়েছি, যাদেরকে বিমান থেকে নামার সাথে সাথেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব বিষয় বাংলাদেশ সরকারের এখনি ভূমিকা নিতে হবে। বাংলাদেশকে এভাবে ছোট করে দেখার অধিকার কার নেই।

হ্যাঁ, এটিও সত্য যে, কিছু বাঙালি ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে সেখানে অবৈধভাবে থেকে যাচ্ছে। আমাদের সাথে থাকা বাঙালিদের মধ্যে অধিকাংশই অবৈধভাবে থেকে যাওয়ার জন্যই ট্যুর ভিসা করে মালয়েশিয়া গেছে। লজ্জা হয় তাদের জন্য। কেউ কেউ তো একবার ধরা খেয়ে আবার এসেছে। কিন্তু কেন? আপনি এ পথ কেনো বেছে নিচ্ছেন? গেলে বৈধভাবে যান, নাহয় দেশে পরে থাকেন? দেশে যারা আছে তারা কি না খেয়ে থাকে? আর এর পেছনে যে সমস্ত দালালগোষ্ঠী কাজ করছে, তাদেরকেও বা সরকার দমন করছে না কেন?

প্রায় সময়ই এই দালালগোষ্ঠীর নানা ধরণের ফাঁদ ও প্রতারণার খবর শুনে থাকি মিডিয়ার মাধ্যমে। কই, সমস্যার নিরসন হচ্ছে নাতো। যারা অবৈধভাবে অন্য দেশে যেতে চাচ্ছেন, মূলত তারাও বাংলাদেশের শত্রুদের অংশীদার। তাদের কারণেই অন্যদেশে আমার দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। অনুরোধ করে বলছি, আপনারা অবৈধভাবে বিদেশে যাবেন না।

প্লিজ, দেশে রিকশা চালান, দিনমজুরি কাজ করুন, চানাচুর বিক্রি করুন, তবুও এ অবৈধ পথ বেছে নিবেন না। দেশের বদনাম করবেন না আপনারা। কাঁদাবেন না নিজের স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবাসহ প্রিয়জনদের।

সরকারে প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে, আপনি অবৈধ পন্থা অবলম্বনকারী আদম ব্যবসায়ী নামক দালালদের দমন করুন। কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করুন তাদের। সাথে সাথে বাংলাদেশে কর্মসংস্থান বাড়ান। বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। এ দেশে জায়গার অভাব নেই। নেই বুদ্ধির অভাবও। এখনি পদক্ষেপ নেয়ার সময়। বাংলাদেশে কর্মসংস্থান বাড়িয়ে আমার দেশের নাগরিকদের আমার দেশেই কাজ করার সুযোগ করে দিন। আমরা ভিনদেশের গোলামি করতে চাই না। বরং, বাংলাদেশই হবে অন্যান্য দেশের সমীহ জাগানো দেশ।

সবশেষে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন পুলিশদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই, যত দেশে গিয়েছি, বাংলাদেশের ইমিগ্রেশনে থাকা পুলিশদের আচরণের মতো কোনো দেশের পুলিশদের আচরণ পাইনি। তাদের ব্যবহার দেখলে সত্যিকারের সেবক মনে হয় তাদেরকে। পরামর্শ নেয়া যায়। সুযোগ-সুবিধা দেখেন। পরামর্শ দেন। সমস্যা হলে সমাধানের পথ বাতলে দেন। বিশেষ করে বিদেশি নাগরিকদের প্রতি তাদের সহানুভূতি ও মেহমানসূলভ ব্যবহারের তুলনাই হয় না। এরপর কত যাত্রীকে তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করতে দেখি, কিন্তু তারা বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নিয়ে সেবা দিয়ে যান।

যদিও দুই একজন ব্যতিক্রম থাকতে পারে। অথচ, অন্যান্য দেশে বাঙালিদের মেহমান নয়, কামলা হিসেবে দেখে। বিশেষ করে মালয়েশিয়া। না দেবে পরামর্শ, না শুনবে আপনার কথা। না করবে মূল্যায়ন। আপনাকে মানুষই করবে না ওরা। মনুষ্যত্ব বলতে কিছু নেই ওদের মধ্যে।

তবে এর জন্য কিছুটা দায়ভার আমরাও এড়াতে পারবো না। পারবে না দেশের সরকারও। তারা দেশে কর্মসংস্থান না বাড়িয়ে, দুর্নীতি বন্ধ না করে, দালালদের প্রশ্রয় দিয়ে, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে বিদেশ ভ্রমনে গিয়ে দেশের জন্য ভিক্ষা চায়। লজ্জা হওয়া উচিত আমাদের।

লেখক: মালয়েশিয়ায় গিয়ে ভুক্তভোগীদের একজন

সংবাদটি শেয়ার করুন

প্রবাসের খবর বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :