এখনো ‘বিস্ময় বালক’ বুড়ো ফেদেরার!

মিনহাজ ইসলাম লিও
 | প্রকাশিত : ২৩ জুলাই ২০১৭, ২৩:৩০

৩৫ বছর বয়সে এসেও গ্র্যান্ডস্লাম জিতলেন রজার ফেদেরার। রেকর্ড অষ্টম উইম্বল্ডন এবং ক্যারিয়ার রেকর্ড ১৯ তম গ্র্যান্ডস্লাম জিতলেন; তাও ক্যারিয়ারের এমন সময়ে এসে যখন কি না বেশিরভাগ টেনিস খেলোয়াড়রা অবসর নিয়ে নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যান। আর সেখানে ফেদেরার যেন সম্পুর্ন নতুনরুপে আবির্ভূত হয়েছেন।

এতো গুলো বছর ধরে, টেনিসবিশ্বে এতোশত পরিবর্তন, কয়েকটা জেনারেশনের আসা-যাওয়া, এইযে এতকিছু, এতোসবের পরে ঠিক কি পেলাম আমরা? একটা রজার ফেদেরার! উইম্বল্ডন চ্যাম্পিয়ন। আবার এবং আবার, বারবার। এখন অব্দি সর্বমোট আটবার।

রবিবার উইম্বল্ডন ফাইনালে মার্টিন চিলিচ কে টানা তিন সেটে ৬-৩, ৬-১, ৬-৪ এ হারিয়ে শিরোপা জিতে নেন টেনিসের সর্বকালের সেরা এই খেলোয়াড়। খেলার মাঝে তো অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে দ্বিতীয় সেট চলাকালে মার্টিন চিলিচ হঠাৎ ই চেয়ারে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে তার ট্রেইনার কে এসে ফোস্কা পড়া পায়ের পরিচর্যা করা লাগে এবং স্বান্তনাও দেওয়া লাগে, তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। এতোটাই দোর্দন্ড প্রতাপে ম্যাচে ছিলেন ফেদেরার! আরেকটি অবিশ্বাস্য রকমের তথ্য হচ্ছে তিনি এবারের উইম্বল্ডনের কোন ম্যাচে কোন সেটেই হারেননি!

আগস্টের আট তারিখে ৩৬ এ পা দিতে যাওয়া ফেদেরারের জন্য এটি ছিল রেকর্ড অষ্টম উইম্বল্ডন শিরোপা এবং ক্যারিয়ার রেকর্ড ১৯ তম মেজর শিরোপা। ম্যাচ জয়ের পর আবেগাপ্লুত ফেদেরার দর্শকদের উদ্দ্যেশ্যে বলেন, “যদি তুমি তোমার মনে বিশ্বাস ধরে রাখতে পারো, তবে তুমি অনেক দূর যাবে। আমি সেই বিশ্বাসটাই ধরে রেখেছিলাম।”

সত্যি বলতে কথাটা যে পুরোপুরি সত্য তা কিন্তু নয়। তিনি বিশ্বাস ধরে রেখে এই সফলতা পাননি। এটা তার গল্পটা কে আরো অবিশ্বাস্য করে তুলেছে শুধুমাত্র।

বক্সিং এ একটা কথা আছে, ‘প্রত্যেক চ্যাম্পিয়নের মাঝেই একটা ফাইট অবশেষ থেকে যায়’। এখানে কিন্তু ঠিক এটাও হয়নি। তাহলে ঠিক কি হয়েছে?

ফেদেরার তার পুরনো ফর্ম ফিরে পাননি। তিনি যেন একটা নতুন ফর্ম তৈরী করেছেন। যেটাই সবচেয়ে বেশি অদ্ভুত এবং একইসাথে রোমাঞ্চকর।

যে বয়সে অধিকাংশ খেলোয়াড়রা অবসর নিয়ে অপেশাদার জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যান ঠিক সেই বয়সে ফেদেরার যেন তার ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে থাকার সময় যেমন পারফর্ম দিতেন তার চেয়ে ভাল পারফর্ম করে যাচ্ছেন। আবার এমন বললেও চলবে না যে তিনি আগের চেয়ে ভাল খেলছেন আরও সুনির্দিস্ট ভাবে বললে তিনি একজন টপ লেভেলের টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে আগের চেয়ে যথেষ্ট ভাল অবস্থায় আছেন। এবং সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এটি আরও অনেক সময়ের জন্য স্থায়ী হতে যাচ্ছে। এ সময়ে ফেদেরার কে সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবার জন্য যদিওবা কেউ থাকেন তবে তিনি হচ্ছেন ফেদেরারই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রাফায়েল নাদাল।

তাদের দুইজনের মধ্যে কেউ একজন আবার বছর শেষে এটিপি র‍্যাঙ্কিং এ এক নম্বর স্থান দখল করতে চলেছেন। যদিও র‍্যাংকিং এ দেখাচ্ছে না তারপরও এ বছরের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে রাফায়েল নাদালকে হারানো রজার ফেদেরার ই যে র‍্যাঙ্কিং এ শীর্ষ স্থান দখল করতে চলেছেন এ খবর এখন আর অজানা নয়।

বেশি বয়সী খেলোয়াড়দের মাঝে যেটা দেখা যায় না, ফেদেরারের মাঝে যেন তা আরও বহাল তবিয়তে বর্তায়মান! মানসিক দিক থেকেও তিনি যেন আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি শক্তিশালী। অথচ বয়স বাড়বার সাথে সাথে একজন খেলোয়াড়ের সিরিয়াসনেস বাড়লেও মানসিক শক্তি ধীরে ধীরে কমতির দিকেই থাকে; কারণ তখন তিনি খুব ভাল করে বুঝতে পারেন যে তার কাছে আর বেশি সময় নেই এভাবেই খেলতে থাকার। এসময়ে এই দৌড়ের খেলোয়াড়দের ছোট খাট ভুল ও লেগেই থাকে ঠিক যেমন ভেনাস উইলিয়ামস; ৩৭ বছর বয়সে উইম্বলডন ফাইনাল খেলতে নেমে প্রথম সেটটি জিততে জিততে ও কেমন করে যেন তিনি ছোট খাট দুএকটা ভুল করে বসলেন এবং স্বভাবতই ম্যাচের খেই হারিয়ে ফেললেন। যা তিনি আর শেষ পর্যন্ত জিততে পারেননি। উইম্বলডন জিতে নেন ২৩ বছর বয়সী স্প্যানিয়ার্ড গার্বাইন মুগুরুজা।

ফেদেরারও এই সমস্যায় ছিলেন তাও প্রায় কয়েক বছর ধরে। কিন্তু এই বছরের জানুয়ারি থেকেই যেন দেখা মেলে অন্য এক ফেদেরারের। খুব বেশি সময় হয়নি, ফেদেরার কে বেশ পুরনো ধাচের একটা র‍্যাকেট নিয়ে খেলতে দেখা যেত যার ফলে যেসব খেলোয়াড়রা শারীরিকভাবে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী তারা দেখা যেত তাকে একভাবে পুরো কোর্ট দাবড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এভাবেই খেলতে খেলতে একসময় ফেদেরার কয়েকধাপ পেছনে চলে আসেন।

তিনি তার স্নায়ু শক্তিও ঠিক এভাবেই হারিয়ে ফেলেন, বিশেষ করে নাদালের বিপক্ষে। তিনি কোন সুপারম্যান কিংবা আইরন ম্যান অবশ্যই নন। কিন্তু তিনি এমন একটা বয়সে তার সমস্যা গুলোকে কাটিয়ে উঠেছেন যে বয়সে বিশ্বের কোন খেলার কোন তারকায় এর আগে এভাবে ঘুরে দাড়াতে সক্ষম হননি। যতদূর বোঝা যায়, ফেদেরার যখনই নতুন র‍্যাকেট হাতে নিলেন তখন থেকেই তার সার্ভ গুলিতে আরও জোর পেতে শুরু করলেন।

পার্থক্যটাও পরিষ্কার বোঝা যায় যখন চিলিচের পুরো কোর্ট জুড়ে একরকম গলদঘর্ম হয়েছে, ফেদেরার তখন কোনরকম ক্ষান্ত দেননি বরং একের পর এক আক্রমণ শানিয়ে গেছেন। ম্যাচ শেষে তো চিলিচের সোজাসাপ্টা উত্তর, “আমি আমার সেরাটাই দিয়েছি এবং এইটাই আমি সর্বোচ্চ করতে পারি।” এদিকে ফেদেরার ইএসপিএন কে বলেন, “আমি এখন অবশ্যই একরকম অদ্ভুত ধরণের টেনিস খেলছি, যা আবার আমার কাছে কিছুটা ফানিও”

ফেদেরারের জন্য এটা বলা হয়তো খুবই সহজ ছিল। কিন্তু খুব শীঘ্রই ৩৬ বছরে পা দিতে যাওয়া ফেদেরারকে প্রথম হিসেবে দেখা গোটা টেনিস জগত টাকে ঠিক কোথায় নিয়ে গিয়ে দাড় করাচ্ছে? এখন হয়তোবা আন্তর্জাতিক টেনিস ফেদেরার আর নাদাল দুই সর্বকালের সেরা প্রতিদ্বন্দ্বী কে নিয়ে তার দ্বিতীয় যুগ ই শুরু করতে চলেছে! তারা দুইজন মিলে ’১৭ সালের চারটার গ্র্যান্ডস্লামের যে তিনটা এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে সেই তিনটাই দখল করে বসে আছেন!

এখানে আবার দুইটা দিক আছে, একটা হচ্ছে দুইজন বুড়ো ঘোড়া আবার হয়তো তাদের রাজত্ব কায়েম করতে চলেছেন যার ফলে আরেকটা দিকও সামনে চলে আসে সেটা হচ্ছে নতুন রা কেউ সেভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন। এটা এখন দিবালোকের মতো সত্য যে টেনিসের নতুন জেনারেশন আশ্চর্যজনক ভাবে দুর্বল। নতুন যারা খেলছেন তাদের মধ্যে স্ট্রোকস, পাওয়ার, স্পিডের সমারোহ থাকলেও তারা বেশিরভাগই বুঝে উঠতে পারেন না, তারা আসলে কোর্টে কি করতে আসছেন। এবারের উইম্বল্ডনের টপ ফোরেও তাই কোন ইয়াং সেনসেশনের দেখা মিলে নাই।

সেজন্য ই হয়তোবা ফেদেরার-নাদাল রা এখনো তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে পেরেছেন। ফেদেরারের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দুঃখের দিনটা ছিল বোধহয় ২০০৮ সালের উইম্বল্ডন ফাইনালে নাদালের কাছে সেই হৃদয়বিদারক হার। এখন দেখার বিষয়, তারা দুইজনই যদি বছরের শেষ গ্র্যান্ডস্লাম টুর্নামেন্ট ইউএস ওপেনের ফাইনালে পৌছান তবে সেখানে ফেদেরার তার ২০তম গ্র্যান্ডস্লাম জিতে সেই স্মৃতি মুছে ফেলতে পারেন কি না।

যত যায় হোক, সবার উপরে যেটা এবারের উইম্বল্ডন প্রমাণ করে গেলো সেটা হচ্ছে ফেদেরার শুধুই টেনিস ওয়ার্ল্ডের সেরা হয়ে থেকে যাননি; সবচেয়ে বেশি ১৯টি গ্র্যান্ডস্লাম জয়ী রজার ফেদেরার সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদদের মধ্যে এখন অন্যতম একটি নাম হয়ে গেছেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

খেলাধুলা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

খেলাধুলা এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :