‘বানের পানিত তলে আচি কেউ ইলিপ দেয় না’

প্রতীক ওমর, বগুড়া
 | প্রকাশিত : ১৬ জুলাই ২০১৭, ০৮:৫৩

বাঁধ থেকে দৃষ্টির সীমানা জুড়ে শুধু পানি আর পানি। দূরে আকাশ আর পানি মিশে আছে। ঘড়ির কাঁটা তখন চারটা ছুঁই ছুঁই। কিন্তু বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেয়া মানুষগুলোর চুলোয় আগুন জ্বলেনি।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে কয়েক শ বন্যার্ত পরিবার। সবার চোখে মুখে ক্লান্তি আর হতাশার ছায়া। চুলোয় আগুন নেই। পাতিলে চাল নেই। শিশু ও বৃদ্ধ মানুষের করুণ চাহনিতে যে কারো চোখ ভিজে যাবে।

নিরুপায় মানুষগুলো বাড়িঘর ফেলে এই বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে বাঁচার জন্য। বানের পানিতে তলিয়েছে তাদের ঘর। কিন্তু এখানে এসে আশ্রয় মিললেও খাওয়ার সংস্থান হচ্ছে না। চারপাশ পানিতে ডুবে যাওয়ায় কোনো কাজকর্মও নেই। কোনো ত্রাণ পায়নি কোথাও থেকে।

বানভাসী এসব মানুষের একজন সাহেব আলী চাচা। তিনি বলেন, ‘তোমরাই কও দেখি, হামরা এখন কুনটি যামু বাপু। বানের পানিত তলে আচি, কেউ ইলিপ দিবের আসে না।’

তাজো বেওয়া শত বছরের সীমা অতিক্রম করেছেন। গায়ে-গতরে জিয়ে থাকা কিঞ্চিত শক্তিতে কোনোমতে চলাফেরা করতে পারেন। এর বাইরে তেমন কিছু করার শক্তিসামর্থ্য নেই তার। চল্লিশ বছর আগে যখন তার বয়স ষাট ছিল, সেসময় স্বামীকে হারান। এরপর একে একে কাছের অনেক স্বজন, নিজের সন্তানকেও হরিয়ে ফেলেন তিনি। বর্তমানে ছোট ছেলে ছাড়া তার আর কেউ নেই। ছেলে বিশা প্রামাণিকের সংসারেই এখন তার জীবন কাটছে। সারিয়াকান্দির কুতুবপুর এলাকায় ঘরের ভেতর তিন সপ্তাহ আগে পানি ঢুকেছে। এখন তার ঘরের মধ্যে বুক পরিমাণ পানি। ছেলের সঙ্গে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ছোট্ট একটি ঘরে এখন তার বাস। কিন্তু খাবার জোটে না কোনো। মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা।

উপজেলার মথুরাপাড়া বাজারের দক্ষিণ থেকে শুরু করে কামালপুরের দড়িপাড়া পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ছোট ছোট ঘর তুলে আশ্রয় নিয়েছে তাজো বেওয়াদের মত কয়েক শ বানভাসী পরিবার। ওই পরিবারগুলোতে এখন খাবার, বিশুদ্ধ পানির পাশাপাশি জ্বালানির সংকট চলছে। পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া, আমাশয়, পাঁচরায় আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। নৌকাযোগে অনেক দূর থেকে টিউবওয়েলের পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে তাদের। খাবার স্যালাইন, জরুরি ওষুধ হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না। গবাদিপশুর খাদ্য সংকটও দেখা দিয়েছে এসব এলাকায়।

এখানে বসবাসকারী পরিবারের প্রধানদের অধিকাংশ কৃষক। তারা অন্যের জমিতে কাজ করে উপার্জন করে সংসার চালায়। পাশাপাশি পশুপালন করে থাকে। বন্যায় ফসলের জমি পানির নিচে ডুুবে যাওয়ায় তারা এখন বেকার। কাজ না থাকায় অর্থ সংকটের করুণ দশাও এখন তাদের সামনে হাজির হয়েছে। দুমুঠো ভাত এক বেলা জুটছে তো দুই বেলা কাটছে না খেয়ে। তাজো বেওয়াদের অসময়ে কেউ পাশে এসে দাঁড়ায়নি। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘ভোটের মদে হাংগেরে কাছোত কত নোক আসে, বানের পানিত তলে যাচ্চি এখন কেউ দেকপারো আসে না।’

বগুড়ার বন্যাদুর্গত ইউনিয়নগুলো হলো সারিয়াকান্দি উপজেলার কুতুবপুর, কামালপুর, চন্দনবাইশা ও কর্ণিবাড়ি; সোনাতলা উপজেলার মধুপুর, তেকানি চুকাইনগর, পাকুল্লা; ধুনটের ভান্ডারবাড়ী, গোসাইবাড়ী ইউনিয়ন।

পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন করে নি¤œাঞ্চলগুলোর লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এতে গৃহহারার সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। ঘরে পানি ঢোকায় দুর্গত পরিবারগুলো বাঁধের উঁচু স্থানে আশ্রয়ের জন্য ছুটছে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী বগুড়ার তিন উপজেলায় ১৪ জুলাই পর্যন্ত ১৭ হাজার ৪০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা ২৫ হাজার পরিবার ছাড়িয়ে যাবে। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের মধ্যে মাত্র হাজার পাঁচেক পরিবারকে সামান্য ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে লোকালয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করায় বিশুদ্ধ পানি, খাবার এবং জ্বালনি সংকটে পড়েছে সেখানকার মানুষ।

বগুড়া ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা শাহারুল ইসলাম মো. আবু হেনা জানান, বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা এবং ধুনট উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীর পানি বেড়েই চলেছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে তিন উপজেলার ১৭ হাজার ৪০ পরিবার। দিন দিন পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা বেড়েই চলছে।

তিনি আরো জানান, ইতোমধ্যে এসব বানভাসী মানুষের মধ্যে সারিয়াকান্দি আশ্রয় প্রকল্পে ঠাঁই পেয়েছে ৭৬৫ পরিবার এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে ৩৫৫ পরিবার। তাদের মাধ্যে পর্যায়ক্রমে ত্রাণসামগ্রী এবং নগদ অর্থ বিতরণ করা হবে।

বগুড়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নূরে আলাম সিদ্দীকী জানান, ইতোমধ্যে ত্রাণ হিসেবে সাড়ে ৪০০ মেট্রিক টন জিআর চাল, ১২ লাখ টাকা এবং ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২৮৫ মেট্রিক টন জিআর চাল, নগদ সাড়ে তিন লাখ টাকা এবং দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বন্যাদুর্গত উপজেলাগুলোতে পাঠানো হয়েছে। একই সাথে ৭৮০০টি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

(ঢাকাটাইমস/১৬জুলাই/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :