কে এই কামাল আহমেদ মজুমদার?

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু
| আপডেট : ১৭ জুলাই ২০১৭, ১১:০৯ | প্রকাশিত : ১৭ জুলাই ২০১৭, ০৮:৩৬
নিচে বল সামনে নিয়ে বসা অবস্থায় শেখ কামাল, ডান পাশে কামাল মজুমদার ও সবশেষে সৈয়দ নুরুল ইসলামl ছবিতে পেছনে সেন্ডো গেঞ্জি গায়ে দাঁড়িয়ে লেখক।

১৯৭৪ সালl আমি তখন ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ কার্যকরী পরিষদে সমাজকল্যাণ সম্পাদকl দলের সভাপতি ছিলেন সৈয়দ নুরুল ইসলাম। মহানগর কমিটিতে থাকার কারণে ঢাকা শহরের বিভিন্ন কলেজ ও আঞ্চলিক শাখার সভা/সম্মেলনে আমাদের যোগদান করতে হতো। কামাল মজুমদার এই সময় ছিলেন ঢাকার কবি নজরুল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি। সেই সূত্রে তার সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠে।

তিনি তখন থাকতেন পুরান ঢাকার বনগ্রাম এলাকায় জগন্নাথ কলেজ, শহীদ সরোয়ার্দী কলেজ কিংবা ওই এলাকায় সাংগঠনিক কাজে সৈয়দ নুরুল ইসলামের সাথে যখন যেতাম তখন প্রায়ই দেখা হতো, কথা হতো ও সাথে ভাবির হাতের রান্না খাওয়ার সৌভাগ্যও হয়েছিল কয়েকবার।

নুরু ভাইও কামাল মুজুমদারকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। এভাবেই ধীরে ধীরে কামাল মুজমদারের সাথে আমাদের একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে। শুধু আমরা দুইজনই নয় সাথে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক আব্দুর রউফ শিকদার (বর্তমানে ঢাকায় আওয়ামী লীগের আঞ্চলিক নেতা) পাঠাগার সম্পাদক মোহাম্মদ ইউনুসও (বর্তমানে ঢাকার গুলশানে একটি মোটর ওয়ার্কশপের মালিক) ছিলেন আমাদের সাথে।

ঢাকা শহর ছাত্রলীগের উপর পরোক্ষভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল ভাইয়ের একটা প্রভাব ছিল। তিনি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি সৈয়দ নুরুল ইসলাম নুরু ভাইয়ের সাথে সবসময় পরামর্শ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিকল্পনার সিদ্ধান্ত নিতেন।

এই কারণে ঐ সময় সৈয়দ নুরুল ইসলাম ভাইয়ের নেতৃত্বে রউফ ইউনুস ও আমি কামাল ভাইয়ের অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তি হিসেবে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগে সুপরিচিত ছিলাম। আমাদের এই চারজনের সাথে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের অধীনে বিভিন্ন কলেজ ও আঞ্চলিক শাখাগুলো থেকে আগত ছাত্রলীগ নেতাদের সাথে একটা অন্তরঙ্গতা ছিল।

কামাল মজুমদার ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। নুরু ভাইয়ের মাধ্যমে শেখ কামাল ভাইয়ের সাথেও কামাল মজুমদারের একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। আমাদের মতো কামাল মজুমদারকেও কামাল ভাই নিজের একজন কাছের মানুষ হিসেবে কাছে টেনে নিয়েছিলেন।

পঁচাত্তরের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করলে নুতন করে ছাত্রলীগকেও পুনর্গঠিত করা হয়l এই সময় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় জাতীয় ছাত্রলীগ। এই নুতন জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক শেখ শহিদুল ইসলাম (বর্তমানে মহাসচিব জে পি) ও যুগ্ন আহবায়ক ছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম (বর্তমানে সভাপতি কমিউনিস্ট পার্টি)।

একইভাবে জাতীয় ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর শাখা কমিটির নামও ঘোষণা করা হয়l ১৩ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটিতে আহবায়ক সৈয়দ নুরুল ইসলাম (পঁচাত্তরের পরবর্তীতে কাদের সিদ্দিকীর হাতে তিনি নিহত হন বলে অভিযোগ রয়েছে) ও যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন কামরুল ইসলাম খান (বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী)। আমি ও রউফ এই আহ্বায়ক কমিটিতে সদস্য ছিলাম।

আমাদের সাথে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে আগত খন্দকার শওকত জুলিয়াস (সাবেক সচিব) ছিলেন এই কমিটিতে। আমাদের তিনজনের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ থেকে সাভার পর্যন্ত যত কলেজ রয়েছে সেখানে জাতীয় ছাত্রলীগের সংগঠনকে তদারকি করা।

শুধু তাই নয়, এইসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেও মহানগরের অধীনে নিয়ে আসা হয়। ফলে আমাদের কাজের পরিধি বৃদ্ধি পায়। কামাল মজুমদার তখনও কবি নজরুল কলেজের সক্রিয় ছাত্র নেতা। তবে তার দায়িত্ব শুধুমাত্র কবি নজরুল কলেজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে আসে পাশের কলেজগুলো দেখাশোনার দায়িত্বও তিনি লাভ করেন।

খুব সম্ভব পঁচাত্তরের মে অথবা জুন মাসের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের মাঠে জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি ও ঢাকা মহানগর কমিটির মধ্যে এক প্রীতি ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হয়। আজকের জাতীয় রাজনীতিতে এদের অনেকেই সক্রিয় এখনl শেখ কামাল ভাই কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে আমাদের বিপক্ষে এই খেলায় যোগদান করেছিলেন।

কামাল মজুমদার আমাদের সাথে এই প্রীতি ফুটবল খেলায় মহানগর শাখার পক্ষে অংশগ্রহণ করেছিলেন। খেলার ফলাফলের কথা আমার এখন আর মনে নেই। তবে খেলা শেষে আমরা একত্রিতভাবে কয়েকটি ছবি তুলেছিলাম। সেই ছবি এখনও আমার কাছে কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে।

পঁচাত্তরের ১৪ আগস্ট বৃস্পতিবার রাত আনুমানিক নয়টায় সেগুনবাগিচায় ঢাকা মহানগর জাতীয় ছাত্রলীগের ছাদের উপরে জগন্নাথ কলেজের ভি পি জিন্না ভাইয়ের আকস্মিক ইন্তেকালে তার সম্মানে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। শেখ কামাল ভাই ছিলেন এই সভার প্রধান বক্তা। ছাত্রনেতা কামাল মজুমদার তার দলবল নিয়ে এই সভায় যোগদান করেছিলেন।

পরদিন ভোরে ঘটে যায় ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে তার ব্যক্তিগত বাসভবনে সপরিবারে হত্যা করা হয়। মাত্র সাত ঘণ্টা পূর্বে যে কামাল ভাই আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে শোক সভায় ভাষণ দিয়েছিলেন তাকেও এই মর্মান্তিক আক্রমণের শিকার হতে হলো। এর পর থেকেই শুরু হয় ঢাকায় আমাদের গোপনীয় সাংগঠনিক কার্যকলাপ।

ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের অনেকেই এই সময় কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ময়মনসিংহ ও নেত্রকোণার পাহাড়ি অঞ্চলে সশস্ত্র প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করলেও আমরা তখন ঢাকায় অবস্থান করে গোপনীয় আন্দোলনের কাজে নিজেদের সক্রিয় রেখেছিলাম। কামাল মজুমদার এর কোনো ব্যতিক্রম ছিলেন না। আমরা সকলেই একসাথে মিলে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগকে পুনরায় সংগঠিত করার জন্য কাজ করেছি।

পঁচাত্তরের শেষ দিকের কথা। এর মাঝে একদিন ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মমতাজ হোসেন ভাই আমাকে বললেন হাই কমান্ড থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে কামাল মজুমদারকে সভাপতি ও আমাকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করার জন্য। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের অনুগত বাহিনীর চোখের আড়ালে তখন সাংগঠনিক কাজ করা খুব সহজ ছিল না। একদিকে পুলিশি হয়রানি অন্যদিকে দলীয় কোন্দল এই সময় আমাকে এক বিরাট হতাশার মধ্যে ফেলে দেয়। শেষ পর্যন্ত কাউকে না জানিয়ে অনেকটা স্বার্থপরের মতো বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলামl পরবর্তীতে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সম্মেলনে কামাল আহমেদ মজুমদারকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল।

কামাল আহমেদ মজুমদার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একজন পরীক্ষিত নেতা। জিয়া এরশাদ থেকে বার বার আঘাত আসা সত্ত্বেও তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে কখনো পিছ টান দেননি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এই সৈনিক বৃহত্তম মিরপুরে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বর্তমানে এই মিরপুরকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যার একটি আসনের এমপি কামাল আহমেদ মজুমদার। কথা উঠেছে আসছে নির্বাচনে তার নমিনেশন পাওয়া নিয়ে।

এ প্রসঙ্গে তার বার্ধক্যের কথাও উঠে এসেছেl এছাড়া সাংবাদিকের সাথে দুর্ব্যবহার, মনিপুর স্কুলে ভর্তি নিয়ে চাঁদাবাজি, এলাকায় সন্ত্রাসী সহ কয়েকটি বিষয় নিয়ে মিডিয়ায় তার বিপক্ষে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছেl তবে আসল ও বাস্তব কি তার উত্তর একমাত্র কামাল আহমেদ মজুমদারই দিতে পারবেনl কিংবা দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার গোয়েন্দা রিপোর্টের মধ্যে দিয়ে জানার সুযোগ রয়েছেl

সত্যি সত্যি যদি তিনি কোনো অন্যায় করে থাকেন তাহলে অবশ্যই তার নমিনেশন পাওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন আসতে পারে। কিন্তু কোনো কিছু যাচাই বাছাই না করে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের একজন পরীক্ষিত নেতা কামাল আহমেদ মজুমদারকে শুধুমাত্র বার্ধক্যের প্রশ্ন তুলে নমিনেশন পাওয়া থেকে বঞ্চিত করা আদৌ উচিত হবে কি না তা নিয়ে দলের হাই কমান্ড চিন্তা ভাবনা করবেন বলে আমরা আশা করতে পারি।

লেখক- ইলেকটেড ভাইস প্রেসিডেন্ট, ইউনিয়ন অফ সার্ভিস অ্যান্ড কমুনিকেশন এমপ্লইজ (পোস্ট) সাউথ স্টকহলম ব্রাঞ্চ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :