আইন, অধিকার এবং ফরহাদ মজহার

মাসুদ কামাল
 | প্রকাশিত : ১৩ জুলাই ২০১৭, ১১:২১

গেল সপ্তাহে তিনটি বিষয় খুবই আলোচনায় এসেছে। এক. সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে বাতিল করে দিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। দুই. লেখক, কবি, কলামলেখক ফরহাদ মজহার উধাও হয়ে গেলেন, তারপর আঠার ঘন্টা পর উদ্ধারও হলেন। তিন. যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে। সেখানে তারা দাবি করেছে, বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক বিরোধী নেতা-কর্মী গুম হয়ে যাচ্ছে এবং এজন্য সরকারকেই তারা দায়ী বলে দাবি করেছে।

এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে কোনো যোগসূত্র কি আছে? আপাতদৃষ্টিতে নেই বলেই মনে হয়। কিন্তু গত কয়েকদিন এসব বিষয় নিয়ে যা আলোচনা শুনছি, তাতে কেমন যেন একটা সম্পর্কের আভাসের কথা কেউ কেউ ভাবতে চাইছেন।

সেদিন আমার এক সহকর্মী বললেন- দেশে যখন বড় কোনো ঘটনা ঘটে, কোনো বিতর্ক সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখন সাধারণ মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর জন্য এরকম কিছু ঘটনার অবতারণা করা হয়। তিনি বিষয়টির ব্যাখ্যাও দিলেন। বললেন, সরকারের মধ্যে হয়তো একটা আশা ছিল আপিল বিভাগে শেষ পর্যন্ত ষোড়শ সংশোধনী টিকে যাবে। তখন এ নিয়ে যাতে বেশি আলোচনা না হয়, সে লক্ষ্যে সেদিনই ফরহাদ মজহারকে নিয়ে নাটকটা শুরু করা হয়। কিন্তু বাস্তবে যখন দেখা গেল, আপিল বিভাগের রায় সরকারের বিপক্ষে গেল, তখন তারা দেখলো অপহরণ নাটকের আর দরকার নেই, তাই তাকে উদ্ধার নাটকটিও দ্রুত মঞ্চস্থ করা হলো।

বাংলাদেশে বর্তমানে একটা প্রবণতা খুব দেখা যায়। যে যা-ই বলুক না কেন, সঙ্গে সঙ্গে তাকে কোনো না কোনো দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার শুরু হয়ে যায়। আমিও সম্ভবত ওই গোত্রের বাইরে নই। নয়তো তখনই আমার কেন মনে হলো যে, আমার ওই সহকর্মী খুবই সরকারবিরোধী একজন মানুষ? কেন মনে হলো, সেটা বলি। ধরলাম, সরকারই তার লোকজন দিয়ে এই অপহরণ করিয়েছে।

কিন্তু ফরহাদ মজহারের পরিবার সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এই ভদ্রলোক সাধারণত অত সকালে ঘর থেকে বের হতেন না। এদিন ভোরের এই বের হওয়াটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। এখন যদি সরকারকে দায়ী করার থিওরিটিকে সত্য ভাবতে হয়, তখন প্রশ্ন থাকবে- সরকারের লোকগুলো কি করে জানবে যে ওই দিনই অত সকালে তিনি ঘর থেকে বের হবেন? আর সরকারই যদি এই ঘটনার পিছনে থাকে, তাহলে ব্যতিক্রমী এক সকালের অপেক্ষায় না থেকে তার স্বাভাবিক জীবনযাপনের কোনো সময় এসে উঠিয়ে নিয়ে গেলেই পারত।

এখানে আর একটি কথা বলা যায়। অপরাধ বিজ্ঞানে একটা কথা প্রায়ই বলা হয়। কোন অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিটিকে চিহ্নিত করতে হলে প্রথমেই দেখতে হয়, এই ঘটনায় বেনিফিসিয়ারি কে? অর্থাৎ ঘটনাটির কারণে লাভ কার হলো? সেই বিচারে ফরহাদ মজহার ঘটনায় সরকার কি লাভবান হয়েছে? নাকি ওই ভদ্রলোকই প্রচারের পাদপ্রদীপে চলে এসেছেন? এখন বরং তৃতীয় সম্ভাবনার কথাটা বলা যাক। এর সঙ্গে আমেরিকার ওই মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টের যোগসূত্রটা দেখার চেষ্টা করবো।

বলে রাখা ভালো, এটা হবে অনেকটা সরকারি ভার্সনের কথার মতো। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই মানবাধিকার সংগঠনটি বাংলাদেশ সম্পর্কে এই প্রথম কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করলো- তা কিন্তু নয়। এর আগেও বেশ কয়েকবার তারা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবার প্রায় একই ধরনের মন্তব্য। তবে তারা সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি করেছে মানবতাবিরোধী বিচারের সময়। তাদের সেই অবস্থান এই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল। তাদের মন্তব্য হয়তো তাদের প্রেক্ষিতে ঠিক ছিল, কিন্তু সেটা আমাদের জাতীয় সেন্টিমেন্টের বিপরীতে ছিল।

এখন একটা সমস্যা হয়েছে যে, যখনই তারা কোনো মন্তব্য করে, যদি সেটা আমাদের সরকারের পক্ষে না যায়, তখনই মানবতাবিরোধী বিচার বিষয়ে তাদের পর্যবেক্ষণের ভ্রান্তিটিকে জোরালোভাবে তুলে আনা হয়। আগের সেই উদাহরণের কথা বলে সরকার তাদের সকল প্রতিবেদনকেই উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এবারও তাই করা হচ্ছে। আবার বিপরীত দিকে এমন কথাও বলা হয়ে থাকে, তাদের সঙ্গে নাকি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। এসব কারণেই সম্ভাব্য যোগসূত্রের তৃতীয় ধারাটির উদ্ভব হয়েছে।

আচ্ছা, ধরা যাক ফরহাদ মজহার হারিয়ে যাওয়ার ১৮ ঘন্টার মধ্যেই যদি উদ্ধার না হতেন, যদি এখনও হারানো অবস্থাতেই থাকতেন, তাহলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনের প্রভাবটি কি আরও বেশি জোরালো হতো না? হয়তো বলা হতো, এই প্রতিবেদন যে কতটা নির্মম সত্য তার প্রমাণ হচ্ছে- এখনো দেশের একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি (যাকে তার অনুসারীরা ভক্তিভরে দার্শনিক পর্যন্ত বলে থাকেন) গুম হয়ে আছেন। তখন এই প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করা কিংবা একে অগ্রাহ্য করা সরকারের পক্ষে অসম্ভবই হতো।

কিন্তু বাস্তবে হয়েছে অন্য রকম। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার মাত্র ঘন্টা কয়েক আগেই ফরহাদ মজহার উদ্ধার হয়ে গেছেন। সরকার সমর্থকরা হয়তো বলবেন, একারণে তারা রক্ষা পেয়ে গেছেন, ওদের প্রতিবেদনটিকে অকাট্য প্রমাণের কোনো নগদ উদাহরণ আর মেলেনি। কিন্তু আসলেই কি তেমন কিছু ঘটেছে? ফরহাদ মজহারের নগদ উদাহরণ দেয়া না গেলেও ওই প্রতিবেদনটি কি একেবারেই উড়িয়ে দেয়ার মতো? গুমের ঘটনা কি ঘটেনি গত কয়েক বছরে? প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক ২০১৬ সালেই ৯০ জনকে তুলে নিয়ে গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে, এদের কেউই আর ফিরে আসেনি। ২০১৭ সালের প্রথম পাঁচ মাসে এভাবে নিখোঁজ হয়েছে ৪৮ জন। এদের এই হারিয়ে যাওয়াকে আমরা কি বলবো?

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য অন্য একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অনেকে নাকি ব্যবসায়িক কারণে কিংবা সামাজিক কারণে নিজেকে নিজেই গুম করে ফেলেন। টেলিভিশনে যখন তার এই কথাগুলো দেখছিলাম, বুঝতে পারছিলাম না, উনি কি কৌতুক করছেন? যে অভিযোগ তুলেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠন, সেটি কি কোনো কৌতুকের বিষয়? গুম যারা হয়েছেন, তারা কিন্তু ভিনগ্রহের কোনো মানুষ নয়। আমাদের আশপাশেই তারা এতদিন ছিলেন, হয়তো আমাদের অনেকের প্রতিবেশীই, বিষয়গুলো আমরা সাধারণ মানুষ যে একেবারে কিছুই জানি না, তা তো নয়। তাহলে এরকম হালকাভাবে নেয়ার বাস্তবতাটা কোথায়?

আর এক মন্ত্রী, সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সুনির্দিষ্ট উদাহরণ চাইলেন। তার এই বক্তব্য অবশ্য মন্দের ভালো। তবু উনি রসিকতা করার চেষ্টা করেননি। কিন্তু একটা বিষয় আমি ঠিক বুঝি না। উনি কি ৮২ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনটিতে একবারও চোখ বুলানোর প্রয়োজন মনে করেননি? ওখানে তো একটি দুটি নয়, অনেক ঘটনার সবিস্তার বর্ণনাই দেয়া হয়েছে। একটা ভিডিও ক্লিপও তো দেখলাম। গুম হয়ে যাওয়া অনেক পরিবার এর মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করেছেন, তাদের সন্তান, ভাই কিংবা স্বামীকে কিভাবে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে ডিটেইল বলেছেন। বিভিন্ন মিডিয়াতেও প্রচার হয়েছে সেগুলো। সেসব বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো জবাবও দেয়া হয়নি। জবাব নেই বলে দেয়া হয়নি, নাকি ওইসব অভিযোগকে সরকার গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনই মনে করেনি, সেটাও জনগণের কাছে পরিষ্কার নয়।

আবার ফিরে আসি ফরহাদ মজহার প্রসঙ্গে। আলোচিত তিনটি বিষয়ের মধ্যে আমার বিবেচনায় সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই উধাও এবং প্রত্যাবর্তন ঘটনাটি। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, এটি নিয়েই আলোচনা বেশি হয়েছে। ফেসবুকেও ঝড় ওঠেছে এ নিয়েই। বিষয়টি অনেকের কাছে কিছুটা অস্বাভাবিকও ঠেকেছে। আমার এক সিনিয়র বন্ধু সেদিন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা ফরহাদ মজহার অপহৃত হলেন নাকি নিজেই অপহরণ নাটক করলেন এই প্রশ্নের সুরাহা হওয়া কি জাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু? পুরো দেশ এখন বন্যায় ভাসছে, পার্বত্য অঞ্চলের দুর্যোগ এখনো কিছুমাত্র কমেনি, ত্রাণ তৎপরতা এখনো অপ্রতুল, মানুষের দুর্ভোগ চরমে। এর বাইরে রয়েছে চালের দাম। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারণে মানুষকে বাড়তি দামে চাল কিনতে হচ্ছে। কিছুই করতে পারছে না সরকার। অথচ, সে সব বাদ দিয়ে আমরা লাফাচ্ছি ফরহাদ মজহার নিয়ে।’

ছবি: লেখক

বন্ধুর এসব কথার কোনো জবাব আমার কাছে ছিল না। বন্ধুটি তখন ফরহাদ মজহারের ব্যক্তিগত জীবনের কিছু কথাও শোনালেন। বললেন, এই ফরহাদ মজহার হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন, সে রাতে যুক্তরাষ্ট্রে বসে বন্ধুদের নিয়ে সুরা পানের উৎসব করেছিলেন। আজকের বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টুও নাকি ছিলেন সেই উৎসবে। আমি জানি না এসব অভিযোগ সত্য কি না। যদি সত্য না-ও হয়, তারপরও বলবো দেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে ফরহাদ মজহার গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নয়। এর চেয়ে অনেক বেশি আলোচনা এবং মনোযোগের দাবি রাখে বন্যা, দুর্যোগ, এমনকি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টটিও।

মাসুদ কামাল: লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :