মানবিক পুলিশ চাই

সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান
| আপডেট : ২৪ জুলাই ২০১৭, ১৮:৪৭ | প্রকাশিত : ২৪ জুলাই ২০১৭, ১৮:১৪

পুলিশের বিরদ্ধে অমানবিক দমন, পীড়নের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। শুরু থেকে শুরু করা যাক। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের ভিত নাড়িয়ে দেয়। এই বিদ্রোহে সনাতনী পুলিশি ব্যবস্থার ব্যর্থতা আরো সামনে চলে আসে। এরই প্রেক্ষিতে ১৮৬১ সালে পুলিশ আইন, ১৮৬১ প্রণীত হয়।

বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কঠোর এই আইন বেশ জোরাল ভূমিকা রাখে। পাকিস্তান আমলে স্বাধীনতাকামী পূর্ব বাংলার জনগণের উপর নির্যাতন-নিপীড়নে ভূমিকা রাখে পূর্ব বাংলারই পুলিশ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আয়োজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। ১৯৫২ সালের পর ছয় দফা আন্দোলন কিংবা ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানে পুলিশ ছিল আন্দোলন দমনে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের বড় হাতিয়ার।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পুলিশ তার এই দমন-নিপীড়নের পোশাক পরিবর্তন করে জনগণের সেবক হতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, যদিও মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা ছিল গৌরবজ্জ্বল। ১৯৮৭ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মারা যায় নূর হোসেন। ১৯৯৫ সালে কয়েক জন পুলিশ সদস্যের হাতে ধর্ষিত হয় ইয়াসমিন । তবে ইয়াসমিন হত্যা মামলায় অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি দিয়েছে আদালত ।

সাম্প্রতিক সময়ে সাতটি কলেজে আন্দোলনে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনায় গুরুতর আহত হন সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমান। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশের টিয়ারশেল নিক্ষেপের পর তিনি পড়ে যান। ডান চোখে এখন তিনি কোন আলোই দেখতে পারছে না।

বাংলাদেশের সংবিধানের দিকে তাকানো যাক। সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে দেশের জনগণের সমাবেশের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। সেখানে সাধারণ-নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের উপর টিয়ার শেল নিক্ষেপ পুলিশের অমানবিক আচরণেরই পরিচয় দেয়।

কিন্তু ভিন্ন চিত্র আমরা দেখি। ভ্যাটের বিরুদ্ধে করা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় পুলিশের এতটা মারমুখী চিত্র আমরা দেখেনি। অথচ তারা তিন দিন ঢাকা শহর অবরোধ করে রেখেছিল। পুলিশের তেমন কোন দাঙ্গা দমনের চিত্র আমরা সেই সময় দেখিনি। এটি যেন এক দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দুই রূপ ।

তবে সব দোষ যে পুলিশের উপর বর্তায় তাও নয়। স্বাধীন হওয়ার পর প্রতিটি সরকারই পুলিশকে তার স্বাধীন করে তার মতো কাজ করতে দিয়েছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যায়। ২০০৭ সালে একটি স্বাধীন পুলিশ বাহিনীর জন্য পুলিশ অধ্যাদেশ, ২০০৭ প্রণীত হয়। সেই অধ্যাদেশ আজ পযন্ত আলোর মুখ দেখেনি। কারণ, অধ্যাদেশ প্রণীত হলে পুলিশ মহাপরিদর্শক নিয়োগের দায়িত্ব সরকারের কাছ থেকে চলে যাবে জাতীয় পুলিশ কমিশনের কাছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় দুই বছরের মধ্যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পুলিশ সদস্যদের বদলি করা যাবে না। নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতিতে মন্ত্রী-এমপিদের মৌখিক, লিখিত বা টেলিফোন সুপারিশ ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে। সর্বোপরি একটি পুলিশ ‘ফোর্স’ নয় একটি পুলিশ ‘সার্ভিস’ বা সেবা হিসেবে পুলিশকে গড়ে তোলা যেত এই অধ্যাদেশ দিয়ে।

রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পুলিশকে জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। সরকার ও জন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা ভেবেছেন, পুলিশ অধ্যাদেশ বাস্তবায়িত হলে পুলিশ তার সিদ্ধান্ত স্বাধীনভাবে নিতে পারবে, নিয়ন্ত্রণ আর তাদের হাতে থাকবে না। কারণ পুলিশকে তো সবারই প্রয়োজন। বেশি প্রয়োজন বিরুদ্ধ মত বা স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য। এক্ষেত্রে একটি মারমুখী পুলিশ ফোর্স বেশি দরকার ।

১৮৬১ সালে থেকে ২০১৭, এই ১৫৬ বছর ধরে পুলিশ পরিচালিত হয়ে আসছে একটি ঔপনিবেশিক আইন দিয়ে, যে আইনের মূল লক্ষ্যই ছিল সমাজে বিরুদ্ধ মতকে দমিয়ে রাখা। সেই আইন আজও আমরা অনুসরণ করে আসছি। ব্রিটিশ আমলে যে ভীতিকর একটি রূপ পুলিশ বাহিনীর ছিল, শতবর্ষ পরে এসেও সেই রূপ থেকে বের হতে পারেনি পুলিশ। পুলিশকে ভয়ের রূপ বদলে মানবিকতার রূপ দিতে হলে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে। রাজনৈতিক দলসমূহের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও সদিচ্ছাই পারে সমাজে পুলিশকে একটি জনবান্ধব বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। যেখানে শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমানের মতো কাউকে চোখের জ্যোতি হারাতে হবে না।

লেখক: অপরাধ বিশ্লেষক ও শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :