রং সাইড সবার জন্যই রং

প্রভাষ আমিন
 | প্রকাশিত : ১৬ জুলাই ২০১৭, ১৩:০৬

বাংলাদেশে আমরা দায়িত্ব আর ক্ষমতার পার্থক্যটা বুঝতে পারি না। দায়িত্ব আর ক্ষমতাকে গুলিয়ে ফেলি। দায়িত্বকেই মনে করি ক্ষমতা। যে যত বেশি দাপট দেখাতে পারবে, সে যেন তত বেশি ক্ষমতাবান। আর দায়িত্বকে আমরা চিরস্থায়ী মনে করি। ঢাকার রাজপথে প্রতিদিন আমরা দায়িত্ববানদের ক্ষমতার দাপট দেখি। এই ক্ষমতাবান রুই-কাতলাদের দাপটে আমরা চুনোপুটিরা প্রতিদিন পিষ্ট হই।

ঢাকায় জায়গার তুলনায় মানুষ বেশি। প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তা কম। তাই যানজট আমাদের নিত্যদিনের ভোগান্তি। প্রতিদিন রাজপথে হারিয়ে যায় আমাদের হাজার হাজার কর্মঘণ্টা। কিন্তু সবার কর্মঘণ্টা হারায় না। চুনোপুটিরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে থাকে। আর দাপুটে ক্ষমতাবানরা শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে ধুলা উড়িয়ে, পানি ছিটিয়ে উল্টো পথে চলে যান।

উল্টোপথে গাড়ি চালানোটা বাংলাদেশে ক্ষমতাবানদের একটা সূচক। যে যত বেশি উল্টোপথে যেতে পারেন, তার ক্ষমতা যেন তত বেশি। বিশ্বের সব বড় শহরে ট্রাফিক পুলিশের ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। গাড়িচালকরা ট্রাফিক পুলিশকে যমের মতো ভয় পায়। বেশি দূর যেতে হবে না, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেও সবাই ট্রাফিক আইন মেনে চলেন। মিলিটারি পুলিশকে বাংলাদেশের গাড়িচালকরাও যমের মতো ভয় পায়। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে দারুণ সমাজতন্ত্র, সবাই সমান।

ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়েই শুরু হয় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতা। যার যত ক্ষমতা, তিনি তত বেশি ভাঙেন। ঢাকার ট্রাফিক পুলিশের চেয়ে অসহায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমি আর কোথাও দেখিনি। কোটি টাকা দামের গাড়ি তাদের সামনে দিয়ে হুঁশ করে উল্টোপথে চলে যান। সেই গাড়ি আটকানো তো দূরের কথা আটকানোর কথা ভাবেনও না তিনি। আমি মাঝেমধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশের সেই অসহায় চেহারা দেখি, আমার খুব মায়া লাগে।

অবশ্য সেই চেহারায় শুধু অসহায়ত্ব নয়, থাকে চাপা ক্রোধও। সেই ট্রাফিক পুলিশ তার সেই অবদমিত ক্রোধের প্রকাশ ঘটান আমাদের মতো আমজনতার ওপর। ক্ষমতাবানদের গাড়ি আটকানোর ক্ষমতা না থাকলেও ট্রাফিক পুলিশকে আবার মামলার টার্গেট দেওয়া থাকে। তাই আমজনতার গাড়ি ধরে ধরে মামলা দেওয়া হয়; অপরাধ থাকুক আর নাই থাকুক। আকাশের যত তারা পুলিশের তত ধারা। সুযোগ পেলেই তারা নিরীহ মানুষের জন্য সেই ধারার থলে খুলে মাঠে নামেন। যেমন একবার আমার গাড়ির বিরুদ্ধে আর কোনো অপরাধ না পেয়ে মামলা করা হয়েছিল এক লাইনে নম্বর প্লেট লেখার অপরাধে। যদিও সে অপরাধটি মিৎসুবিশি কোম্পানির, আমার না। আর ট্রাফিক পুলিশের সব হম্বিতম্বি রিকশাওয়ালা, ভ্যানচালক, সিএনজিচালকদের ওপর।

ঢাকায় উল্টোপথে সবচেয়ে বেশি গাড়ি কোন এলাকায় চলে জানেন? কাকরাইল মসজিদের উল্টোদিকে প্রধান বিচারপতির বাসার সামনে। সত্যি প্রধান বিচারপতির বাসার সামনে প্রতিদিন আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানো হয়। দেখান কারা? মন্ত্রিসভার সদস্য, বিচারপতি, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। কয়েকদিন আগে উল্টোপথে আসা এক বিচারপতির গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মরতে বসেছিলেন এক মোটরসাইকেল চালক।

ঢাকার রাস্তায় দুই ধরনের গাড়ি উল্টোপথে যেতে দেখলে আমার গ্লানি বোধ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস এবং সংবাদপত্র লেখা কোনো গাড়ি। প্রতিবার মনে হয়, অপরাধটা বুঝি আমিই করছি। নিজে পড়েছি বলে নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সবচেয়ে প্রাগ্রসর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মুক্তচিন্তা বিকাশের সবচেয়ে বড় স্থান। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনÑদেশের সব গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন মাস্তানের মতো উল্টোপথে দোতলা বাস চালিয়ে দেয়, লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যায়।

তাদের যুক্তি উল্টোপথে না গেলে তারা ক্লাস বা পরীক্ষা মিস করবে। এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। ঢাকা শহরে ক্লাস বা পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সময় হাতে নিয়েই আপনাকে বাসা থেকে বেরুতে হবে। এই যুক্তিটা আরো ধোপে টেকে না; কারণ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় নয়, ফেরার সময়ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস উল্টোপথেই চলে।

রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স, দায়িত্ব পালনকালে প্রয়োজনে পুলিশের গাড়ি, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, কখনো কখনো সাংবাদিকদের বহনকারী গাড়িও উল্টোপথে যেতে পারে। কিন্তু কোনো ক্লিনিক যদি তাদের ডাক্তারদের আনা-নেয়ার কাজে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করে। সেই অ্যাম্বুলেন্স নিশ্চয়ই উল্টোপথে যাওয়ার প্রাধিকার পাবে না, পাওয়া উচিতও নয়। জরুরি প্রয়োজনে পুলিশের গাড়ি উল্টোপথে যেতে পারে। কিন্তু কোনো পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী যখন উল্টোপথে শপিং করতে যান, তার জবাব কে দেবে? অতি জরুরি প্রয়োজনে সাংবাদিকরাও উল্টোপথে যেতে পারেন। তবে সেই প্রয়োজনটা হতে হবে সত্যিই অতি জরুরি।

কোথাও আগুন লাগলে বা দুর্ঘটনা হলে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছতে সাংবাদিকরা কালেভদ্রে উল্টোপথ ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু যখন পূর্ব নির্ধারিত অ্যাসাইনমেন্টে যেতে বা অফিসে বা বাসায় যেতে বা শপিংয়ে যেতেও সাংবাদিকরা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে উল্টোপথে যান বা যেতে চান, তা অন্যায়, বেআইনি। ঢাকা শহরে সবাইকে পর্যাপ্ত সময় হাতে নিয়েই বের হতে হবে। এখানে কোনো অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়। মন্ত্রী, এমপি, বিচারপতি, পুলিশ, সাংবাদিকদের সময়ের দাম আছে, সাধারণ মানুষের বুঝি নেই?

রং সাইড দিয়ে গাড়ি চালানো রং, সবার জন্যই রং এবং বেআইনি। ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের বাস উল্টোপথে যাওয়া যেমন বেআইনি, সাংবাদিকের গাড়ি উল্টোপথে যাওয়াও বেআইনি। পুলিশ, মন্ত্রী, এমপি, আইনজীবী এমনকি বিচারপতির গাড়ি উল্টোদিকে যাওয়াও বেআইনি। অশিক্ষিত মানুষ আইন ভাঙলে বুঝতাম তারা আইন জানে না। কিন্তু যারা আইন বানায়, প্রয়োগ করে, বিচার করে; তারাই আইন ভাঙে সবচেয়ে বেশি। এর বিচার কে করবে?

প্রভাষ আমিন: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :