তামিম ইকবালের ইউটার্নঃ ভয় নাকি স্বার্থপরতা?

শেখ আদনান ফাহাদ
| আপডেট : ১৩ জুলাই ২০১৭, ২২:৫৯ | প্রকাশিত : ১৩ জুলাই ২০১৭, ২২:৫৫

বাংলাদেশের মহাতারকা ক্রিকেটার তামিম ইকবাল খান লন্ডনে তার পরিবারের উপর খ্রিস্টান চরমপন্থীদের একটি গ্রুপ কর্তৃক এসিড হামলার চেষ্টার খবরকে অস্বীকার করলেন কেন? দেশে ফিরে তার এই ইউটার্ন কি কোনো ভয় থেকে উৎসারিত নাকি তামিম এখানে স্বার্থপরতার পরিচয় দিলেন? সবগুলো জাতীয় এবং কোনো কোনো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম তামিম পরিবারের উপর এসিড হামলার চেষ্টার খবর প্রচার করেছে। পুরো দেশের মানুষ ও বিসিবি যেখানে এই ঘৃণ্য প্রচেষ্টার প্রতি ঘৃণা জানিয়ে তামিমের পাশে দাঁড়িয়েছে, সেখানে তিনি কেন ব্যাপারটি অস্বীকার করছেন?

তামিম ইকবাল তো ভয় পাওয়ার লোক নন। ভয় পেলে কি আর ভারত –পাকিস্তানের বাঘা বাঘা বোলারদের পিটিয়ে ছাতু বানাতে পারতেন? তাহলে এই বর্বর হামলা চেষ্টার ঘটনা অস্বীকার করছেন কেন এই টাইগার ক্রিকেটার? তাহলে কি তার ব্রিটিশ ক্লাবের অনুরোধে এমনটা করলেন? এসিড হামলা থেকে বাঁচতে লন্ডন থেকে কোনোমতে দেশের নিরাপদ কোলে ফিরে আসতে পেরেছেন। কিন্তু মায়ের কোলে ফিরেও কেন তামিম এমন করলেন?

তামিমের প্রতি আমাদের ভালোবাসা, আবেগ আর শ্রদ্ধার শেষ নেই। তামিম আসলে বাংলাদেশি বীর বাঙালির প্রতিচ্ছবি। তামিমরা আমাদের আশা-ভরসার প্রতীক। দেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের রাজা তামিম ইকবাল খান পারতেন সাহস করে সব ফাঁস করে দিয়ে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া একের পর এক হেইট ক্রাইম (বিশেষ ধর্মের প্রতি ঘৃণা থেকে সংঘটিত অপরাধ) এর বিরুদ্ধে জনজোয়ার সৃষ্টি করতে। পারতেন, পশ্চিমা বিশ্বের নিউইয়র্ক, লন্ডনসহ নানা শহরে এশিয়ান, আফ্রিকানদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী বা ধর্মীয় ঘৃণা-প্রসূত শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থিদের ক্রমবর্ধমান হামলার খবর বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে। তামিম একটু স্বীকার করলেই, একটু প্রতিবাদী হলেই আমাদের মনোজগতের উপনিবেশটা দুর্বল হয়ে যেত, দেশের মানুষ জানতে পারত, পূর্বের মানুষেরা স্বপ্নের পশ্চিমে কীভাবে নিগৃহীত হচ্ছে।

ভারতের একাধিক রাজ্যে প্রায় সারা বছরই কারফিউ জারি করা থাকে। বিশ্বের অন্যতম বিপদজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশ ভারত। গ্লোবাল পিস ইনডেক্স' ২০১৬ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতের অবস্থা বুরুন্ডি, সার্বিয়া কিংবা বুরকিনাফাসো এর মত রাষ্ট্র থেকেও খারাপ। শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় ১৬৩টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৪১তম। ভারতের আভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার ফলে ২০১৫ সালে ক্ষতির পরিমাণ ৬৮০ বিলিয়ন ডলার বলে সে রিপোর্টে জানায় অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউট ফর পিস অ্যান্ড ইকনমিকস। সবচেয়ে বিপদজনক রাষ্ট্রের তালিকায় প্রথম স্থানে আছে সিরিয়া। তারপরে আছে সাউথ সুদান, ইরাক, আফগানিস্তান এবং সোমালিয়া।

বাংলাদেশের অবস্থা জানেন কত? ভারতের অবস্থান ১৪১তম, বাংলাদেশের ৮৩তম। বাংলাদেশ তাহলে কতধাপ এগিয়ে থাকল? বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় ভারত থেকে ৫৮ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের উপরে আছে কেবল ভুটান (১৩তম) এবং নেপাল (৭৮)। অন্যদিকে শ্রীলংকার অবস্থান ৯৭ এবং পাকিস্তানের ১৫৩তম।

অথচ ভারতে কোনোদিন অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ড খেলতে আসতে অস্বীকৃতি জানাবে বা জানিয়েছে? জানায়নি। কারণ ভারতের খেলোয়াড়রা জানে কীভাবে নিজের দাম ও ভাব নিয়ে চলতে হয়। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডও সেভাবেই তাদের খেলোয়াড়দের তৈরি করে। একটু সবাই ভাবেন, ভারতের কোনো খেলোয়াড় এমন আক্রমণের কবলে পড়লে আজ সেখানকার মিডিয়া কী আলোড়নই না তুলত!

বাংলাদেশে খেলতে আসতে নিরাপত্তা ঝুঁকির অজুহাতে অস্বীকৃতি জানায় অস্ট্রেলিয়া। ইংল্যান্ডে ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলাকালেই একাধিক ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। তখন, বিসিবি আমাদের খেলোয়াড়দের জন্য বাড়তি নিরাপত্তার দাবি তুলেছে বলে শুনিনি। বিসিবি পরিস্থিতির সুযোগে ইংল্যান্ডকে এক হাত নিতে পারত। এতে করে ইংল্যান্ড কূটনৈতিকভাবে চাপে থাকত। পরে আমাদের সাথে কোনো কারণ ছাড়াই ‘ভাব’ নিতে দুইবার ভাবত। বিসিবি বা আমাদের খেলোয়াড়রা কবে ছক্কা-চার মারার পাশাপাশি একটু কূটনৈতিক বুদ্ধিও অর্জন করবে? একবার মনে আছে, বাংলাদেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট টিমের উপর কয়েকজন দুর্বৃত্ত ইট অথবা পাথর টুকরো দিয়ে ঢিল ছুড়েছিল। তাতে পুরো বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলাদেশের দর্শকদের আচরণে বিদেশি খেলোয়াড়রা বরাবরই মুগ্ধ থাকলেও সেই ঘটনায় বাংলাদেশকে অতি নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছিল দেশী-বিদেশি মিডিয়া।

‘ইংলিশ ডিফেন্স লীগ’ এর নাম শুনেছেন আপনারা? নাম শুনলে মনে হয় যেন কোনো ফুটবল লীগের নাম, আদতে তা নয়। এটি একটি মুসলিম সম্প্রদায়-বিরোধী খ্রিস্টান জঙ্গি সংগঠন। এরা মাঝেই মাঝেই মুসলিমদের উপর হামলা করে। মসজিদে, বাসায়। যদি বিশ্বাস না হয়, তাহলে ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে দেখেন, অনেক খবর পাবেন। ঢাকাটাইমস এর প্রতিবেদন অনুযায়ী মুসলিম বলে লন্ডনে উগ্রবাদীদের রোষানলে পড়েছিলেন মারকুটে ওপেনার তামিম ইকবাল ও তার পরিবার। আর তাতেই সন্ত্রস্ত হয়ে ঢাকায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তামিম ইকবাল। বিসিবির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে এ খবর। সোমবার রাতে ঘটে ঘটনাটি। রেস্টুরেন্ট থেকে রাতের খাবার শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন তামিম, তার স্ত্রী অয়েশা সিদ্দিকা ও পুত্র আরহাম। তখনই উগ্রবাদীরা তাদের তাড়া করে। তামিমের স্ত্রী হিজাব পরেন। এ কারণেই তাদের টার্গেট করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আক্রমণকারীদের হাতে অ্যাসিডও ছিল। অবস্থা খুব খারাপ দেখে দৌড়ে পালিয়ে নিজেদের রক্ষা করেন তামিম ও তার পরিবার।

আজ তামিম নিজের ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে বিষয়টা চেপে গেলেন। কাল আমাদের অন্য কোনো খেলোয়াড় বা অন্য কোনো দেশের খেলোয়াড় সেখানে যাবে খেলতে। সে খেলোয়াড় যদি মুসলিম, এশিয়ান বা আফ্রিকান হয়ে থাকেন তাহলে তার হামলার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। হামলায় কেউ বাঁচবে, কেউ মরবে। তামিমের বা তার পরিবারের কিছু হয়ে গেলে আজ বাংলাদেশের পরিস্থিতি কী হতে পারত, সবাই ভেবে দেখুন। তাই তামিম ইকবালের প্রতি অনুরোধ থাকবে, কোনো ভয় বা স্বার্থের জন্য সত্য প্রকাশে পিছপা হবেন না। আপনারা জাতীয় মহাতারকা। আপনার ব্যক্তিগত একটা বিষয়ও দেশের কোটি কোটি মানুষকে আনন্দ যেমন দেয়, বেদনাও দেয়।

লেখকঃ সাংবাদিক ও শিক্ষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :