খালেদা জিয়ার লন্ডনযাত্রা এবং ফরহাদ মজহারের ভাষণ পাঠ-১

শেখ আদনান ফাহাদ
| আপডেট : ১৫ জুলাই ২০১৭, ২২:৩৭ | প্রকাশিত : ১৫ জুলাই ২০১৭, ২২:৩১

বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন পর লন্ডন যাচ্ছেন। সেখানে তার বড় ছেলে তারেক জিয়া থাকেন। অনেকদিন হয়ে গেল, দুর্নীতিসহ নানাবিধ মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় তারেক জিয়া দেশে ফিরছেন না। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা যাওয়ার পর, খালেদা জিয়ার সন্তান বলতে এখন একজনই, তারেক জিয়া। তাই লন্ডন যাত্রায় মানবিক দিক অবশ্যই আছে। প্রায় দুই মাস লন্ডন থাকবেন তিনি। সেখানে চিকিৎসাও করাবেন তিনি। এমনিতে চিকিৎসার জন্য সৌদি আরব যান খালেদা জিয়া। এবার হয়ত ছেলে, ছেলের বউ, নাতিনদের সাথে সময় কাটানোর পাশাপাশি চেকআপও করবেন বলে লন্ডন যাত্রা করলেন তিনি। কিন্তু আসলেই কি এত সরল এই লন্ডন যাত্রা? ছেলের কাছে মা যাবেন এটাইতো স্বাভাবিক। কিন্তু মা কিংবা ছেলে কেউই আম আদমি না। মা বিএনপি বর্তমান চেয়ারপার্সন, ছেলে বিএনপির ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম আলোচিত ব্যক্তি সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের পরিবার। তাই এই যাত্রা যেমন সরল নয়, তাই এই যাত্রাপাঠও সরল নয়।

লন্ডনে তারেক জিয়াকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ বিরোধী একটা শক্তিশালী বলয় তৈরি হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী, জামাত নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাকও দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। আওয়ামী লীগ বিরোধী সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ নিয়মিত লন্ডনে আসা-যাওয়া করেন। অনেকে সেখানে রেগুলার থাকেন। এই যেমন গত কিছুদিনে ধরে বার বার সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হওয়া ‘বুদ্ধিজীবী’ ফরহাদ মজহার ২০১৪ সালের নভেম্বরে লন্ডনে গিয়ে ওয়াটার লিলি গার্ডেন এক ভাষণে আওয়ামী লীগ সরকারকে ফ্যাসবাদি, জালেম সরকার বলে বর্ণনা করে লম্বা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘ফেলে দেয়ার’ আহবান জানিয়েছিলেন। ৫ মে সরকার ‘পতন’ করতে না পারায় বিএনপি-জামাতের নেতাদের প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। শাহবাগের গণজাগরণের আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের তিনি ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’ বলে বর্ণনা করেছেন। বলেছেন,’বাংলাদেশে মুসলমানদের রাষ্ট্র কায়েম করা দরকার’। বলেছেন, ‘শেখ মুজিবকে মুক্তিযুদ্ধের নেতা আমি মানিনা’। খালেদা জিয়ার সাথে হয়ত ফরহাদ মজহারের লন্ডনে দেখা হবেনা। দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ ফরহাদ মজহার এখন ‘অর্চনা’ ইস্যুতে ভীষণ বিব্রতকর অবস্থায় আছেন। ফরহাদ মজহার লন্ডনে খালেদা জিয়ার সাথে শারীরিকভাবে হয়ত দেখা করতে পারবেন না। কিন্তু ফরহাদ মজহার নতুন যে ভাবদর্শন প্রচার শুরু করেছেন তার প্রভাব নিশ্চয় দেখতে পারবেন। খালেদা জিয়া লন্ডনে ছেলের সাথে সাক্ষাৎ আর চিকিৎসা ছাড়া আর কী করবেন,সেটা সময়ই বলে দেবে। এই ফাঁকে আমরা একটু ফরহাদ মজহারের ভাষণ পাঠ করে আসি। লম্বা ‘আসসালামুআলাইকুম’ দিয়ে সিটিজেনস মুভমেণ্ট,ইউকে আয়োজিত সে বক্তৃতায় তিনি বলেন-

“মালেক ভাই আপনাকে ধন্যবাদ, আপনাদের সামনে দাঁড়াতে পেরেছি, তাতে আমি অভিভূত। যে ভালোবাসা, মহব্বত আমি পেয়েছি তাতে আমি মুগ্ধ।আজকে আমি চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখছি এই হলরুমে প্রচুর পরিমাণ বাংলাদেশী ব্রিটিশ নাগরিক উপস্থিত আছেন। আমি অভিভূত, এই ঐক্যের সংবাদ আমি বাংলাদেশে বহন করে নিয়ে যাব। আজকের এই সমাবেশ একটি ঐক্যের প্রতীক, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে, আমরা যে, বিএনপির নেতৃত্বে যে জোট আছে বাংলাদেশে তাদেরকে শিখতে হবে, ঐক্যবদ্ধ রাখতে হবে। একত্রে রাখতে হবে জনগণকে। যে ফ্যাসিস্ট সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করছি, সেটি দীর্ঘমেয়াদী এবং গভীর, এখানে ঐক্যটা পূর্বশর্ত। সে ঐক্যে যারা ভাঙ্গন ধরানোর চেষ্টা করবে, কোনো অজুহাতে কোনো প্রোপাগান্ডায়, কোনো গুজবে তার বিরুদ্ধে আপনারা রুখে দাঁড়াবেন এবং তার আদর্শ স্থাপন করবেন এই বিলেতে। এই বিলাত থেকে বহু দেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। এই বিলাত থেকে ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। এই বিলাতের নাগরিকরা বিভিন্ন সময়ে, সংকটে ভূমিকা রেখেছে। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, আগামী দিনে বাংলাদেশের যে লড়াই সংগ্রাম আসছে, যে রক্তাক্ত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হবে, যে বড়ধরনের পরীক্ষার সম্মুখিন হতে হবে সেখানে আপনারা সবচেয়ে বড় প্রেরণার অংশ হয়ে থাকবেন, আপনারা পথ দেখাবেন ইনশাল্লাহ।

আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু আমার পেছনে আমি দেখতে পাচ্ছি সেই অনেক আগে লর্ড ক্লাইভের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, মীর মদনমোহনরা লড়াই করছে, মীর জাফররা লড়াই করছে; তার পাশে কৃষকরা দাঁড়িয়ে দেখছে, তারা বুঝেন নাই যে দুশ বছরের গোলামির তিলক এঁকে দেয়া হচ্ছে। দুইশ বছর সেই গোলামির জোয়াল আমাদের পেতে নিতে হয়েছে। আমরা কি স্বাধীন হয়েছি এরপরে? আমরা একটা ভূখণ্ড পেয়েছি এটা ঠিক। আমরা একটা পতাকা পেয়েছি ঠিক, কিন্তু সেই গোলামিটা আমাদের মাথার মধ্যে, মনের মধ্যে বহন করে চলেছি। আমরা আমাদের ধর্মের দিকে তাকাতে ভুলে গেছি। আমরা ধর্মের শিক্ষা ভুলে গিয়েছি। আমাদের নবী-রসুলদের শিক্ষা ভুলে গিয়েছি। আমরা আমাদের মনে করি যে আমরা মুসলমান হয়ে গেছি, কিন্তু প্রকৃত মুসলমান আমি খুব কম দেখি আশেপাশে। যারা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনা, যারা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনা, যারা জালিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনা, তারা নিজেদের মুসলমান বলতে পারেনা (এই সময় অনুষ্ঠানে সমবেতরা ‘ঠিক’ ‘ঠিক’ বলে চিৎকার করে উঠে)। তাহলে এই আমি এখন যে ‘মুসলমান’ কথাটা বললাম, এর মধ্যে কোনো ধর্মীয় তাৎপর্য নাই; এটি একটি ভাবগত, বিপ্লবী তাৎপর্য। আমি লর্ড ক্লাইভের কথা বললাম, কেন? আমাদের জমি নিয়ে চলে গেছে। তারপরে কী করেছিল এই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। আমি ১৭৫১ সালের কথা বলছি। তখন যে কাণ্ড ব্রিটিশরা করেছিল তাকে বলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। কৃষকের কাছ থেকে জমি হরণ করে নিয়ে যায়। আপনারা সেই ইতিহাস ভুলে গিয়েছেন, আমার সামনে অনেক তরুণ বসে আছে, তাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছেনা তারা এই ইতিহাস জানে। আমি যখন এই লন্ডন শহরে হাঁটি, তখন সেই উপনিবেশ আমলের মানুষের রক্ত আমি দেখি। আমার পূর্ব-পুরুষের দীর্ঘশ্বাস শুনেছি আমি। আমার পূর্বপুরুষকে যে অত্যাচার করা হয়েছে, তাদের জমি হরণ করা হয়েছে, আমি পথে পথে সেটি দেখেছি, আমি মুগ্ধ হইনাই। আমি ১৫ বছর ছিলাম বিদেশে, কিন্তু আমি থাকতে পারিনি, আমি দেশে চলে গেছি, কারণ এটা আমার দেশ না। যার দেশ নাই, যে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র কায়েম করতে পারেনা, তার মত মজলুম এই পৃথিবীতে নাই। ফলে আমাদের লড়তে হয়েছে। দুইশ বছর আমাদের পেরিয়ে আসতে হয়েছে। খুব সহজে আমরা আসিনাই। আমরা কীভাবে এসেছিলাম? এই কৃষক লড়াই করেছে। ১৮৫৭ সালে আমাদের সিপাহী বিদ্রোহ, আপনারা ভুলে গেছেন, আপনারা ভুলে গেছেন। সে সিপাহী বিদ্রোহে তারা প্রথম চেষ্টা করেছিলেন এই কলোনিয়াল সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। সেই যুদ্ধে তারা সফল হতে পারেনি, ব্যর্থ হয়েছে। সেই পরাজয়ের পরে পরবর্তীকালে যারা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তারা ছিলেন আলেম-ওলামা। তার পরবর্তীকালে আমরা দেওবন্দের ইতিহাস দেখি, দেওবন্দিরা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আপনারা যারা ঢাকা থেকে এসেছেন, বুড়িগঙ্গা দেখেছেন। বুড়িগঙ্গার তীরে আমগাছ ছিল। সেই আমগাছের ডালে ডালে এই মুসলমান সৈনিকদের, ইমামদের, আলেম-ওলামাদের লাশ ঝুলিয়ে রেখেছিল ফাঁসি দিয়ে। আমার পেছেন সেই ইতিহাস। আমি সেই ইতিহাস দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আপনারা আকাশ থেকে পড়েননি। আপনারা জালিমের বিরুদ্ধে লম্বা লড়াই করে এসেছেন। ইতিহাস যখন আমরা ভুলে যাই, তখন আমরা ভুলে যাই এই মুহূর্তে আমাদের কর্তব্য কী?

যখন ৬ ই এপ্রিল বা ৫ এপ্রিল হেফাজতের আন্দোলনটা হল (কারেকশন করে বলেন ৫ ই মে), দেওবন্দিরা যখন রাস্তায় নেমে এলেন, তখন তাদের রসুলের অপমান করা হয়েছে; গরীব এতিম ছেলে, সারারাত, কিচ্ছু নাই তার, সে একমাত্র রসুলে আশেকান হিসেবে বেঁচে থাকে, আপনি তাও তার কাছ থেকে হরণ করে নিয়ে যেতে চান। তার কিচ্ছু নাই। এরা রাস্তায় নেমে এল। আমরা যারা তাদের পক্ষে কথা বললাম, তখন বলা হল, আমরা রাজাকার, আমরা হেফাজতী, সাম্প্রদায়িক। আমরা সমর্থন করেছি কারণ আমরা দেওবন্দিদের ইতিহাস জানি। আমরা জানি তারা ইতিহাসে এই কাজগুলো সবসময় করেছি। ১৩-দফা দেয়া হয়েছিল, মনে আছে আপনাদের। আমরা বিএনপির নেতাদের বুঝিয়েছি, অন্যান্য লোকদের বুঝিয়েছি, ১৩-দফার মধ্যে কী আছে যে আপনারা মানতে পারেন না।

কেন মিথ্যা কথা বলেন, কেন অপপ্রচার করেন। কোথায় এই ১৩ দফার মধ্যে আছে যে, আমরা মেয়েদের ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখব, মেয়েদের কোনো চাকরি করতে দেয়া হবেনা, গার্মেন্টস বন্ধ করে দেয়া হবে। এগুলো কিছুই ছিলনা, অপপ্রচার চালানো হয়েছে। আমরা বলেছি, আমাদের বন্ধু-বান্ধুব যারা নিজেদের সেকুলার মনে করে, উদার মনে করে, আধুনিক মনে করে, আমরা তাদেরকে বলেছি, তাদেরকে কথা বলতে দিন। আপনারা তো গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, আপনাদের তো স্বাধীনতা আছে, তাদেরকে কথা বলতে দিন। যদি গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে বলুন গ্রহণযোগ্য নয়, কিন্তু কথা বলতে দিবেন না কেন? আপনারা বলছেন যে, ঢাকা শহরের আধুনিক ছেলেরা, যারা এদেরকে শাহবাগি বলে, যারা ফাঁসি ছাড়া আর কিছু বুঝেনা। একটা তরুণ ছেলে এই আধুনিক কালে, তার আধুনিক হওয়া উচিত, না কি? একটা আধুনিক ছেলে, যেখানে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট, সারা দুনিয়াতে,কোনো সভ্য লোক, এটাকে সমর্থন করেনা। এই ছেলে-মেয়েগুলো রাস্তায় নেমে এসে, আর কিছু নাই, ফাঁসি, ফাঁসি ফাঁসি। এটা কী? কী বলবেন এদের সম্পর্কে? এরা কি অসুস্থ? এটা কি প্যাথলজি? তাহলে এই পরিস্থিতির মধ্যে আমরা দেখতেছি, প্রতেক্যেই গিয়া শাহবাগের মঞ্চে উঠার জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে (চলবে)।

লেখকঃ গবেষক, সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :