ভাবমূর্তি হারাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর!

চট্টগ্রাম ব্যুরো, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ২৩ জুলাই ২০১৭, ০৮:৫৪
ফাইল ছবি

দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বন্দরে অবকাঠামোগত সুবিধা তৈরি না হওয়ায় জাহাজজট মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে সময়মতো নতুন জেটি ও টার্মিনাল তৈরি না হওয়া এবং হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট সংগ্রহে ব্যর্থতার কারণে পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। আর এমন পরিস্থিতি সারচার্জ বসিয়েছে বিদেশি কোম্পানিগুলো যা ভাবমূর্তি নষ্ট করছে চট্টগ্রাম বন্দরের।

বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থানকাল অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি শিপিং লাইনগুলো গত জুন থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রপ্তানি কনটেইনারের ওপর সারচার্জ আরোপ করে। প্রতি ২০ ফুট কনটেইনারে ১৫০ ডলার এবং প্রতি ৪০ ফুট কনটেইনারে ৩০০ ডলার করে এ চার্জ বসানো হয়েছে। আর তা প্রচারমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করছে তারা।

এর ফলে জুন থেকে আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা প্রতি মাসে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা হারাচ্ছেন বিদেশি জাহাজ মালিকদের কাছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জনজীবনেও। ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট ও টেক্সটাইল ব্যবসায়ীরা। বিদেশে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান গত মঙ্গলবার বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তিনি ব্যবসায়ীদের শিগগির এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। গত বুধবার বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের বৈঠক হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এ ব্যাপারে বৈঠকের কথা রয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশে ব্যবসারত বিদেশি জাহাজ মালিক প্রতিনিধি কন্টিনেন্টাল গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক আতাউল করিম চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থানকাল অনেক বেড়ে গেছে। ফলে বিদেশি জাহাজ মালিকরা সারচার্জ আরোপ করতে বাধ্য হয়েছেন।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর যে গতিতে চলার কথা সে গতিতে চলছে না। বিশ্বে প্রতিটি বন্দরের গতি বাড়ছে, সেখানে পিছিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। আগামী বছরগুলোয় কনটেইনার বাণিজ্য আরো বাড়বে। এ অবস্থায় বন্দর তাল মিলিয়ে চলতে পারবে কি না সংশয় রয়েছে। শিগগির বন্দর পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে বহির্বিশ্বে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বন্দরের বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা উদ্বিগ্ন বলে জানান বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) প্রথম সহসভাপতি মইনুদ্দিন আহমেদ মিন্টু। তিনি বলেন, ‘সারচার্জ আরোপের ফলে ব্যবসায়ীদের ব্যয় যেমন বাড়বে, তেমনি লোকসানও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্দর পরিস্থিতি দ্রুত সামাল দিতে আমরা সরকারের কাছে তাগাদা দিয়ে যাচ্ছি। এ অবস্থা দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকলে পোশাক রফতানি বিপুল ক্ষতির মুখে পড়বে।’

নৌ–পরিবহন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম-১১ আসনের সংসদ সদস্য এম আবদুল লতিফ এ প্রসঙ্গে বলেন, বিশ্বের ১০০টি বন্দরের র‌্যাংকিংয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৭৬ নম্বরে। চট্টগ্রাম বন্দর বর্তমানে যেভাবে চলছে, তাতে এ হার আরো পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় পোশাক রপ্তানিতে। আর এসব পোশাক চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সারা বিশ্বে যায়।

চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনারবাহী জাহাজ ও সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজ জট সাম্প্রতিককালে মারাত্মক রূপ নিয়েছে। বিশেষত ঈদের আগের দিন জাহাজের আঘাতে একযোগে দুটি ক্রেন অকেজো হওয়ার পর অবস্থার নিদারুণ অবনতি ঘটেছে। এতে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে ক্রেনবিহীন জাহাজগুলো। বার্থিং পেতে এগুলোকে দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে বহির্নোঙ্গরে। তাতে শিল্পকারখানার কাঁচামাল, নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে খরচ বাড়ছে এবং ডেলিভারি পেতে বিলম্ব হচ্ছে।

এসব সংকটের কথা উল্লেখ করে আবদুল লতিফ বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে সাম্প্রতিককালে এমন খারাপ অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে হলেও বাস্তবে তা নয়। রাতারাতি এমন পরিস্থিতি হয়নি। প্রশাসনের দীর্ঘদিনের গাছাড়া ভাব এর জন্য দায়ী। বে-টার্মিনাল, নতুন বাল্ক টার্মিনাল, কন্টেইনার টার্মিনাল এবং অনেক যন্ত্রপাতি সংগ্রহের পরিকল্পনার কথা দফায় দফায় সবাইকে শোনানো হলেও বাস্তবে কোন অগ্রগতি হয়নি, সবকিছু নথিতে সীমিত হয়ে আছে।’

গত এক বছরে ৫৫টি যন্ত্রপাতি সংগ্রহ চূড়ান্ত হলেও এর আগে ৭ বছরে সংগৃহীত হয়েছে মাত্র ৪৫টি- এই তথ্য জানিয়ে আবদুল লতিফ বলেন, ‘বর্তমান চেয়ারম্যনের সময়কালে এ ক্ষেত্রে গতি ফিরে এলেও অতীতে তা স্থবির ছিল। চিটাগাং কন্টেইনার টার্মিনাল ( সিসিটি) এবং নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিকল্পনার সাথে এগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্টের ব্যবস্থা ছিল না। এই বন্দর দিয়ে কন্টেইনারে প্রতিবছর ১৫ শতাংশ হারে এবং সাধারণ পণ্যে ১৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তা সামলানোর জন্য প্রস্তুতি নেয়ার প্রয়োজন ছিল অনেক আগে থেকে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় বিরাজমান অস্বস্তিকর অবস্থার উদ্ভব হয়েছে।

সাংসদ লতিফ বলেন, স্বাধীনতা উত্তরকালে জেটি ছিল ১৩টি। পরবর্তীতে গত ৪৬ বছরে অন্তত আরও ২৬টি জেটিও টার্মিনা হওয়া আবশ্যক ছিল। কিন্তু হয়েছে মাত্র ৭টি। এনসিটিতে ৫টি এবং সিসিটিতে ২টি। তাহলে পরিস্থিতি সামলাবে কী করে বন্দর?

ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে একটি জাহাজ পণ্য খালাস করে পুনরায় বোঝাই করে নিয়ে বন্দর ত্যাগ করতে সময় লাগছে ১০-১৫ দিন। অথচ এতে ৪৮ ঘণ্টা লাগার কথা। অনেক ক্ষেত্রে জাহাজের গড় অবস্থানকাল ৩০ দিনে গিয়েও ঠেকছে। আগে বহির্নোঙরে কনটেইনার জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকার তেমন নজির না থাকলেও বর্তমানে গড়ে ১৫টি জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে বন্দরের ভেতরে পণ্য খালাস ও বোঝাইয়ের শিডিউলের আশায়।

বন্দরের এমন ধীরগতির কারণ জানতে চাইলে বন্দও পরিচালনা কমিটির সদস্য মো. জাফর আলম জানান, কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি দুটি গ্যান্ট্রি ক্রেন অচল হয়ে পড়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মাত্র তিনটি রাবার টায়ার গ্যান্ট্রি ক্রেন দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে বিদেশি জাহাজ মালিকরা সংঘবদ্ধভাবে আরোপ করেছে সারচার্জ। কনজেশন সারচার্জ আদায়ও করতে শুরু করেছে। প্রতি ২০ ফুট কনটেইনারে ১৫০ ডলার এবং প্রতি ৪০ ফুট কনটেইনারে ৩০০ ডলার সারচার্জ আরোপ করা হয়েছে।

বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতি মাসে এক লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়। এসব কনটেইনারের পেছনে ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত ৩৫০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ ব্যয় হবে। এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইলের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের অদক্ষতা ও নানা আনুষঙ্গিক কারণে এমনিতেই বিশ্বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত রফতানিতে ১১ শতাংশ পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভারত ও ভিয়েতনাম ৪০ শতাংশ এগিয়ে গেছে, যা বাংলাদেশের জন্য কোনো অবস্থাতে শুভসংকেত নয়।

চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য নতুন যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়টি নিয়ে বছরের পর বছর চলেছে প্রতীক্ষা। ১২০০ কোটি টাকার নতুন যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়টিও হচ্ছে ঢিমেতালে। বর্তমানে বন্দরের যে দুটি গ্যান্ট্রি ক্রেন নষ্ট হয়ে আছে এগুলো আনতে হবে জাপান থেকে। কবে আসবে এবং দীর্ঘসূত্রতা কত দূর গড়ায় এ নিয়ে বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা। ব্যবসায়ীদের কনটেইনার পণ্য রাখার পর্যাপ্ত জায়গা নেই বন্দরে। ফলে বন্দর এখন খালি কনটেইনার ফোর্স শিপমেন্ট করার পথ বেছে নিয়েছে।

কিন্তু এভাবে আর কত দিন- প্রশ্ন রেখে ব্যবসায়ীরা বলেন, নানা দুর্বলতা, দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না চট্টগ্রাম বন্দর। একশ্রেণির মাফিয়ার হাতে এটি জিম্মি হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বেসরকারিভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়। ফলে বন্দরের কার্যক্রমে গতি আসতে শুরু করে। তার পরও অন্য সমস্যাগুলো থেকেই যায়। বন্দরের ফান্ডে টাকার অঙ্ক বাড়তে থাকলেও বন্দর উন্নয়নে নেওয়া প্রকল্পগুলো গতি পাচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক বন্দরগুলোর মতো চট্টগ্রাম বন্দরকে ২১ শতকের উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার কাজ কিছুই হচ্ছে না বলে হতাশা প্রকাশ করেন বন্দর বিশেষজ্ঞরা।

(ঢাকাটাইমস/২৩জুলাই/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

অর্থনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

অর্থনীতি এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :