ভূস্বর্গ ভ্রমণ ৫
কি অপরূপ ডাল লেক!
দুই দিনের গুলমার্গ ভ্রমণ শেষে আবারও শ্রীনগরের পথ ধরলাম। গন্তব্য এবার ডাল লেক। কাশ্মিরি লোকজনের পাকিস্তান-প্রেম সম্পর্কে বেশ ধারণা হয়ে গেল। তবে এ কথা সত্য যে, ভারতের নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকতে চায় অনেক কাশ্মিরি। যারা শিক্ষা দীক্ষায় অগ্রসর তারা ভারতের মূলস্রোতে মিশে যেতে চান। ট্যাক্সি করে আবার যখন শ্রীনগরে আসছিলাম, সাচ্চা পাকিস্তানপ্রেমী এক ট্যাক্সিওয়ালাকে পেলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কোথা থেকে এসেছেন?’
বললাম, ‘বাংলাদেশ’।
‘ওহ হো, আপনারা আগে পাকিস্তানের সাথে ছিলেন না? ইন্ডিয়া দুশমনি করে দুই পাকিস্তানকে আলাদা করে রেখেছে। তবে, একদিন না একদিন আবার দুই পাকিস্তান এক হবে’-বললেন ট্যাক্সিওয়ালা।
আমি বললাম, ‘তাই নাকি?’
বললাম, ‘পাকিস্তান তো এবার আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জিতেছে। জানেন নাকি?’।
উল্লাসে ফেটে পড়লেন ট্যাক্সিওয়ালা। বললেন, ‘ইসকে ওয়াজায় সে শ্রীনগর মে বহত জশন হুয়া থা (এ কারণেই তো শ্রীনগরে অনেক বড় মিছিল হয়েছে)’।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনিও ছিলেন নাকি?’।
‘ছিলাম মানে? বহু পটকা ফুটিয়েছি। কোহলি বান্দরটাকে আচ্ছামতো ধোলাই দিয়েছে পাকিস্তান’।
ট্যাক্সিওয়ালার সাথে পুরা রাস্তা জুড়েই বিভিন্ন আলাপ আলোচনা করে ডাল লেকে এসে উপস্থিত হলাম।
ঝিলম নদীর দুই ধারে
কাশ্মির উপত্যকার প্রাণকেন্দ্র শ্রীনগর। ঝিলম নদীর দুই ধারে বিস্তৃত এই শহরের উচ্চতা ১৭৩০ মিটার। সৌন্দর্য বাড়িয়েছে ডাল ও নাগিন লেক, সঙ্গে চিনার গাছ। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে এখানে এসেছিলেন মৌর্য স¤্রাট অশোক। সাথে ছিলেন কন্যা চারুমতী। ডাল লেকের তীরে নিসর্গ প্রকৃতির অপরুপ শোভা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন চারুমতী। কন্যার ইচ্ছায় এখানে বৌদ্ধ বিহার গড়ে তোলেন স¤্রাট। অপুর্ব প্রাকৃতিক শোভার জন্য নাম দেন শ্রীনগর।
শ্রীনগরে এসেছিলেন হিউয়েন সাং। আকবরের সভাকবি আবুল ফজলের বিবরণীতেও শ্রীনগর শহরের বর্ণনা আছে। শ্রীনগরের প্রধান সৌন্দর্য তার লেক ও বাগান। তবে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ডাল লেক। এই লেককে ঘিরেই গড়ে উঠেছে শ্রীনগরের পর্যটন। গাগরিবাল, লাকুত ডাল, বড়া লেক-এই তিন জলাধার নিয়েই গড়ে উঠেছে ছয় কিলোমিটার লম্বা ও তিন কিলোমিটার চওড়া ডাল লেক। লেকের ধারে উইলো গাছের সারি, মাঝে বিখ্যাত চিনার গাছ। স্বচ্ছ জলে শ্বেতশুভ্র শৃঙ্গের প্রতিচ্ছবি। ডাল লেকে বিচরণ করার জন্য আছে নৌকা, যেগুলোকে বলা হয় শিকারা। লেকের মাঝে হারিয়ে যায় মন।
ডালের উত্তর দিকে শঙ্করাচার্য, পুবে হরি পর্বত। ডাল লেকে শিকারায় চড়ে শ্রীনগর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অসাধারণ। মোঘল স¤্রাটেরা যখন এখানে এসেছেন, নিজেদের কল্পনার রঙে রঙ মিশিয়ে লেকের পাড়ে গড়ে তুলেছেন একের পর এক উদ্যান।
শ্রীনগরের লেকগুলোর অন্যতম আকর্ষণ হাউসবোট। হাউসবোটে অত্যন্ত সস্তায় আরাম করে থাকা যায়। হাউসবোটে সব রকমের সুযোগ-সুবিধা আছে। শোওয়ার ঘর, বসার ঘর, বারান্দা, খাওয়ার ঘর, বাথরুম-সব সুবিধাই আছে। প্রতিদিনের জন্য ১২০০ টাকা দিয়ে আমরা খুব চমৎকার একটা হাউসবোট ভাড়া নিলাম। হাউসবোটের মালিক রফিক ভাই ডাল লেকের পাড়েই দাঁড়িয়ে ছিলেন। ট্যাক্সি থেকে ডাল লেকের গেইট নম্বর- ৬ এ নামতেই ঝাঁপিয়ে পড়লো আমাদের উপর হাউসবোটের লোকজন। কে কার হাউসবোটে আমাদের নিয়ে যাবে-এ নিয়ে ব্যাপক শোরগোল। তাদের মধ্যে রফিক ভাইকে ভালো লাগলো। তিনি প্রথমেই আমাদের কাছে চমৎকার ইংরেজিতে বললেন, ‘আমার নাম রফিক, বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেট খেলোয়াড়।’
খুব হাসিখুশি মানুষ রফিক ভাই। শিকারা দিয়ে তার হাউসবোটে গেলাম। গেট থেকে একটু দূরে হাউসবোট। হাউসবোটে যাওয়ার পরেই মন ভালো হয়ে গেলো। কতক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনা করলাম একদিনের জন্য। আজ সারাদিন শুধু শ্রীনগর শহরের সবকিছু দেখবো। রফিক ভাই সব ম্যানেজ করলো। তার আগে পুরো ডাল লেক নৌকা দিয়ে ঘোরার জন্য শিকারা ট্রিপ।
শিকারার মালিক শরীফ ভাই অত্যন্ত দিলদরিয়া হাসিখুশি মানুষ। ডাল লেক চারপাশে প্রদক্ষিণ করার ভ্রমণ শুরু হলো। ঠিক সেই মুহূর্তে এক ফটোগ্রাফার এসে হাজির। আবদার জানালো-কাশ্মিরি সাজে আপনাদের কিছু ছবি তুলতে চাই। এমন জোরাজোরি শুরু করলো যে-না করার কোনো উপায় থাকলো না। কাশ্মিরি পোশাক আর ফুলের ডালা তার নৌকাতেই আছে। ট্যুরিস্টদের কাছে টাকা খসানোর হাজারটা উপায় কাশ্মিরিদের জানা আছে। আমরা হাসিমুখেই কাশ্মিরি সাজে বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম।
শিকারা দিয়ে ঘুরতে থাকলাম ডাল লেক জুড়ে। লেক তো নয়, যেন ভাসমান বাসস্থান। বিভিন্ন দোকান, বাড়িঘর ইত্যাদির ফাঁক দিয়ে শিকারা চলছে। কিশোরগঞ্জ জেলার হাওরের সৌন্দর্যের কথা আমার মনে পড়ল। আজ থেকে ১৩ বছর আগে কিশোরগঞ্জ হাওর এলাকায় একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম। অষ্টগ্রাম আর মিঠামইন অঞ্চলে বর্ষার সময় হাওর অপূর্ব রুপ ধারণ করে। ডাল লেক বদ্ধ জলাশয়, কিন্তুু হাওড় উদ্দাম সৌন্দর্যের আঁধার। আমার মনে হয় হাওড় অঞ্চল একদিন বাংলাদেশের অন্যতম ভ্রমণপ্রিয় জায়গা হিসেবে পরিগণিত হবে। যাই হোক, দুই ঘন্টায় পুরো ডাল লেক এলাকা ঘুরে এবার মোঘলদের বাগানগুলি দেখার জন্য ট্যাক্সি নিলাম দুপুর দুইটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত।
মোঘল গার্ডেনে ঘোরাঘোরি
প্রথমেই গেলাম ঝর্ণাকে ঘিরে ধাপে ধাপে গড়ে উঠা সুবিশাল উদ্যান চশমাশাহী উদ্যান। স¤্রাট জাহাঙ্গীর কাজ শুরু করলেও ১৬৩২ সালে স¤্রাট শাহজাহান সম্পূর্ণ করেন এই বাগান। মোঘল গার্ডেনের মধ্যে এটা সবচেয়ে সেরা। এখানে রয়েছে চিনার, ঝাউ আর হরেক রকমের ফুল গাছ। রংবেরংয়ের ফুল দেখে একেবারে অভিভূত হয়ে পড়লাম।
চশমাশাহী থেকে চার কিলোমিটার দূরত্বে ডাল লেকের পাড়ে পাহাড়ের ঢালে ১০ ধাপে গড়ে উঠেছে নিশাতবাগ। মোঘল আমলের বাড়িঘর, জাফরির কাজ দেখার মতো। আপেল, খোবানি, নানা ধরনের গোলাপ, ঝাউ আর চিনার গাছ দিয়ে ছবির মতো করে সাজানো উদ্যান। স¤্রাজ্ঞী নূরজাহানের ভাই আসফ খান ১৬৩৩ সালে এই উদ্যানটি তৈরি করেছিলেন।
নিশাতবাগ থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ডালের তীরে শালিমার উদ্যান। স¤্রাট জাহাঙ্গীর তার বেগম নূরজাহানের জন্য ১৬১৯ সালে এই উদ্যানটি তৈরি করেছিলেন। শালিমার বাগ মোঘল উদ্যানগুলোর মাঝে সবচেয়ে বড়। ঈদের ছুটির কারণে কাশ্মিরের স্থানীয় লোকজনের ঢল নেমেছে শালিমারে। শালিমার দেখে মনে হচ্ছে এক টুকরো বেহেশত যেন তার সৌন্দর্য নিয়ে এখানে নেমেছে। অসংখ্য ফুল আর গাছের শোভায় অপরূপ। উদ্যানে রয়েছে সারি সারি ঝর্ণা।
ডাল লেকের পশ্চিমে হজরতবাল গ্রামে মুসলিমদের পবিত্রতম স্থান হজরতবাল মসজিদ। মসজিদের মধ্যে কাচের আধারে রয়েছে হযরত মুহম্মদের (সা:) একটি কেশ। মুসলিমদের কাছে খুবই পবিত্র এই কেশ। অমুসলিমদের এই কেশ দর্শন নিষিদ্ধ। শুক্রবারে জুম্মার নামাজে বহু লোক এখানে নামাজ পড়তে আসে।
মসজিদের কাছেই ইউনিভার্সিটি অব কাশ্মির। প্রধান ফটকের নাম মাওলানা রুমি গেট। বন্ধ থাকায় আমরা ইউনিভার্সিটির ভিতরে প্রবেশ করতে পারিনি।
ঘুরতে ঘুরতে রাত আটটা বেজে গেলো। ক্লান্ত শরীরে আমরা ডাল লেকের দিকে ছুটলাম। হাউসবোটে প্রবেশ করে সেদিনের মতো আমাদের ভ্রমণ শেষ করলাম। আগামীকাল যাব পাহালগাঁম। কাশ্মির যদি হয় পৃথিবীর স্বর্গ, তাহলে কাশ্মীরের স্বর্গ হচ্ছে পাহালগাঁম। সে গল্প পরের পর্বের জন্য থাকল।
চলবে...