নূর মোহাম্মদ ও রুহুল আমিনে এত মিল!

প্রকাশ | ১৭ জুলাই ২০১৭, ১৩:৩২ | আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৭, ১৫:১৭

আলম রায়হান

বরিশাল পুলিশ কমিশনার এস এম রুহুল আমিন এক বছরের মধ্যে বদলির আদেশ পেয়েছেন জুন মাসের শেষ সপ্তাহে। এতে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। বদলির আদেশ অনুসারে বরিশাল থেকে তার বিদায় নেবার কথা ছিল ৬ জুলাই। এজন্য প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছিলেন পূর্ণ পেশাদার এ পুলিশ কর্মকর্তা। তার এ বদলি নিয়ে বরিশালে নানা রকম প্রশ্ন দেখা দেয়। নগরবাসীর স্বস্তির বিষয়, গত সপ্তাহে এ বদলি আদেশ স্থগিত করা হয়েছে।

পেশাগত কারণে অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়েছে দীর্ঘ সময়ে। বলা যায়, এ সম্পর্ক অনেক সাংবাদিকের চেয়ে একটু বেশিও হতে পারে। কারণ পেশার চার-পাঁচ বছরের মাথায় ক্রাইম রিপোর্টিং-এর দিকে ঝুঁকেছিলাম সাপ্তাহিক সন্দ্বীপে থাকাকালে। এরপর দৈনিক নবঅভিযানে সাব এডিটর হিসেবে শুরু করার মাস কয়েক পর রিপোর্টিংয়ে সংযুক্ত হয়ে রাজনীতি ও সংসদ বিটে কাজ শুরু করি। কিছু দিনের মধ্যে আমিনুল হক ভূইয়ার ‘প্ররোচনায়’ ক্রাইম বিটেও সংযুক্ত হয়েছিলাম।

সে সময় দৈনিক নবঅভিযানের নেপথ্য মালিক ছিলেন জেনারেল মাহমুদুল হাসান; এ বিষয়টি ছিল ওপেনসিক্রেট। তিনি তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কাজেই সহজেই অনুমান করা যায়, এ পত্রিকার ক্রাইম বিটের চিফ আমিনুল হক ভুইয়ার দাপট ও যোগাযোগ কোন মাত্রায় ছিল। এর আগে ডিডেকটিভ নামে পুলিশের একটি পত্রিকার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন সে। সব মিলিয়ে আমিনূল হক ভূইয়া ছিলেন সে সময়ে পাওয়ারফুল তিন/চার জন ক্রাইম রিপোর্টারে একজন। আমি আর গাফফার মাহমুদ ছিলাম তার টিমের সদস্য। ফলে অপরাধ জগতের অনেক অলিগলি সে সময় দেখার সুযোগ হয়েছে কাছ থেকে এবং সম্পর্ক হয়েছে অনেক পুলিশের সঙ্গে। পরবর্তী সময়ে পুলিশের সঙ্গে সম্পর্কের ধারা আরও বেগবান হয়েছে নূর মোহাম্মদ আইজিপি হবার পর। অবশ্য তখন আমি আর ক্রাইম রিপোর্টিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। তবে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত নূর মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছি। পুলিশের পোশাকে তাকে প্রথম দেখেছি যখন তিনি আইজিপির স্টাফ অফিসার। তখন আইজিপি বাংলাদেশ সচিবালয় বসতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে তিনি আমাদের সংগঠন জাসদ ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। এরপর নূর মোহাম্মদ পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী ছাত্র পুলিশ ডিপার্টমেন্টেরও মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন নূর মোহাম্মদ; এর ধারাবাহিকায় তিনি আইজিপি হয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এবং বহাল থেকেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচিত সরকারের আমলেও। পরে তিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে অবসরে গেছেন।

এত সব কথা বলার কারণ হচ্ছে, অতি সম্প্রতি পরিচিত পুলিশ কর্মকর্তা এস এম রুহুল আমিনের সঙ্গে সাবেক পুলিশ প্রধান নূর মোহাম্মদের অনেক কিছু হুবহু মিলে যাওয়া। মাস দুই এক আগে তার কাছে গিয়েছিলাম ব্যক্তিগত প্রয়োজন, সাংবাদিক পরিচয়ের বাইরে; প্রতিকার পেয়েছি আশাতীত। পরে শুনেছি, বরিশালের পুলিশ কমিশনার হিসেবে এটি তার রুটিন কাজ। যেমন রুটিন কাজ করতেন নূর মোহাম্মদ; যা তিনি আইজিপি হওয়ার পরও অব্যাহত রেখেছিলেন। আমি নিজেই দেখেছি, আইজিপি থাকাকালে ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি প্রতিদিন ফরিয়াদীদের সাক্ষাৎ দিতেন। কোনো কোনো দিন এ সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়ে যেত। এরপরও কেউ দেখা না পেয়ে ফিরে যাবার কোনো রেকর্ড নেই। একই অবস্থা বরিশাল পুলিশ কমিশনারের দপ্তরেরও; ভিজিটর ফেরত যাবার রেকর্ড নেই বলে শুনেছি।

নূর মোহাম্মদের সঙ্গে এস এম রুহুল আমিনের আরও মিল আছে। দুজনই ছাত্র হিসেবে এবং ডিপার্টমেন্টে মেধাবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আর লালমনিরহাট জেলার এসপি থাকাকালে নূর মোহাম্মদকে বদলির প্রতিবাদ করেছিল সাধারণ মানুষ; মিছিলও করেছিলো তারা। অপর দিকে খুশি হয়েছিল কিছু অপরাধী। একইভাবে বরিশাল থেকে এস এম রুহুল আমিনের বদলির প্রতিবাদ হয়েছে বরিশালে; পত্রপত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বদলির প্রতিবাদে ঝড় উঠেছে। তার বদলিতে বরিশালবাসী বিস্মিত ও অসন্তষ্ট। কিন্ত খুশি হয়েছে অতি দাপটের কিছু অপরাধী। যাদের মাদক আর নারী ব্যবসাসহ নানার অপরাধের দীর্ঘদিনের সাজনো বাগান তছনছ করে দিয়েছেন এস এম রুহুল আমিন।

২০০৬ সালের ২৬ অক্টোবর গঠিত বরিশাল মেট্রোপলিটান পুলিশের কমিশনার হিসেবে মনিরুজ্জামান থেকে শৈবাল কান্তি চৌধুরীর মেয়াদে নগরবাসী ধরেই নিয়েছিল, নারী-মাদকসহ নানান অপরাধের গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে। আর এ ব্যবসার অনেকটাই প্রোটেকশনে রয়েছেন গুটি কয়েক মালিক-সাংবাদিক; যাদের একজন নারী ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে রটনা আছে। জিয়াউল হক বরিশালের ডিআইজি থাকাকালে এ বিষয়ে সুগন্ধার গেদুচাচার চিঠিতে এ নিয়ে আমি লিখেও ছিলাম। সেই হোটেলের নাম ছিল পর্বতের সঙ্গে মিলিয়ে।

অপরাধের দীর্ঘদিনের ধারাবাহিকতা ভেঙে দিয়ে পুলিশ কমিশনার এস এম রুহুল আমিন অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই প্রমাণ করে দিলেন, চাইলেই অপরাধীদের রাশ টেনে ধরা যায়। এ ব্যাপারে বরিশালে সাংবাদিকদের আইকন সদ্য অকাল প্রয়াত সাংবাদিক লিটন বাশার বহুল প্রচারিত স্থানীয় দৈনিক দখিনের মুখ-এ তার কলামে ২৩ মার্চ লিখেছেন, ‘বর্তমান পুলিশ কমিশনার এস এম রুহুল আমিন যোগদানের পর কোন হাঁকডাক না পিটিয়েই নীরবেই অপরাধ দমনের কাজে হাত দেন।...অপরাধ দমনের কাজটি তিনি শুরু করেছেন নিজ বাহিনী থেকেই।... চৌকশ এ পুলিশ কর্মকর্তা মহানগর পুলিশে যোগদানের পরই নগরীর আবাসিক হোটেল নামের মিনি পতিতালয়গুলোর দেহ ব্যবস্যা বন্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।...আমরা মনে করি, মহানগর পুলিশ কমিশনার এস এম রুহুল আমিন আসল জায়গায়ই হাত দিয়েছেন। মিনি পতিতালয়গুলো বন্ধ করতে পারলেই মহানগরীর অপরাধ প্রবণতাসহ অর্ধেকের বেশি সামাজিক সমস্যা দূর হবে। অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে এই মিনি পতিতালয়গুলো।”দৈনিক দেশ জনপদ-এ মির্জা রিমন লিখেছেন, “জনগণের বন্ধু পুলিশ কমিশনার এস এম রুহুল আমিন।...দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন- পুলিশ কমিশনার এস এম রুহুল আমিন এ নীতি বজায় রেখে বরিশালবাসীকে তাঁর সেবা প্রদান করে গেছেন।”

 এদিকে এস এম রফিকুল ইসলাম তার কলামে লিখেছেন, ‘বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার এস এম রুহুল আমিনের বদলির খবর শুনে অনেকেই আনন্দ-উল্লাস করেছেন; তারা সবাই নগরীর নিষিদ্ধ বাণিজ্য এবং অন্ধকার জগতের বাসিন্দা। তারা কমিশনারের বদলির খবর শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন।’

প্রশ্ন হচ্ছে, বরিশাল নগরীর অপরাধের মাফিয়ারা যে আদেশ শোনার জন্য কান পেতে ছিল সে আদেশ এলো কেন? এক বছরের মধ্যে বরিশাল পুলিশ কমিশনার এস এম রুহুল আমিনকে বদলি হতে হলো কেন? স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের অনৈতিক আদেশ পালন না করায় নূর মোহাম্মদকে বদলি করা হয়েছিল পুলিশ বিভাগের বাইরে। ডিএমপির ডিসি (ইস্ট) থেকে তাকে বদলি করা হয় ঢাকা সিটি করপোরেশনের একটি গুরুত্বহীন প্রকল্পে। যেখানে তার কোনো কাজ ছিল না। এসব স্থানে বদলি হওয়ার কথা পুলিশ অফিসাররা স্বপ্নেও ভাবেন না। আর বরিশালের পুলিশ কমিশনার রুহুল আমিনকেও এমন সংস্থায় বদলি করা হয়েছে যেখানে যাবার কথা ভাবেন না পেশাদার পুলিশ অফিসাররা। নূর মোহাম্মদ বদলী হয়েছিলেন বিএনপির সময় অনেক অঘটনের নায়ক বাবরের রোষানলে পড়ে। বরিশালের মানুষ হিসেবে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, বরিশাল পুলিশ কমিশনার এস এম রুহুল আমিন কার রোষানলে পড়েছেন? এখন তো আর বাবর বা কোনো ভবন নেই! তা হলে কি বরিশালের অপরাধীরা এতোই ক্ষমতাধর যে, তারা পুলিশ কমিশনারকে সরিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে! এ প্রশ্নের সুরাহা হওয়া আশু প্রয়োজন; বর্তমান ও ভবিষ্যত বিবেচনায়।

বরিশাল পুলিশ কমিশনার এস এম রুহুল আমিনের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, তার সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষেই বদলির আদেশ হয়েছিল।

আলম রায়হান: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক