চট্টগ্রামে অভিযানে বাস উধাও, দুর্ভোগ চরমে

চট্টগ্রাম ব্যুরো, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২০ জুলাই ২০১৭, ১৭:৩৬ | প্রকাশিত : ২০ জুলাই ২০১৭, ১৭:১৩

মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। সড়কে নেই বাস, মিনিবাস, টেম্পো, হিউম্যান হলার, সিএনজি অটোরিক্সা। সড়কের মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে অসংখ্য মানুষ। দুর্ভোগের অন্ত নেই তাদের। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হলেও গন্তব্যে পৌঁছার অনিশ্চিত অপেক্ষা চট্টগ্রাম নগরবাসীর।

সাগরে নিম্মচাপের প্রভাবে গত সোমবার থেকে চট্টগ্রামে শুরু হয় বৃষ্টি। নিম্মচাপের প্রভাবে চট্টগ্রামে বৃষ্টি ভারী বর্ষণে রুপ নিচ্ছে। আর এই বৃষ্টির মাঝে মিলছে না গণপরিবহন। মনে হচ্ছে যেন অঘোষিত ধর্মঘট। এর কারণ হচ্ছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অভিযান।

ট্রাফিক বিভাগ সূত্র জানায়, মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী গত মঙ্গলবার থেকে নগরীতে ফিটনেস, রেজিস্ট্রেশন এবং রুট পারমিটবিহীন পরিবহনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু চলছে। ২২ জুলাই পর্যন্ত এ অভিযান চলবে। মঙ্গলবার ও বুধবার অভিযানে প্রচুর যানবাহন আটক হয়েছে।

চট্টগ্রাম ট্রাফিক পুলিশের প্রসিকিউশন (উত্তর) সার্জেন্ট আনোয়ারুল হক ঢাকাটাইমসকে জানান, নগরীতে গত দুদিনের অভিযানে ২৮০টি অবৈধ গাড়ি আটক করেছে ট্রাফিক বিভাগ। মামলা করা হয়েছে ১৬৮৬টি গাড়ির বিরুদ্ধে। ফলে অবৈধ গাড়িগুলো সড়কে নামেনি। এতে প্রথম দিন থেকেই দেখা দেয় যানবাহন সংকট। তাতে নানা ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ।

ভুক্তভোগীরা জানান, নগরীতে ফিটনেসবিহীন অসংখ্য বাস, হিউম্যান হলার, টেম্পো, ভটভটি, সিএনজি অটোরিকশা ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে। জনবহুল শহরের মানুষ নিরুপায় হয়ে চলাচল করে। এরমধ্যেও নানা নৈরাজ্যের শিকার হতে হয় যাত্রীদের।

অভিযান শুরুর পর থেকে এসব অবৈধ যানবাহন সড়ক থেকে উধাও হয়ে গেছে। এমনকি শহরের বাইরে সীতাকুন্ড, মিরসরাইসহ উপজেলার বিভিন্ন সড়কে চলাচলকারী অবৈধ যানবাহনগুলো পর্যন্ত শহরে আসছে না। এ সুযোগে বৈধ যানবাহন ও রিকশা চালকরা দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া আদায় করছে। তাতেও সময়মত গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না।

নগরীর ভাটিয়ারি থেকে শহরে আসা-যাওয়া করে প্রতিদিন অফিস করেন শাহাবুদ্দিন নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করে যা-ও একটি হিউম্যান হলার পাই সেটি সিটি গেট পর্যন্ত এসে যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে দেওয়ানহাট যেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। বাদুরঝোলা হয়ে কিছুদূর টেম্পুতে এবং বাকি পথ রিকশায় যেতে বাধ্য হই।

জিইসি মোড়ে গাড়ির অপেক্ষায় এদিক ওদিক ছুটে চলা এক গৃহবধূ বলেন, ছেলেকে নিয়ে কলেজিয়েট স্কুলে যাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার পরীক্ষা। কিন্তু কোনো গাড়ি পাচ্ছি না। মাঝে মধ্যে যে দুই একটা বাস আসছে সেগুলোতেও ঠাঁই যাচ্ছে না। রিকশায় যেতে চাচ্ছি, ভাড়া দাবি করছে দ্বিগুণ।

প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মুমু দাশ বলেন, গত মঙ্গলবার থেকে বাস পাচ্ছি না। অন্যদিন প্রতি ৫ মিনিট ১০ মিনিট পরপর বাস, মিনিবাস, টেম্পু পাওয়া যেত। এখন গাড়ির সংখ্যা একেবারে কম। বৃষ্টির কারণে কোনো রিকশাও যাচ্ছে না। তাই বহদ্দারহাট এলাকায় পৌনে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি।

কলেজিয়েট স্কুলের এক শিক্ষার্থী দুই ঘণ্টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিল মুরাদপুর এলাকায়। ধাক্কাধাক্কি করে বাসে উঠতে না পেরে এক পর্যায়ে কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়। দামপাড়া পুলিশ লাইন স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, বহদ্দারহাট থেকে প্রতিদিনের মতো ছেলেকে নিয়ে বের হয়ে প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি, কোনো বাস পাচ্ছি না। পরিবহন সংকটের কারণে একইভাবে সিটি কলেজে ডিগ্রির মিটটার্ম পরীক্ষায় অংশ নিতে যাওয়া মাহমুদও সঠিক সময়ে কলেজে পৌঁছাতে পারেনি বলে জানিয়েছেন।

মুরাদপুর থেকে ফটিকছড়িতে যাওয়া নিপু নামে এক বেসরকারি কলেজের শিক্ষিকা জানান, শুনেছি ফিটনেসবিহীন বাসের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এই খবরে সড়কে সব বাস উধাও হয়ে গেছে। মুরাদপুরে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে কোনো বাস পাইনি। আমরা সাধারণ যাত্রীরা পড়ে গেলাম দুর্ভোগে। সড়কে কেন? টার্মিনালে গিয়ে অভিযান চালানো যায় না?

সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর কালুরঘাট, চান্দগাঁও, বহদ্দারহাট, চকবাজার, শুলকবহর, কাতালগঞ্জ, বাদুরতলা, কদমতলী, দেওয়ানহাট, বড়পুল, অলংকার, সিটি গেইট, অক্সিজেন, মাদারবাড়ি, এক কিলোমিটার, নতুন ব্রিজ বাসটার্মিনালে দেখা গেছে শত শত যানবাহন অলস বসে আছে।

বাস, মিনিবাস, পিকআপ, লেগুনা, রাইডার, সিএনজি চালিত অটোরিক্সা, টেম্পুসহ বিভিন্ন ধরনের যনবাহনের সারি, ঠাসাঠাসি করে রেখে দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ করে যে কারো মনে হতে পারে চট্টগ্রাম মহানগরীতে বোধহয় পরিবহন ধর্মঘট চলছে। অবশ্য অঘোষিত ধর্মঘটই বলা চলে।

অভিযানের খবর পেয়ে ষোলশহর দুই নম্বর রোডের (বহদ্দারহাট থেকে নিউমার্কেট) একটি বাস দ্রুতগতিতে চকবাজারের দিকে যাচ্ছিল। এই বাসের চালক আনোয়ার হোসেন জানান, মঙ্গলবার প্রায় দুই শতাধিক গাড়িকে মামলা দিয়েছে এবং আটকে রেখেছে। শুনলাম, আজকেও অভিযান চালাচ্ছে। তাই গাড়ি গ্যারেজে ঢুকিয়ে রাখতে যাচ্ছি। অভিযান শেষ হলে গাড়ি চালাবো।

অভিযানের কারণে সড়ক থেকে গাড়ি উধাও হয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে মেট্রো পরিবহণ মালিক গ্রুপের মহাসচিব বেলায়েত হোসেন বলেন, সড়কে গণপরিবহণের কোনো সংকট ছিল না। সকালে অফিস যাওয়া-আসার সময় আগের মতোই কিছু গাড়ি রিজার্ভ ভাড়ায় চলে যাওয়ায় এই সময়ে গাড়ির কিছুটা সংকট দেখা দেয়। সেটি তো আগে থেকেই ছিল।

তবে নগর পরিবহণ মালিকদের ছয় সংগঠনের জোট চট্টগ্রাম সিটি সড়ক পরিবহন মালিক ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক এস এম তৈয়ব বলেন, পূর্ব ঘোষণা ছাড়া ঢালাওভাবে অভিযান চালিয়ে শত শত গাড়ি আটক দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। মালিকরা এতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে রাস্তায় গাড়ি নামানো বন্ধ করে দিয়েছেন। ৮০ শতাংশ নগর গণপরিবহনই এখন রাস্তায় নামেনি।

তিনি বলেন, প্রশাসনের পদক্ষেপের প্রতি সম্মান দেখিয়েই আমরা আগামী রবিবার পর্যন্ত অভিযান বন্ধ রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রশাসন তা শুনছে না। রবিবার পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে আমরা (পরিবহন মালিকরা) চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বসবো। সেখানে কমিশনারকে নগরীর যানবাহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে মালিকদের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ ও দাবি জানাবো। সেগুলো মানার জন্য সময় বেধে দিয়ে আলটিমেটাম দেয়া হবে। দাবিগুলো মানা না হলে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) দেবদাস ভট্টাচার্য জানান, যানবাহনের অনিয়ম বন্ধে পাঁচদিনব্যাপী অভিযান চলবে। আর যেসব গাড়ি আটক করা হয়েছে অপরাধ বিবেচনায় জরিমানা আদায় করে সেসব গাড়ি ছেড়ে দেয়া হবে। আগে থেকেই সিদ্ধান্ত ছিল আটক গাড়ি তিনদিন পর ছেড়ে দেয়া হবে। সেই মোতাবেক আজ জরিমানার ভিত্তিতে সেগুলো ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ফিটনেস এবং রুট পারমিটবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে পুলিশের এই অভিযানের প্রতি সমর্থন রয়েছে পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষেরও (বিআরটিএ)। বিআরটিএ চট্টগ্রামের উপ পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, আমরা ২২ বছরের পুরনো বাস এবং ১৮ বছরের পুরনো হিউম্যান হলারের রুট পারমিট দিচ্ছি না। একটি আধুনিক শহরে তো রুট পারমিটবিহীন পুরনো গাড়ি চলতে পারে না। আমরা পুরনো গাড়িগুলো শহরে না চালিয়ে শহরের বাইরে চালাতে বলেছি। শহরে নতুন গাড়ি নামবে। রুট পারমিট প্রদানের ব্যাপারে একটি হাই অথরিটি কমিটি আছে। এখানে মালিক-শ্রমিক, বিআরটিএ এবং পুলিশ প্রশাসনও রয়েছে।

তিনি বলেন, ফিটনেস, রেজিস্ট্রেশন ও রুট পারমিটবিহীন বাস ও হিউম্যান হলারগুলো দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে নগরীতে চলছে। পরিবেশ ও জনজীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা বাড়াতে এ অভিযান শুরু হওয়ার সাথে সাথে আত্মগোপনে চলে গেছে অবৈধ গাড়িগুলো। যার ফলে নগরীতে যানবাহন সংকট প্রকট হয়ে উঠে।

(ঢাকাটাইমস/২০জুলাই/প্রতিনিধি/জেডএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :