অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের কথা-৩৩

আলম রায়হান
 | প্রকাশিত : ১৯ জুলাই ২০১৭, ১৬:৪৫

বরিশালে ইউনুস খানের মামলার ধকল কাটতে না কাটতেই চট্টগ্রামের পটিয়ায় মামলা হলো। এবার বিবাদী করা হলো কেবল সৈয়দ মোয়াজ্জেমকে; তাকে আদালতে হাজির হতে হবে। কিন্তু তিনি বালখিল্য এক আবদার করে বসলেন। আমাকে বললেন, মামলায় তার পক্ষে প্রক্সি দিতে। প্রক্সি দেয়া অনেক গল্পও করলেন। যা মোটেই সত্য বলে মনে হয়নি আমার; পছন্দ হওয়া তো অনেক দূরের বিষয়। তবু মালিকের কথা আমাকে রাখতে হয়েছে।

নির্ধারিত দিনে পটিয়ার উপজেলা আদালতে আসামি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আমার রক্ত হিম হওয়ার মতো অবস্থা হলো। কারণ বিচারকের আসনে বসা ম্যাজিস্ট্রেট আমার পূর্ব পরিচিত। সচিবালয়ে তার ডেক্সে একাধিকবার গেছি; এজলাসের ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে আমার নামেই চেনেন। কিন্তু আমি আদালতে হাজির হয়েছি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হিসেবে। কে জানে, কোনো কারণে সে আমার ওপর অসন্তষ্ট কি না। পূর্ব অসন্তষ্টি না থাকলেও ‘বাটে পেলে’ সাংবাদিকদের একহাত নেবার সাধারণ প্রবণতা আছে। এইসব ভাবতে ভাবতে শুনানি শুরু হলো। দুই পক্ষের উকিলের বক্তব্য সমানে চলছে। তাদের কথাবার্তা আমার কর্ণকুহরে হয়তো প্রবেশ করছিল। কারণ কানের পর্দা পর্যন্ত কর্ণকুহর আঁকাবাঁকা হলেও একেবারে বাধাহীন। ফলে এ দিয়ে শব্দ প্রবেশে বাধা নেই, আলো হলে ভিন্ন কথা ছিল। কিন্তু কর্ণকুহরে ঢুকলেও একটি বর্ণও আমার মগজ পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল না। কেননা, আমার মাথায় কেবল প্রক্সি দেবার অপরাধে হাজতবাস এবং এ নিয়ে রসালো কেলেংকারির গল্প রটনার আতঙ্ক। প্রায় আধা ঘণ্টা পর শুনানি শেষ হলো। কিন্তু আমি কাঠগড়ায়ই দাঁড়িয়ে আছি। কারণ আমি জামিন হওয়ার আদেশ শুনতে পাইনি।

আমার এ আচ্ছন্ন ভাব কাটলো উকিল কাঠগড়া থেকে নেমে আসার জন্য হাত ধরে টানায়। এরপর জামিনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বেরিয়ে আসার সময় একজন এসে বললো, আপনাকে হুজুর ডাকে। আমি তো অবাক! আদালতে আবার হুজুরটা কে, আমি মাজারে এলাম নাকি! উকিলের দিকে তাকালাম। সে বললো, ম্যাজিস্ট্রট। লোকটি আমাকে ‘হুজুরের’ খাস কামরায় নিয়ে গেল। সেখানে আমাকে তীব্র ভর্ৎসনা করা হলো। সেই ম্যাজিস্ট্রেট এখন অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি হিসেব কর্মরত। সেদিন তিনি চাইলেই আমাকে ন্যায়সঙ্গতভাবেই ঝামেলায় ফেলতে পারতেন। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল, বলতেই হবে।

কিন্তু পটিয়ার মামলায় প্রক্সি হাজিরা দিয়ে ঢাকায় ফেরার তিন দিন পরই চট্টগ্রামে আর একটি মামলা হলো। এবার বাদী আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। বিবাদী আমি ও সৈয়দ মোয়াজ্জেম। মামলা খেলেও স্বস্তি পেলাম এই ভেবে যে, আমাকে আর প্রক্সি দিতে হবে না। কিন্তু এবারও প্রক্সির চক্কর থেকেই গেল। মোয়াজ্জেম সাহেব তার প্রক্সি দেয়ার জন্য এবার বাছাই করলেন তার বিদ্যুৎ ব্যবসার কর্মকর্তা মহিতুল ইসলামকে। চট্টগ্রামে ফাও ট্যুর করার সুযোগ পেয়ে মহিতুল বেশ খুশি। কিন্তু আমি আতঙ্কে ছিলাম পটিয়ার অভিজ্ঞতার কারণে। বিষয়টি তার সঙ্গে শেয়ার করলাম। এতে মহিতুল আরও উচ্ছ্বসিত হলেন। তার বক্তব্য, প্রক্সি ধরা পড়লে কয়েকদিন হাজতবাসে জেলখানা সম্পর্কেও একটা ধারণা হবে, পত্রিকায়ও নাম উঠবে। মনে মনে ভাবলাম, এই পাগলকে নিয়েই আমাকে চট্টগ্রাম যেতে হবে!

চট্টগ্রাম গিয়ে দেখলাম পাগল আরও অনেক আছে। বিভিন্ন কানেকশনে অন্তত দশ জন উকিলের সঙ্গে দেখা করলাম দুই দিনে। কিন্তু কেউই আখতারুজ্জামান বাবুর মামলায় আমাদের পক্ষে দাঁড়াতে রাজি হলেন না। পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে তৃতীয় দিন একজনকে খুঁজে বের করলাম। নাম সম্ভবত অ্যাডভোকেট এ কে এম শামসুল হুদা। অত্যন্ত ধীরস্থির স্বভাবের মানুষ; তিনি রাজি হলেন। আমাদের সতর্ক করে বললেন, আদালতে অনেক উকিল কিন্তু নানা ধরনের আপত্তিকর মন্তব্য করতে পারে; এতে আমরা যেন কোনো রকম রিঅ্যাক্ট না করি। তার এ সতর্কতা যে কত জরুরি ছিল তা আদালতে হাজির হয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।

পুরনো আমলের ভবনের বিশাল কক্ষ উকিলে ভরে গেল; সংখ্যা শ’খানেক হবে। এদের মধ্যে একজন ছাড়া সবাই আখারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর পক্ষের। সমস্যা তা নয়; সমস্যা হলো এ উকিলের দল বিচারকের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেবার পরিবর্তে আমাদের গালিগালাজ করতে লাগলেন। আদি চাঁটগাইয়া ভাষায় এসব দুর্বোদ্ধ গালিগালাজের যতটুকু বুঝেছি তাতেই মনে হয়েছে, ধরণী দ্বিধা হলে ভালো হয়! প্রায় ঘণ্টাখানেক শুনানির পর আমাদের জামিন দিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। সঙ্গে সঙ্গে পুরো আদালত কক্ষ হট্টগোল-চিৎকারে ফেটে পড়ার উপক্রম হলো। কিন্তু তরুণ ম্যাজিস্ট্রেট কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি। পুলিশকে নির্দেশ দিলেন, আমাদের নিরাপত্তা দিতে। আমরা পুলিশ প্রহরায় গেলাম সিনিয়র অ্যাডভোকেট শামসুল হুদার চেম্বার পর্যন্ত। সেখানে কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে ঘণ্টাখানেক পর তার সঙ্গে বের হলাম। তিনি দুপুরের খাবার জন্য তার বাসায় নিয়ে গেলেন। এর আগে তার ফি দেবার জোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। উকিল টাকা নেয় না- সেটি আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। এরপর দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা হয়েছে মেয়র মির্জা আব্বাসের মামলায়; প্রায় ধস্তাধস্তি করে অ্যাডভোকেট কামরুলকে টাকা ধরাতে হয়েছিল। পেশাদার উকিল হয়েও তিনি কিছুইে টাকা নিতে চাচ্ছিলেন না। এর বহু পরে দেখেছি এক মামলায় হাইকোর্টে জামিল নিয়ে অনেকটা হাতাহাতি করার মতো করেও সাবেক স্পিকার শেখ আবদুর রাজ্জাককে টাকা ধরাতে পারেননি চট্টগ্রাম-১ আসনের সংসদ সদস্য এম এ জিন্নাহ। যদিও এর কিছুক্ষণ আগে একই মামলার অপর আইনজীবী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা এমনভাবে টাকা গ্রহণ করেছিলেন যেন এম এ জিন্না কেবলই মক্কেল; এ পরিচয়ের বাইরে তাকে চেনেনই না তিনি। অথচ তারা সংসদে কলিগ ছিলেন।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মামলায় জামিন পাওয়ার পর আমাদের উকিল এ কে এম শামসুল হুদা মামলা হাইকোর্টে কোয়াশ করার পরামর্শ দিলেন; বললেন এ মামলায় চট্টগ্রাম না আসাই ভালো। তার ধারণা, চট্টগ্রাম আমাদের জন্য নিরাপদ নয়; খুবই ঝুঁকির। তিনি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গেও দেখা করার পরামর্শ দিলেন এক প্রকার পরোক্ষ প্রটেকশন হিসেবে। ওইদিন সন্ধ্যায়ই মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাড়িতে গেলাম একা। কারণ অতি উৎসাহী প্রক্সি দেয়া কেস পার্টনার মহিতুলের উৎসাহের পারদ নেমে গিয়েছিল শূন্যেরও অনেক নিচে। আরও পরিষ্কার করে বলা চলে, সে খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সে হোটেলেই থাকলো; আমরা উঠেছিলাম হোটেল গোল্ডেন ইন-এ। সোনার সঙ্গে জড়িয়ে এ হোটেল মালিক রফিকুল আনোয়ারে মূল পেশা সবারই জানা। কিন্তু এরপরও তিনি আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। অনেক ক্ষেত্রেই বিচিত্র দন্ত দেখায় আমাদের সংসদীয় রাজনীতি!

মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় লোকেশন জেনে নিলাম হোটেলের এক স্টাফের কাছ থেকে। তাকে বাসায়ই পেলাম। অকল্পনীয় এক আন্তরিক মানুষ। তিনি এমনভাবে আমাকে গ্রহণ করলেন যেন আমি তার বহু কালের চেনা। নানান বিষয় নিয়ে গল্প করলেন। মদাইয়া সুপারি তৈরি করার পদ্ধতি থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের ছেলেমেয়েদের বিয়ের কালচার নিয়েও কথা বলেছিলেন চট্টগ্রামের কিংবদন্তির এ নেতা। তিনি বললেন, বিয়েতে ছেলে-মেয়ে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, চাঁটগাইয়া না বাঙালি? নানান বিষয় নিয়ে কথা বললেও আখতারুজ্জামান বাবুর ব্যাপারে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করেননি তিনি। কেবল সাবধানে থাকতে বলেছিলেন। অনেক কথার সাথে চাঁটগাইয়া আন্তরিকতায় আপ্যায়ন পর্ব চললো। এর আগে এ বিষয়ে বরিশালকেই মনে করতাম সেরা।

ঘণ্টা দুই পর এক প্রোগ্রামে যাবার সময় তিনি আমাকে হোটেলে ড্রপ করলেন। তার গাড়ি চালকের নাম ছিল সম্ভব আলাউদ্দিন; সে ছিল ড্রাইভার কাম বডিগার্ড। হোটেলে ড্রপক করার বিষয়টি সে সময় আমার কাছে মনে হয়েছিল একজন জননেতার সহজাত বদান্যতা। কিন্তু ট্রেনে কৃষক লীগ সভাপতি রাশেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা হবার পর বুঝলাম, তিনি আসলে আমার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। অথচ সেদিনই তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। এবং এরপর তার সঙ্গে আর কখনো দেখা বা কথা হয়নি। শুধু একবার নৌ-পরিবহন মন্ত্রী আকবর হোসেনকে চট্টগ্রাম পোর্টের একটি বিষয় নিয়ে যখন ধমকাচ্ছিলেন তখন তার কণ্ঠ শুনছিলাম। তার ব্যবহারে মন্ত্রী আকবর হোসেন খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মামলায় জামিন লাভের পরদিন সকালে আমরা ট্রেনে ঢাকা রওয়ানা করলাম। হোটেলের কাছেই রেল স্টেশন। ট্রেন চলতে শুরু করার কিছুক্ষণ পর পরই প্রক্সি আমার কেস পার্টনার মহিতুল জিজ্ঞেস করছিলেন, আমরা চট্টগ্রাম ছাড়িয়েছি! ট্রেন ঘণ্টাখানেক চলার পর তিনি কিছুটা স্বাভাবিক হলেন। কিন্তু তার এ স্বাভাবিক অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। সত্যি বলতে আমিও শেষ দিকে বেশ ভয়ে পেয়ে গিয়েছিলাম। বিশেষ করে হোটেলের শেষ রাতটি খুবই আতঙ্কে কেটেছে। পুরো বিষয়টি শওকত হোসেন হিরনের সঙ্গে শেয়ার করায় সে বললো, আপনি রুম বদল করেন; আমার রুমে থাকেন। তার রুমে প্রায় শেষ রাত পর্যন্ত আড্ডা দেবার পর ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে আমরা ঢাকার ট্রেনে চাপলাম। শওকত হোসেন হিরন চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন পোর্ট থেকে গাড়ি কেনান জন্য; সম্ভবত সেটিই তার প্রথম ব্যক্তিগত গাড়ি কেনা।

ট্রেনে খাবার কোচে যাবার সময় দেখা হয় কৃষক লীগ সভাপতি রাশেদ মোশাররফের সঙ্গে। তিনি পরে ভূমি প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। খুবই সাদামাটা আন্তরিক স্বভাবে মানুষ। আমাদের চট্টগ্রাম যাবার কারণ শুনে তিনি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বললেন, ভাগ্য ভালো চট্টগ্রাম ছাড়তে পেরেছেন। তবে বিপদ এখনো কাটে নাই। ঘটনা ট্রেনেও ঘটতে পারে, দরজার কাছে যাবেন না; ট্রেন থেকে ফেলে দিতে পারে। আমার কেস পার্টনার মহিদুল আবার চুপসে গেলেন। কাঁপা কাঁপা করুণ কন্ঠে বললো, কী হবে রায়হান ভাই!

লেখক: জেষ্ঠ্য সাংবাদিক; e-mail: [email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :