অভাব নেই ত্রাণের, বিতরণ বন্ধ

প্রতীক ওমর, উত্তরাঞ্চল ঘুরে
 | প্রকাশিত : ২৪ জুলাই ২০১৭, ১২:০৫

পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র খায়রুল বাশার। বাবা-মায়ের সঙ্গে দুর্গম চরে বসবাস তার। বন্যা এলেই ঘর তলিয়ে যায় পানিতে। প্রতিবারের বন্যাতেই তাকে দেখতে হয় এমন দৃশ্য। একটু একটু করে বড় হচ্ছে বাশার। নিজের ভেতরেও কষ্ট অনুভব করতে শিখেছে। বন্যার কারণে স্কুলে যাওয়া হয়না টানা ২০-২৫ দিন। ঘরেও লেখাপড়া করার মতো পরিবেশ নাই। সমবয়সীদের সঙ্গে তাই সারাদিন নদীর পানিতে সময় কাটে তার। নৌকায় অচেনা ভদ্র মানুষের দল দেখলেই ছুটে আসে ত্রাণের আশায়। শহুরে কিছু তরুণ, হৃদয়বান ব্যক্তি ও সেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলো বরাবরের মতই তাদের পাশে দাঁড়ায়। এবারো দাঁড়িয়েছে। হাফ কেজি, এক কেজি চিড়া, গুঁড়, মুড়ি, বিস্কুট এসবের বেশি কিছু থাকে না ত্রাণের প্যাকেটগুলোতে। তারপরেও ক্ষুধার তাড়নায় ছুটে আসে একটি প্যাকেট পাওয়ার আশায়।

সম্প্রতি বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের সাত জেলায় বন্যার পানিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। নদীগর্ভে চলে যায় অসংখ্য বাড়িঘর। পানিতে তলিয়ে যায় মাঠের ক্ষেতখামার। পানিবন্দী লাখো মানুষকে কাটাতে হয় মানবেতর জীবন। ইতোমধ্যে এসব জেলায় আস্তে আস্তে নামতে শুরু করেছে বন্যার পানি। এখনো ১০ ভাগের মতো বাড়ি পানি জমে আছে। পানি নেমে গেলেও অধিকাংশ বাড়ি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

বগুড়ার বন্যা দুর্গত ইউনিয়নগুলোর মধ্য সারিয়াকান্দি উপজেলার কুতুবপুর, কামালপুর, চন্দনবাইশা ও কর্ণিবাড়ি, সোনাতলা উপজেলার মধুপর, তেকানি চুকাইনগর, পাকুল্লা, ধুনটের ভান্ডারবাড়ী, গোসাইবাড়ী ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তিন উপজেলার এসব ইউনিয়নগুলোর ১৭ হাজার ২৪৫ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছিল। বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এতে অনেকেই গৃহহারা হয়েছে। দুর্গত অনেক পরিবার এখনো বাঁধের উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়ে আছে। বাড়ি থেকে পানি নেমে গেলেও ঘরগুলো মেরামত ছাড়া বসবাস করা যাচ্ছে না। যে কোন সময় ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা আছে পানিতে ডোবা অধিকাংশ ঘর।

এদিকে লোকালয় থেকে বন্যার পানি নেমে গেলেও এখনো বিশুদ্ধ পানি, খাবার এবং তীব্র জ্বালনি সংকটে আছে বন্যায় দুর্গতরা। এছাড়া দেখা দিয়ে খাবারের সংকট। অনেক বন্যা দুর্গত মানুষ এখনো ত্রাণ পায়নি বলে অভিযোগ করেন।

সরেজমিনে যমুনার দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অনেকের হাতেই ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছেনি।

কথা হয় সারিয়াকান্দির বোহাইল ইউনিয়নের ৬০ বছর বয়সী বৃদ্ধ শাহ জামালের সঙ্গে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এবারের বন্যায় তার দুই ঘরের একটি ঘর একেবারেই ভেঙে গেছে। আরেকটি ঘরও যে কোনো সময় ভেঙে যাবে। পাঁচ বিঘা জমিতে ফসল লাগিয়ে ছিলেন সেই ফসলসহ জমি এখন নদীগর্ভে। এতো কিছুর পরেও সরকারের পক্ষ থেকে আসা কোনো ত্রাণ তিনি পাননি। তার মতো অভিযোগ করলেন ৫৫ বছর বয়সী খোতেজা বেগমও।

ত্রাণ না পাওয়ার এমন অভিযোগ থাকলেও জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস জানিয়েছে, পানি কমে যাওয়ায় তাদের ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। অথচ বগুড়ার বন্যার্তদের জন্য বরাদ্দ ২১৫ মেট্রিক টন চাল, ৭ লাখ ৫৫ হাজার নগদ টাকা, ১০০ বান্ডিল ঢেউ টিন ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসে মজুদ আছে। পানি কমে যাওয়ায় ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানান।

বন্যার পানিতে বগুড়ার সারিয়াকান্দি, ধুনট, সোনাতলা উপজেলায় ঘরবাড়ি, রাস্তা ঘাট, পুকুরের মাছ, মাঠের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে প্রায় ৬৩ কোটি টাকারও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব ক্ষতি মোকাবেলায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস বন্যা দুর্গতদের মাঝে ৩৩৫ মেট্রিক টন চাল, ৪ লাখ টাকা, ৪০০ বান্ডিল ঢেউটিন বিতরণ করলেও তার পর্যাপ্ত নয়।

বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষরা এখনো ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন। বাইরের মানুষ দেখলেই ত্রাণের আশায় ছুটে আসছেন এসব মানুষ।

এছাড়া বন্যার পর রাস্তাগুলো জেগে উঠলেও সেগুলো চলাচললের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এতে ভোগান্তি বেড়েছে এলাকাবাসীর। ফসলের ক্ষতিও পুষিয়ে উঠতে হিমশিম খাচ্ছেন দুর্গত এলাকার কৃষকরা।

চলতি বছরের বন্যায় উত্তরের সাত জেলা সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রামে ২২ হাজার ৪০৭ হেক্টর ফসলি জমি পানির নিচে ডুবে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা বগুড়ায় ২৪ হাজার ২৫ জন, সিরাজগঞ্জ জেলায় ৬৫ হাজার ৩০৯ জন। রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলা মিলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে। টাকার অংকে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি।

এদিকে বন্যার কারণে বাঁধে আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার নারী-পুরুষ শিশু মানবেতর জীবন যাপন করছে। শুকনা জ্বালানি, বিশুদ্ধপানির সংকট এসব এলাকায় তীব্র আকার ধারণ করেছে। এখন পর্যন্ত যে ত্রাণ দেয়া হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।

সারিয়াকান্দি উপজেলার বোহাইল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, ‘সরকার চলতি বন্যায় কয়েক দফা ত্রাণ সামগ্রী দিলেও দুর্গত মানুষের তুলনায় অনেক কম।’ যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাতে আরো ত্রাণের প্রয়োজন বলে তিনি জানান।

বগুড়া ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা শাহারুল ইসলাম মো. আবু হেনা জানান, বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা এবং ধুনট উপজেলার ১৭হাজার ২৪৫ পরিবার পানিবন্দী ছিলো। এসব বানভাসী মানুষদের মধ্যে সারিয়াকান্দি আশ্রয় প্রকল্পে ঠাঁই পেয়েছে ৭৬৫ জন। এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আছে ৩৫৫ পানিবান্দী পরিবার। তাদের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ত্রাণ সামগ্রী এবং নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে।

আবু হেনা আরও জানান, বর্তমানে পানি কমে যাওয়ায় ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। যদি কোথাও ত্রাণের প্রয়োজন হয় তাহলে মজুদ করা ত্রাণ সামগ্রী থেকে সেই সব জায়গায় বিতরণ করা হবে।

ঢাকাটাইমস/২৪জুলাই/প্রতিনিধি/এমআর

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :